Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অ ধ্যা প ক মু হ ম্ম দ ম তি উ র র হ মা ন : সম্প্রতি নওগাঁর পতিসরে সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদ্যাপিত হলো। বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করায় তা অধিক গুরুত্ব বহন করে। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট আলোচকবৃন্দ বলেন- “রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তিনি ছিলেন মানুষের ধর্মে বিশ্বাসী।’ রবীন্দ্রনাথের ‘ঞযব ৎবষরমরড়হ ড়ভ গধহ’ বা ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থটি আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয় যে, এ গ্রন্থে প্রতিফলিত রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা আমাদের অনুসরণ করা উচিত। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা-পর্যালোচনা করা উচিত। তাই এখানে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা এবং আমাদের ধর্মের সাথে তা কতটা সামঞ্জস্যশীল এবং তার কতটুকু কীভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা আলোচনা করার প্রয়াস পাব।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বখ্যাত কবি। প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মের পিছনে একটি বিশেষ ভাব, চিন্তা-দর্শন, মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। স্রষ্টার মনের ভাব, চিন্তা-দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি তার সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হয়। যিনি নাস্তিক, তার সৃষ্টিকর্মেও তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা নাস্তিক্য চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটে। যিনি আস্তিক, তার সৃষ্টিকর্মেও স্বভাবতই তার আস্তিক্য ভাব-দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তবে আস্তিক মাত্রেই সব এক গোত্রের নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত ও দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মধ্যেও বিদ্যমান। তাই নাস্তিক-আস্তিক উভয় শ্রেণির মানুষের সৃষ্টিকর্মেই তাদের নিজস্ব মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাই স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ আস্তিক্যবাদী ছিলেন। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, ধর্ম পালনে তাঁর অনীহা না থাকলেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তিনি সজ্ঞানে পরিহার করতেন, ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। তবে তাঁর ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কে অনেকের অনেক ধরনের ধারণা রয়েছে। তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তিনি নিজে কী বলেছেন, লিখেছেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজন সে সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, এখানে যথাযথ উদ্ধৃতিসহ সে সম্পর্কেই সংক্ষেপে কিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়াস পাব।
রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ। তবে ‘ঠাকুর’ পদবি পূর্বে ছিল না। ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথের ষষ্ঠতম পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ‘ঠাকুর’ পদবি লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরিগণ ঠাকুর হিসাবে পরিচিতি পান। পঞ্চানন ঠাকুরের আদিনিবাস ছিল যশোরে। সেখান থেকে তিনি তৎকালীন কলকাতার গোবিন্দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। গোবিন্দপুর ও পার্শ¦বর্তী সূতানটি ও কালিঘাট এ তিনটি গ্রাম নিয়ে পরবর্তীতে কলকাতা শহর গড়ে ওঠে। পঞ্চাননের ছেলে জয়রাম ঠাকুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে চব্বিশ পরগণায় আমিনের কাজ করতেন। জয়রামের দুই পুত্র দর্পনারায়ণ ঠাকুর ও নীলমণি ঠাকুর। নীলমণি আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সেরেস্তাদার ছিলেন। নীলমণি ঠাকুরের পুত্র দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথ প্রথমে ল’ এজেন্ট, পরে ব্যবসা এবং সর্বশেষে চব্বিশ পরগণায় কালেক্টরের সেরেস্তাদার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহীর ২৪৯ বর্গমাইলব্যাপী বিশাল জমিদারী ক্রয় করে জমিদার বনে যান। এরপর থেকে ঠাকুর পরিবার জমিদার পরিবারে পরিণত হয়। পরবর্তীতে দ্বারকানাথ ঠাকুর হুগলি, পাবনা, রাজশাহী, মেদিনীপুর, রংপুর ও ত্রিপুরা জেলার বিভিন্ন জমিদারী ক্রয় করে নেন। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বিশাল জমিদারীর মালিক হন। এভাবে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষগণ উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন। সে সুবাদে বংশানুক্রমে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ব্রাহ্মণ।
