তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
এ মা জ উ দ্দী ন আ হ ম দ : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। বর্তমানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। আন্দ্রে ম্যাথিয়েট তারপরও বলেন যে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছামতো নীতিনির্ধারণ করতে পারেন না। তার একনায়কসুলভ শাসন বন্ধ করার জন্য বহু সাংবিধানিক ঐতিহ্যগত বিধি রয়েছে। সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান হলো সংসদীয় ব্যবস্থা সংক্রান্ত মৌল বিধিবিধানসমূহ।
তত্ত¡গত দিক থেকে বলা যায়, কেবিনেট এখন পর্যন্ত সার্বভৌমের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের অনানুষ্ঠানিক সমাবেশ। সর্বশেষে, কোনো প্রধানমন্ত্রী বিভাগীয় কার্যক্রমের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধান করতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সহকর্মীদের দ্বারাই তিনি তা সম্পন্ন করেন। এভাবেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী শাসকে রূপান্তরিত হয়েছেন। তবে একনায়কে পরিণত হননি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের মধ্যমণি। তাকে বলা হয় মন্ত্রিপরিষদ ‘স্থাপত্যের প্রধান প্রস্তর’। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে, বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদের প্রধান হিসেবে, তার গুরুত্ব ও পদমর্যাদা অনন্য। সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে।’
৫৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়Ñ ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এ সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে’।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সংসদের নিকট, রাষ্ট্রপতির নিকট নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেরও নেতা। এদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। কোনো নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর কোনো নিয়ন্ত্রণবিহীন এমন ক্ষমতার অধিকারী অন্য কোনো কর্মকর্তা বিশ্বে দেখা যায় না। তার ক্ষমতা রাশিয়ার পুধৎ-এর ক্ষমতার মতো। ভারতের মোগল সম্রাটদের মতো। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার চেয়েও তিনি অধিক ক্ষমতার মালিক। প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংসদের কোনো পদক্ষেপ কার্যত নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তার হাতকে আরো শক্তিশালী করেছে। সংসদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় সংসদ সদস্যদের ওপর ঝুলন্ত থাকে ডেমোক্লিসের তরবারির মতো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ।
৭০ অনুচ্ছেদের ভীতির কারণে কোনো সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মুখ খুলতে সাহস করেন না। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ‘ব্যক্তিগত ক্ষমতায়’ রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে তার নিজস্ব সচিবালয়ের মাধ্যমে। এই সচিবালয় এক অর্থে একটি সুপার সচিবালয়, কেননা এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সকল মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের শুধু সমন্বয় করেন না, নিয়ন্ত্রণও করেন। বাংলাদেশ সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকলকে ভাবতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, নি¤েœ বর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে যেমন সাম্যবস্থা সৃষ্টি হবে, তেমনি কোনো শাখা রক্তহীনতায় ভুগবে না এবং কোনো শাখা, বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ দায়িত্বের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়বে না।
এক. কোনো নিয়মতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর দলীয় প্রধানের পদে আর থাকেন না এই জন্য যে, দলের নেতৃত্ব ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রত্যেক দলের এবং প্রত্যেক নাগরিকের প্রধানমন্ত্রীরূপে শাসন কাজে মনোযোগী হতে পারেন। তাছাড়া, এ অবস্থায় রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা আবর্ত স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।
দুই. রাষ্ট্রপতি যেসব কর্মকর্তার পদচ্যুতি ঘটাতে পারেন, বিশেষ করে সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহের যেমন নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্যবৃন্দ, কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নয় বরং রাষ্ট্রপতির সবিচালয়ের মাধ্যমে বাছাই করে জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির অনুমোদনের পর যদি রাষ্ট্রপতি নিজে নিয়োগ দেন তাহলেও রাষ্ট্রপ্রধান এই নিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অভিভাবকরূপে কিছুটা ভ‚মিকা পালন করতে পারেন।
তিন. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে, শুধু অনাস্থা পেশের সময় ব্যতীত অন্য সময়ে বিরোধী দলের আনীত উপযুক্ত প্রস্তাবের পক্ষে যেন সরকারি দলের যারা আগ্রহী তারা সমর্থন দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা রাখা যায়, কেননা বর্তমান অবস্থা ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু সদস্যদের আনুগত্য বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য অর্জন করে না। সদস্যদের সৃজনশীলতা অথবা যথার্থ বক্তব্যের সব পথ রুদ্ধ করেছে।
চার. প্রত্যেক বছরে প্রথম অধিবেশনে জাতীয় সংসদে মন্ত্রিসভা কর্তৃক তৈরি করা বক্তব্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মতামত অথবা উপদেশের কোনো সুযোগ নেই। অথচ কার্যত তিনিই জাতির অভিভাবক। তিনি যেন এ ক্ষেত্রে তাঁর কথা উচ্চারণ করতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাঁর বক্তব্য তিনিই লিখবেন।
পাঁচ. সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বক্তব্য ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’
এটি এই সংবিধানের শ্রেষ্ঠতম বক্তব্য, কিন্তু পর্যালোচনা করুন, দেখবেন প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিকদের রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ে নির্দিষ্ট দিনে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোনো ভ‚মিকা নেই। অত্যন্ত জটিল বিষয়ে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের যেসব ক্ষেত্রে ঐকমত্য হচ্ছে না, অথচ হওয়া উচিত, সে ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিকদের যথার্থ ভ‚মিকা পালনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। কোনো কোনো বিষয়ে জনমতের প্রকাশ ঘটিয়ে রেফারেন্ডামের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
ছয়. সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি যেন জাতীয় সঙ্কটকালে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারকে পরামর্শ দান করতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
সাত. সংসদীয় ব্যবস্থা হলো এমন সরকারব্যবস্থা যা কার্যত সংখ্যালঘু দলের সম্মতিসহ সংঘ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন। তাই বলা হয়, আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ ছাড়াও অনানুষ্ঠানিক নিয়ম-পদ্ধতির মাধ্যমে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার বন্ধনে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সংখ্যালঘু দল আবদ্ধ থাকুক। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থপূর্ণ হয় শুধু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আবহে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।