Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমযান

| প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মনির হোসেন হেলালী

\ এক \
প্রতি বছর আমাদের মাঝে আগমন করে মাহে রমাদান। এ রমাদান আগমনের একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, রয়েছে তার কিছু আহ্বান। রমাদান শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিধানের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, রমাদান শব্দটি ‘রমযুন’ থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ জালিয়ে দেয়া, নষ্ট করে দেয়া, নিঃশেষ করে দেয়া ইত্যাদি। যেহেতু এমাসে বান্দার ভাল আমলের কারণে তার গুনাগুলোকে জালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয় সেহেতু একে রমাদান বলা হয়। এ মাসে বান্দার উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। সিয়ামের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা, দূরে থাকা, সরে থাকা ইত্যাদি। যেহেতু এমাসে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহ যাবতীয় পানাহার, যৌন ক্রিয়া এবং সব ধরনের অন্যায় থেকে বিরত থাকা হয় এজন্য একে সিয়াম বলা হয়। সিয়ামকে ফার্সি ভাষায় রোযা বলা হয়। রোযার প্রধান টার্গেটই হলো রোযাদারকে মুত্তাকি করে গড়ে তোলা। এর সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে নিন্মে আলোচনা করা হলো।
ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো রোযাও পর্যায়ক্রমে ফরয হয়। শুরুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে প্রতি মাসে মাত্র তিন দিন রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ রোযা ফরয ছিলো না। তারপর দ্বিতীয় হিজরিতে রমযান মাসের রোযার এ বিধান কুরআনে নাযিল হয়। তবে এতে এতটুকুন সুযোগ দেয়া হয়, রোযার কষ্ট বরদাশত করার শক্তি থাকা সত্তে¡ও যারা রোযা রাখবেন না তারা প্রত্যেক রোযার বদলে একজন মিসকিনকে আহার করাবেন। পরে দ্বিতীয় বিধানটি নাযিল হয়। এতে পূর্ব প্রদত্ত সাধারণ সুযোগ বাতিল করে দেয়া হয়। কিন্তু রোগী, মুসাফির, গর্ভবতী মহিলা বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা এবং রোযা রাখার ক্ষমতা নেই এমন সব বৃদ্ধদের জন্য এ সুযোগটি আগের মতোই বহাল রাখা হয়। পরে ওদের অক্ষমতা দূর হয়ে গেলে রমযানের যে কয়টি রোযা তাদের বাদ গেছে সে ক’টি পূরণ করে দেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।
রমাদান এর ব্যাপারে আলকুরআনের ঘোষণা হচ্ছে- “হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদইয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্ল­াহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্ল­াহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।” [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩-১৮৫]
সূরা আলবাকারার ১৮৩ নং আয়াতে যারা ঈমানের দাবিদার বা যারা এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনকারী তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যে, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। এটা কেবল তোমাদের উপরই যে ফরয করা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়, এ রোযা ফরয ছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপরও। যেহেতু আল্লাহ তোমাদের কল্যাণকামী সেহেতু তোমাদের মাঝে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার জন্য তিনি তোমাদের উপর একমাস রোযা রাখাকে ফরয করে দিয়েছেন। অশা করা যায় তোমরা তাকে ভয় করবে। এ আয়াতে নিশ্চিত করে বলা হয়নি যে, তোমাদের উপর যে রোযা ফরয করা হয়েছে তার মাধ্যমে তোমরা অবশ্যই মুত্তাকি হবে। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা মুত্তাকি হতেও পারো আবার নাও হতে পারো। এর দ্বারা বুঝা যায় রোযা শুধু রাখলেই হবে না এর হক আদায় করে রাখতে হবে এবং বিশেষ কিছু শর্তও মেনে নিতে হবে। এর যে টার্গেট ঈমানদারকে মুত্তাকি বানান তার জন্য সাধনা করতে হবে। রোযার মাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাকি এগারটি মাস সে আলোকে সঠিকভাবে অতিবাহিত করতে হবে। এ মাসে যে আমলগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে তা একটু পরেই আলোচনা করবো।
রমযান মাসের ফাজীলাত : রমযান মাসের আগমনে মুসলিমগণ আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। আনন্দ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে- ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। তারা যা সঞ্চয় করে এটা তার চেয়ে উত্তম।’ [সূরা ইউনুস : ৫৮]
পার্থিব কোন সম্পদের সাথে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না, তা হবে এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা। যখন রমযানের আগমন হত তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় আনন্দিত হতেন, তাঁর সাহাবাদের বলতেন, তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমযান এসেছে। এরপর তিনি এ মাসের কিছু ফজীলত বর্ণনা করে বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। [নাসায়ী : ২১০৫]
রমযান হল কুরআন নাযিলের মাস : কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অন্য যে কোন মাসের চেয়ে বেশি। এ মাসে মানুষের হিদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা উচিত। প্রতি বছর রযান মাসে জিবরীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
এছাড়াও এ মাসের আরো অনেক ফাজীলাত রযেছে। যেমন- রমযান মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর, রমযান মাস দু‘আ কবুলের মাস। রমযান পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। রমযান জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। রমযান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। রমযান ধৈর্য ও সবরের মাস। রমযান মাস কুরআন প্রতিষ্ঠার মাস। এমাসে কুরআনের আহŸানে সাড়া দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে বদরের প্রান্তরে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সহাবায়ে কিরাম। ঈমানের দাবিতে সাহাবায়ে কিরামের পথে আজ আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
সিয়াম পালনের ফাজীলাত : এক. সিয়াম শুধু আল্লাহর জন্য : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদাত-বন্দেগী থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি এক হাদীসে কুদসীতে বলেন- মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম তার ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। [মুসলিম : ২৭৬০]
এ হাদীস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবী আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু যখন বলেছিলেন- ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি সিয়াম পালন কর। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোন আমল নেই।’ [নাসায়ী : ২৫৩৪]
সিয়ামের এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