তবে এত সরলভাবে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন বিশ্বমানের বিশাল প্রতিভা। তিনি জীবনে অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে অনেকটা উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ-বর্জনের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর মানস-জগতে কাল-বিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। অনুরূপভাবে, ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) অতিশয় বিষয়-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া সত্তে¡ও ধর্ম পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন। জমিদারী দেখাশুনার পাশাপাশি তিনি ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সংস্পর্শে এসে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা অনেকটা বদলে যায় এবং পরবর্তীকালে তিনি ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হন।
রামহোমন রায় দেবেন্দ্রনাথকে পৌত্তলিকতা বর্জনে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি নিজেও ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় তিনি সুপÐিত ছিলেন। ইংরেজি শিক্ষা-সভ্যতা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে তাঁর মানস পরিগঠিত। খ্রিষ্টান পাদ্রিদের প্রচারণায় বাঙালি হিন্দু সমাজে তখন ধস্ নেমেছিল। অনেক হিন্দু বিশেষত ইংরেজি শিক্ষিত আধুনিক যুবশ্রেণির অনেকেই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়। মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত তাদের একজন। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত যুবকদেরকে ধর্মত্যাগে বিরত রাখার উদ্দেশে রামমোহন হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনার পর তিনি পৌত্তলিকতা বর্জন করে একেশ্বরবাদী হবার প্রেরণা লাভ করেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদে ‘একমেবা দ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ একেশ্বরবাদের কথা বলা হয়েছে। এভাবে তিনি খ্রিষ্টানধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেন। অতঃপর ব্রজেন্দ্রনাথের ভাষায় “এই সংশয় প্রথমে মুসলমানি বিদ্যার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিল, পরে ইংরেজ প্রভাবে ইহা পূর্ণ বিকশিত হইতে প্রায় পনের বছর লাগিয়াছিল।” এভাবে রামমোহন রায় ব্রাহ্মমতের প্রবর্তন করেন। ব্রাহ্মমতে কোন মূর্তিপূজা নেই। জ্ঞান-ভিত্তিক, যুক্তি-ভিত্তিক আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তাধারার ভিত্তিতে ব্রাহ্মমতের ভিত্তি স্থাপিত। সেকালে অনেক শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী হিন্দুগণ এ মতের অনুসারী হন।
রামমোহন কোন ধর্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেত্রে তিনি একটি দলিল সম্পাদন করেন। একেশ্বরের উপাসনা এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে সে উপাসনায় যোগ দিতে পারবেন এবং কোনরূপ চিত্রকর্ম, প্রতিমূর্তি, প্রতিমা বা খোদিত মূর্তি এ উপাসনায় স্থান পাবে না বলে এতে উল্লেখ আছে। রামমোহন কোন ধর্ম মন্দির স্থাপন না করলেও দেবেন্দ্রনাথ স্বগৃহে ব্রাহ্মমন্দির স্থাপন করেন এবং সেখানে নিয়মিত উপাসনা ও ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথের খুড়তুত ভাই গুণেন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতেন এবং সকলেই তা ভক্তিভরে গাইতেন ও শুনতেন। রবীন্দ্রনাথের শৈশবকাল এ ধরনের ব্রহ্মসঙ্গীত শ্রবণের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের মানস গঠিত হয় পিতা দেবেন্দ্রনাথের আদর্শে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর পিতা সম্পর্কে বলেছেন :
“ছোটো হইতে বড়ো পর্যন্ত পিতৃদেবের সমস্ত কল্পনা এবং কাজ অত্যন্ত যথাযথ ছিল। হিমালয় যাত্রায় তাঁহার কাছে যতদিন ছিলাম একদিকে আমার প্রচুর পরিমাণে স্বাধীনতা ছিল, অন্যদিকে সমস্ত আচরণ অলঙ্ঘরূপে নির্দিষ্ট ছিল। ভুল করিব বলিয়া তিনি ভয় পান নাই, কষ্ট পাইব বলিয়া তিনি উদ্বিগ্ন হন নাই। তিনি আমাদের সম্মুখে জীবনের আদর্শ ধরিয়াছিলেন কিন্তু শাসনের দÐ উদ্যত করেন নাই।”
দেবেন্দ্রনাথের জীবনকালে তাঁর পরিবার থেকে ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে ব্রাহ্মধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণ্যসমাজে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং কেশবচন্দ্র পৃথক ব্রহ্মমন্দির স্থাপন করেন। এসময় যুবক রবীন্দ্রনাথ আদি সমাজের সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন।
এদিকে, গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ হিন্দুধর্মের বিপণœদশা দেখে ক্ষুদ্ধ হন এবং তারা ব্রাহ্মণ্যবাদের মহিমা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। একাজে গতি সৃষ্টির উদ্দেশে ‘সাহিত্য সম্রাট’ ও হিন্দু সমাজে ‘ঋষি’ হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) পৃষ্ঠপোষকতা ও অক্ষয়চন্দ্র সরকার (১৮৪৬-১৯১৭)-এর সম্পাদনায় ‘নবজীবন’ ও বঙ্কিমচন্দ্রের জামাতা রাখালচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৯) সম্পাদিত ‘প্রচার’ নামে দু’টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এ দু’টি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ব্রাহ্মধর্মের অসারতা প্রতিপন্ন করে ‘ধর্ম-জিজ্ঞাসা’ ও ‘হিন্দু ধর্ম’ শীর্ষক দু’টি প্রবন্ধ লেখেন। ফলে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকগণ কিছুটা হতবল হয়ে পড়লেও সে সময়কার যুবক রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ‘হাস্য-কৌতুক’, ‘স্বপ্ন মঙ্গলের কথা’ ও ‘হিং টিং ছট্’ ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে কঠোরভাবে এর জবাব দেন।
উপরোক্ত তথ্য-প্রমাণের দ্বারা এটা সহজেই বোধগম্য হয় যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শৈশবকাল থেকে যৌবন অবধি ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রামমোহনের প্রতিও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রামমোহনকে তিনি হিন্দু নবজাগরণের ‘প্রাণপুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করেন। রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্য যথার্থ হলেও রামমোহনের তিরোধানের পর ব্রাহ্মধর্ম যখন ক্রমান্বয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথও তখন ধীরে ধীরে ব্রাহ্মধর্ম থেকে প্রকাশ্যত সরে এসে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু ইতঃমধ্যে তিনি আরো অনেক মত ও চিন্তা-দর্শনের দ্বারা কিছুটা হলেও প্রভাবিত হন। এরমধ্যে ইসলামের সুফিবাদ এবং পূর্ব বাংলার বাউল মতাদর্শ তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। সুফিবাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণও অনেকটা আজন্ম এবং পিতার কারণে। দেবেন্দ্রনাথ ফারসি কবি রুমী, হাফিজ প্রমুখের অতিশয় ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজে ফারসি জানতেন এবং ছেলেদেরকে ফারসি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাড়িতে ফারসি মুন্সী নিয়োগ দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ হর-হামেশাই ফারসি বয়াত গভীর আগ্রহে ও আবেগে আবৃত্তি করতেন। শোনা যায়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি যখন রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন, তখন প্রায়ই সুফি কবিদের ফারসি বয়াত আবৃত্তি করতেন।
পিতার আদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথের উপর সুফিবাদের প্রভাব পড়া একান্তই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের পরিবার-পরিপার্শ্বেও ফারসি সাহিত্য ও সুফিবাদের প্রভাব বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চিন্তায়ও সুফিবাদের ঘনিষ্ঠ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁর রচিত বিভিন্ন কাব্য-কবিতায় বিশেষত শেষ জীবনের রচনাবলিতে এ প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। বৈষ্ণববাদ ও বাউল মতের উদ্ভব বাংলাদেশে ঘটলেও এ দু’টি মতবাদের মধ্যে সুফিবাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব নিহিত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বিশেষভাবে সুফী-বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তা সকলেরই জানা।
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জমিদারি কার্যোপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আগমন করে সেখানে বাউল সম্রাট লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) ও গগণ হরকরার (১৮৪৫-১৯১০) সাক্ষাৎ লাভ করেন। এটা তাঁর জীবনের এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষিত প্রতিভাবান কবির রচিত গানে প্রতিফলিত দর্শন ও জীবনচর্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হন। সৃষ্টিতত্ত¡, দেহতত্ত¡, আধ্যাত্মচেতনা ও গভীর জীবন-জিজ্ঞাসামূলক বাউল গানে প্রতিফলিত জীবনদর্শন কবির প্রাজ্ঞ-অধীত জীবন-চৈতন্যকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। তাদের জীবনদর্শন রবীন্দ্রনাথের অন্তরকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনায় বাউল মতবাদের প্রভাব পরবর্তীকালে গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের উপর বাউলদের যে প্রভাব তাঁর রচিত ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে সে সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর এবনে গোলাম সামাদের একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেনÑ
“রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’ নামক বইটির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এটা লিখিত হয় রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ সালে যে ‘হিবার্ট লেকচার’ দেন, তার ভিত্তিতে। বইটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায় ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ নামে লন্ডন থেকে। রবীন্দ্রনাথ এতে বলেন, বাংলার বাউলদের ধর্ম হলো মানবধর্ম। কেননা তারা কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করে না। সবাই বাউল হতে পারে। বাউল হতে কারো বাধা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই কথা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা, বাউলরা হলেন খুবই গুরুবাদী। তারা মনে করেন, কেবল গুরুর কাছ থেকেই শেখা সম্ভব প্রকৃত আরাধনা পদ্ধতি। যার মাধ্যমে আসতে পারে মানবাত্মার মুক্তি। বাউলদের মধ্যে আছে বিভিন্ন গুরুর শিষ্য। আছে চিন্তার ভেদ। তাই তাদের বলা চলে না, অসাম্প্রদায়িক। বাউলরা খুবই গঞ্জিকাসেবী। এরা যাপন করে শিথিল যৌন-জীবন। পালন করতে চান না, গার্হস্থ্য-ধর্ম। চান না সন্তান-সন্ততির দায়িত্ব নিতে। রবীন্দ্রনাথ এর আগে অনেক লেখায় বৈরাগ্যের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মানুষের ধর্ম বইতে প্রশংসা করেছেন বাউলদের; যারা হলেন বৈরাগ্যবাদী। তিনি মানুষের ধর্মে এটা কেন করেছেন, সেটার ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) দাবি করেছেন, মানুষের ধর্ম বইতে বাউল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, সেই অংশটি লিখেছিলেন তিনি, রবীন্দ্রনাথ নন। ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক। তাঁর খ্যাতির একটি কারণ হলো, ভারতীয় মরমীবাদী চিন্তার ওপর গবেষণা। অর্থাৎ যাকে এখন রবীন্দ্রচিন্তা বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা আসলে হলো ক্ষিতিমোহন সেনের চিন্তা। রবীন্দ্র-চিন্তার ফসল তা নয়। অবশ্য এক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউলদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বাউলরা খুবই গুরুবাদী। আর রবীন্দ্রনাথও চেয়েছেন কবিগুরু হতে। বিশ্বে আর কোনো কবি সম্ভবত এ রকম কবিগুরু হতে চাননি। তারা কেবলই চেয়েছেন কবি হতে।” (দ্রষ্টব্য : ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ : রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৩ মে ২০১৭)।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল পুরস্কার লাভের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু লেখপাড়ায় মনঃসংযোগ না ঘটায় তিনি পড়া শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন। নোবেল পুরস্কার লাভের পর সারা বিশ্বের দ্বার তাঁর জন্য উন্মুক্ত হয়। তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বাংলার শ্যামলীম প্রকৃতি, ফসল ভরা মাঠ, কুলুকুলু বেগে প্রবাহিত স্রোতস্বিনী, মেঘমল্লার গান গেয়ে রঙিন পাল তুলে বর্ষার ভরা নদীতে মাঝি-মাল্লার নৌকা বেয়ে চলা, মেঘমেদূর আকাশ, স্নিগ্ধ-শুভ্র চাঁদের আলোয় দীপ্ত রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় বিশ্বের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর ফলে তাঁর জীবন-জিজ্ঞাসার তরিতে অনেক সোনালি ফসলের আনজাম ঘটে। হেগেল, ফ্রয়েড, এঙ্গেলস, কার্লমার্কস প্রমুখ আধুনিক চিন্তানায়ক ও দার্শনিকদের যুগান্তকারী চিন্তা-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। তিনি জন্মসূত্রে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, তাঁর স্বসমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু, সে হিসাবে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি সম্ভবত পূর্বপুরুষদের সনাতন আদর্শ-ঐতিহ্যের অনুসারী হিসাবে আত্মপরিচয় দেয়াই নিরাপদ ও যুক্তিযুক্ত মনে করেন। তাই দেখা যায়, বিপুল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও গভীর মানবিকবোধসম্পন্ন অনুভূতিপ্রবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীকালে নিজেকে একজন খাঁটি হিন্দু বলে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেছেন। তবে ইতোপূর্বে তাঁর বিশ্বাস ও আচরণে ব্রাহ্মধর্মের যে ছাপ লেগে গিয়েছিল, সেটাকেও তিনি সম্পূর্ণ বর্জননি। বরং হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্ম যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অথবা সনাতন হিন্দুধর্মের আধুনিক সংস্করণ হলো ব্রাহ্মধর্ম প্রকারান্তরে এটাই যেন তিনি বলতে চেয়েছেন। এসময় হেমন্তবালা দেবীকে লেখা একপত্রে (১৩নং) রবীন্দ্রনাথ বলেন : “আমি হিন্দু সমাজে জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আমি ব্রাহ্ম স¤প্রদায়ভুক্ত। আমার ধর্ম বিশ্বজনীনতা এবং সেটাই হিন্দুধর্ম।”
১৩৪১ সালের আশ্বিন সংখ্যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তিনি লেখেন ঃ
“আমি বলছি, যা কিছু মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শের সঙ্গে মেলে তাই হিন্দুধর্ম। কেননা, হিন্দুধর্মে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম তিন পন্থাকেই ঈশ্বরের সঙ্গে যোগের পন্থা বলেছেন। খ্রিষ্টান ধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্মের একটা জায়গায় শ্রেষ্ঠত্ব এই দেখি, হিন্দুধর্ম সন্ন্যাসবাদ ধর্ম নয়। ...হিন্দুধর্মকে বাইরের দিকে যে সব স্থূল আবরণে আবৃত করেছে, তাকে বাদ দিয়ে যে জিনিষটাকে পাই সেতো কোনো ধর্মের চেয়ে কোনো অংশে নিকৃষ্ট নয়। কেননা, এতে মানুষের হৃদয়, মন, আত্মা এবং কর্মচেষ্টা সমস্তকেই ভূমার দিকে আহŸান করেছে। আমি এই জন্যেই হিন্দু নাম ছাড়তে পারিনেÑব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্ম থেকে পৃথক করতে পারিনে।”
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে মনের দ্বিধা-সংকোচ দূর করে অনেকটা আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলেন :
“আমি হিন্দু, এ-কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাহলে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে।”(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়)
রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব সম্পর্কে পরমেশ চৌধুরী তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে আরো বলেন : “বিশ্বমানবতা, আন্তর্জাতিকবাদ-অসা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এসব কিছুর মূলই রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব। আধুনিক রবীন্দ্রসমালোচকদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বমানবতা, ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ-কথাটা ভুলে যান যে হিন্দুত্বই তাঁর ‘প্রতিষ্ঠাভূমি’Ñতিনি কোন নূতন মতবাদ, নূতন কোন আদর্শ প্রচার করতে চাননি। চিরন্তন হিন্দুত্বের আদর্শ বা ভারতীয় আদর্শগুলোর পুনর্জাগরণই চেয়েছিলেন তিনি, এবং নাটকে, গানে, প্রবন্ধে কবিতায় প্রচার করে যাবার চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য। এসব কথা যে মনগড়া নয় তা ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধটি পড়লেই উপলদ্ধি করতে পারবেন জিজ্ঞাসু পাঠক।” (দ্রষ্টব্য : ঐ, পৃ. ১৫)।
শান্তি নিকেতনে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে আচার্য জগদীশচন্দ্রের (১৮৫৮-১৯৩৭) নিকট এক চিঠিতে লেখেন :
“শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীন কালের গুরুগৃহ বাসের মত সমস্ত নিয়ম। ধনী-দরিদ্র সকলেই কঠিন ব্রহ্মচর্য্যে দীক্ষিত হইতে হইবে। ...ছেলেবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য্য না শিখিলে আমরা প্রকৃত হিন্দু হইতে পারিব না।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদ্দেশ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“আমি ভারতীয় ব্রহ্মচর্য্যরে প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্মলভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই। বিদেশী মেøচ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়, ইহা হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিও।”
উপরোক্ত উক্তি থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্য ও তপোবনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সে আদর্শে নতুন প্রজন্মের তরুণদেরকে গড়ে তোলার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যে তিনি ভারতীয় মুসলিমদেরকে ‘বিদেশী’ এবং ‘ মেøচ্ছ’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের প্রভাব থেকে নিজেকে সর্বোতভাবে মুক্ত রাখার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। মানবতাবাদী উদারচিত্ত রবীন্দ্রনাথ মুসলিমদেরকে তুচ্ছাত্বকভাবে ‘মেøচ্ছ’ বলে উল্লেখ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা তিনি নিজেকে মুসলিম-বিদ্বেষী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলে প্রমাণ করতে গিয়ে যেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসও বিস্মৃত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর এখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে যে উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হয় এবং বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ প্রথার ফলে শতধাবিভক্ত ভারতীয় সমাজে যে সমতা, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, উদার মানবিক সমাজ ও সভ্যতার পত্তন ঘটে, সর্বোপরি মুসলিম শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে অনন্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে, সে সম্পর্কেও তিনি রহস্যময় নিস্পৃহ ভাব প্রদর্শন করেছেন। বরং এখানে তিনি উপমহাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির উদ্ভব, বিকাশ ও লালনকে সর্বোতভাবে প্রতিরোধ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শারদীয় দেশ’ সংখ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ রায় (১৯০৬-৬৪) এক প্রবন্ধে লিখেছেন :
“১৯০১ সালের ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল। নাম থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য এবং প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শ এবং এই বিদ্যালয়ের চরিত্র সহজেই আন্দাজ করে নেওয়া যায়। আদর্শ হলো প্রাচীন ভারতের তপোবন, শিক্ষকেরা গুরু, ছাত্রেরা ঋষি কুমার। তপোবন যে ঐতিহাসিক সত্য, শুধু অতীতের নয়, চিরকালের সত্য, এ আদর্শ যে মোটেই কালাতিক্রান্ত নয়, অবিলম্বে এ কালের জীর্ণ ভারতবর্ষকে উদ্ভিন্ন করে এক মহাজীবনের আবির্ভাব হবে সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। তপোবন বিদ্যালয়ের কাঠামো যে সর্বভারতীয় হওয়া সম্ভব নয়, বাস্তব পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়, তা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়নি, অন্তত তখন মনে হয়নি। ভারতীয়ত্ব আর হিন্দুত্বকে সেদিন তিনি অল্পবিস্তুর গুলিয়ে ফেলেছিলেন। অনেক পরে তপোবনের ঐতিহাসিক সত্যতার বিষয়ে তিনি নিজেই গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আপাততঃ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ের কথাই বলিÑ নিয়মাবলীতে বলা হলোঃ ‘ছাত্রগণকে স্বদেশের প্রতি বিশেষরূপ ভক্তি-শ্রদ্ধাবান করিতে চাই।’ অনতিকাল পরে দেখা গেল এই সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বদেশ আর হিন্দুধর্ম প্রায় এক হয়ে গিয়াছে। বিদ্যালয় জীবন চর্চায় প্রাচীন ভারত দেখতে দেখতে হিন্দু ভারত হয়ে উঠল। হিন্দুধর্মের বর্ণাঢ্য ছটামÐলের সম্মোহনে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ একজন অতি নিষ্ঠাবান হিন্দু হয়ে উঠলেন এবং আশ্রম বিদ্যালয়ে সংহিতার অনুশাসন, বর্ণাশ্রম-ভেদাভেদ, ব্রাহ্মণ্য-গরিমা সবই ঢুকে পড়লো। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন, ‘অ-ব্রাহ্মণ শিক্ষক ব্রাহ্মণ ছাত্রের প্রণম্য নয়।” (সত্যেন্দ্রনাথ রায় : ‘রবীন্দ্র-মানসে হিন্দুধর্ম’)।
হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করেছে। জাতিভেদ প্রথা মানুষে মানুষে প্রভেদের বেড়াজাল ও হিংসা-বিদ্বেষ-অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। হিন্দুধর্মে তার বর্ণ-গোত্র-বংশের দ্বারা মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয়। অন্যদিকে, মানবীয় গুণের দ্বারা ইসলাম মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে, সেখানে বর্ণ- গোত্র-জাত-পাতের কোন স্থান নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে মানবিক গুণ নয়, বর্ণ ও বংশের মর্যাদাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। এটা কতটা অনুদার, অমানবিক ও অযৌক্তিক তা আধুনিক সভ্যতার যুগে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আধুনিক যুগে বর্ণ-ভাষা-গোত্র-বংশ নয়, বরং মানবিক গুণ ও যোগ্যতাই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসাবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। ইসলাম প্রায় দেড় হাজার পূর্বেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান দিয়েছে। আল-কুরআন ও আল-হাদিস এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। বলা হয়েছেÑ বর্ণ-গোত্র-বংশ নয়, মানুষের উন্নত মানবীয় গুণাবলিই (আমল আখলাক) তার মর্যাদার মাপকাঠি।
এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী এবং মুক্ত-চিন্তার অধিকারী কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) বলেনÑ
“রবীন্দ্রনাথের জন্ম এক মহৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিন্দুধর্মের সংস্কারকের পুত্ররূপে। পিতার ব্যক্তিত্ব চিরদিন তাঁর অন্তরে জাগিয়েছে সম্ভ্রম আর প্রেরণা। ...রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক নিসর্গপ্রীতি আর বঙ্কিমের প্রবর্তিত চিন্তাধারার প্রতি আহৃত বিরূপতা হয়ত নিরূপিত করেছিল তাঁর প্রতিভার গতিপথ। পরবর্তীকালে অবশ্য এমন সময় রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এসেছিল, যখন প্রায় বঙ্কিমের ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদী তিনি হয়ে পড়েছিলেন।”(কাজী আব্দুল ওদুদ : শাশ্বত বঙ্গ, পৃ. ৭৩)।
বর্ণাশ্রম ধর্ম বা জাতিভেদের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্রাহ্মণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন :
“এই জন্যই সীমাবদ্ধ করা, কর্মকে ধর্মের সহিত যুক্ত করা, কর্মকে প্রবৃত্তির হাতে, উত্তেজনার কর্মজনিত বিপুল বেগের হাতে ছাড়িয়া না দেওয়া; এবং এই জন্যই ভারতবর্ষে কর্মভেদ বিশেষ বিশেষ শ্রেণিতে নির্দিষ্ট করা।” (ব্রাহ্মণ)
বর্ণাশ্রম প্রথার সমর্থক ব্রাহ্মণ রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণকে ‘মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ’ বলে উল্লেখ করে জাতিভেদ প্রথার উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করে লিখেছেন :
“জাতিভেদ খুব ভাল। এই জাতি-বিভাগ প্রণালীই আমরা অনুসরণ করতে চাই। জাতি-বিভাগ যথার্থ কি, তা লাখে একজন বোঝে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে জাত নেই। ...ভারতে এই জাতিবিভাগ প্রণালীর উদ্দেশ হচ্ছে সকলকে ব্রাহ্মণ করাÑব্রাহ্মণই আদর্শ মানুষ। যদি ভারতের ইতিহাস পড়ো, তবে দেখবেÑএখানে বরাবরই নিম্নজাতিকে উন্নত করবার চেষ্টা হয়েছে। অনেক জাতিকে উন্নত করা হয়েছেও। আরও অনেক হবে। শেষে সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। ...কাকেও নামাতে হবে নাÑসকলকে ওঠাতে হবে।... ইউরোপ আমেরিকার জাতি-বিভাগের চেয়ে ভারতের জাতি-বিভাগ অনেক ভাল।Ñভারতীয় সমাজ স্থিতিশীল কবে দেখেছ? এ সমাজ সর্বদাই গতিশীল।” (বাণী ও রচনা, ৯ম খÐ, ৪৬৪-৬৫)
উচ্চবর্ণের মানুষ অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে রবীন্দ্রনাথ মনুষ্যত্বের আদর্শ বলে উল্লেখ করেছেন এবং নিম্নবর্ণের মানুষকে সর্বদা উচ্চবর্ণে উন্নীত করার চেষ্টায় হিন্দুধর্ম নিয়োজিত বলে হাস্যকর দাবি করেছেন। হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা এতই কঠিন যে, এক বর্ণের লোকদের সাথে অন্য বর্ণের মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ে-শাদী, সমাজ-সামাজিকতা ইত্যাদি কোন কিছুই সম্ভব নয়। বরং উচ্চবর্ণের লোকদের সেবা করার উদ্দেশেই নিম্নবর্ণের লোকদের সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথও কর্মের ভিত্তিতে শ্রেণিভেদের কথা উল্লেখ করেছেন অন্যভাবে। তিনি বলেন :
“অতএব যে সমাজে কর্ম আছে সেই সমাজেই কর্মকে সংযত রাখিবার বিধান থাকা চাইÑঅন্ধ কর্মই যাহাতে মনুষ্যত্বের উপর কর্তৃত্ব লাভ না করে এমন সতর্ক পাহারা থাকা চাই। কর্মীদলকে বার বার ঠিক পথটি দেখাইবার জন্য, কর্মকোলাহলের মধ্যে বিশুদ্ধ সুরটি বরাবর অবিচলিতভাবে ধরিয়া রাখিবার জন্য, এমন এক দলের আবশ্যক, যাহারা যথাসম্ভব কর্ম ও স্বার্থ হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিবেন। তাঁহারাই ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণরাই যথার্থ স্বাধীন...। ধর্মের ও কর্মের সামঞ্জস্য রক্ষা করা এবং মানুষের চিত্ত হইতে কর্মের নাগপাশ সিথিল করিয়া তাহাকে একদিকে সংসার ব্রতপরায়ন, অন্যদিকে মুক্তির অধিকারী করিবার অন্য কোন উপায় ’ত দেখি না। যদি প্রাচ্যভাবেই আমাদের দেশের সমাজ রক্ষা করিতে হয়, যদি ইউরোপীয় প্রণালীতে এই বহুদিনের বৃহৎ সমাজকে আমূল পরিবর্তন করা সম্ভবপর বা বাঞ্ছনীয় না হয়, তবে যথার্থ ব্রাহ্মণ স¤প্রদায়ের একান্ত প্রয়োজন আছে। তাহারা, দরিদ্র হইবেন, পÐিত হইবেন, ধর্মনিষ্ঠ হইবেন, সর্বপ্রকার আশ্রয়-ধর্মের আদর্শ ও আশ্রয়স্বরূপ হইবেন ও গুরু হইবেন।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা একখানা পত্রে (১৩০৯, ৭ই বৈশাখ) বর্ণাশ্রম প্রথাকে সমর্থন করে লেখেন :
“...আমি ব্রাহ্মণ আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্প হৃদয়ে লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। তুমি ক্ষত্রিয় আদর্শকে নিজের মধ্যে অনুভব করিয়া সেই আদর্শকে ক্ষত্রিয় সমাজে প্রচার করিবার সঙ্কল্প হৃদয়ে পোষণ করিও। ব্রাহ্মণের শান্তসমাহিত সাত্তি¡ক ভাবকে তোমার বরণ করিলে চলিবে না। ক্ষাত্রতেজ ক্ষাত্রবীর্য না থাকিলে ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা কোথায়! সমাজে ধর্মের উচ্চতম আদর্শকে সর্বপ্রকার অত্যাচার ও বিঘœ হইতে সুরক্ষিত করিয়া আশ্রয় দিবার জন্যই ক্ষাত্রতেজের মাহাত্ম্য। ...একদিন আমাদের ইতিহাসের একটা বিশেষ অবস্থায় আমাদের সমাজ মানুষের কাহাকেও ব্রাহ্মণ, কাহাকেও ক্ষত্রিয়, কাহাকেও বৈশ্য বা শূদ্র হইতে বলিয়াছিল। আমাদের প্রতি তাহার এই একটা কালোপযোগী দাবি ছিল।” (শিক্ষাবিধি)
হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অকুণ্ঠ। এটা দোষের কিছু নয়, যে কেউ তার ধর্মে আস্থাশীল হয়ে স্বধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি স্বধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং বিধর্মীর প্রতি বিদ্বেষ উদ্গীরণ করে, তবে সেটাকে সমর্থন করা যায় না। এটা সা¤প্রদায়িকতা ও মানবতা-বিরোধী। দুভার্গ্যবশত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এ অনুদার কাজটি করেছেন নিঃসংকোচে। ‘পূজারিণী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন :
“চলেছি করিতে যবন নিপাত
যোগাতে যমের খাদ্য।”
‘রীতিমত নভেলে’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
“বলিতে পার, কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবন সৈন্য প্রচÐ বাত্যাহত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল? কাহার বজ্র, মন্দ্রিত ‘র্হ র্হ বোম’ শব্দে তিন লক্ষ সেøচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল?’ (রীতিমত নভেল)।
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবুর উক্তি :
“ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে, আর মুসলমান বাড়ছে। এইরকম ভাবে চললে এদেশ মুসলমান প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্তান বলাই অন্যায় হবে।”
উপরোক্ত উক্তির দ্বারা রবীন্দ্রনাথ মূলত ইতিহাসের কিছুটা অপব্যাখ্যা করেছেন। ‘সিন্ধু নদ’-এর অববাহিকায় বসবাসকারীদেরকে প্রাচীনকালে আরবগণ ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করেন। সে কারণে কালক্রমে ভারতবর্ষ ‘হিন্দুস্তান’ নামে অভিহিত হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ যাদেরকে ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করেছেন, তারা মূলত বৈদিক ধর্মের অনুসারী। যাই হোক, হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন :
“হিন্দু সমাজকে জাগ্রত হইতে হইবে, কর্তৃত্ব গ্রহণ করিতে হইবে।” (স্বদেশী সমাজের পরিশিষ্ট)
প্রখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবী নীরোদ চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) লিখেছেন, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন হিন্দু ও ইউরোপীয় চিন্তাধারার সমন্বয় সাধনের জন্য। মুসলমানদের চিন্তাচেতনা, ভাবধারা, ঐতিহ্য কখনোই তাঁদের স্পর্শ করেনি। কবিগুরু হিন্দু শক্তির উত্থান হিসেবে শিবাজীর গুণকীর্তন করেছেন। এর একমাত্র কারণ তিনি একজন হিন্দু ছিলেন। শিবাজী সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সুলিভান বলেছেন, শিবাজী ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুণ্ঠক ও হন্তারক দস্যু। শিবাজীর লুণ্ঠন থেকে হিন্দু-মুসলমান কেউই রেহাই পায়নি। মারাঠারা বহু মন্দির ধবংস করেছে, বহু হিন্দু ব্রাহ্মণকে হত্যা করেছে। মারাঠারা যেখানে গেছে সেখানেই ধ্বংস ও ম



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন