Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফুটবল এবং লিও

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রে জা উ র র হ মা ন সো হা গ : এক সময় গ্রিকরা ছিল অন্য সব জাতির চেয়ে এগিয়ে। দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান, সাহিত্য, স্থপত্য বা জ্যোতির্বিদ্যা- প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। তৎকালীন আরো অনেকের মধ্যে দার্শনিক প্লেটো ও সক্রেটিসেরা হলেন এর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। গ্রিক ইতিহাসের যে কোন ছাত্রই এটা জানেন। তবে খুব কম সংখ্যকই জানেন যে, ফুটবলেরও প্রাথমিক যাত্রাটা শুরু হয়েছিল এই গ্রিস থেকেই। এটাকে তখন ডাকা হত এপিসকাইরস নামে। যে খেলায় তারা বল ব্যবহার করত এবং ১২ কিংবা ১৪ জন করে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বলে লাথি মেরে খেলত। যার সাথে আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে বেশি মিল।
এপিসকাইরাস-এর প্রমাণ মেলে গ্রিক নাট্যকার এন্টিফেনাস (খ্রি: পূ: ৩৮৮-৩১১) এর রচনায়। পরবর্তিতে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত¡বিদ ক্লেমেন্ট অব আলেসান্দ্রিয়া (১৫০-২১৫ খ্রি:) তৎকালীন সময়ে এ ধরনের খেলার কথা উল্লেখ করেন। রোমান রাজনীতিবীদ সিসেরোও (খ্রি: পূ: ১০৬-৪৩) একই সময়ে লাথি মেরে বল খেলার কথা উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, ইতিহাসই বলে ফুটবল হলো বিশ্বের অন্যতম প্রচীন একটি খেলা। কিছু কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে আমেরিকায় ফুটবলকে ‘সকার’ নামে ডাকলেও খেলার ধরন ও নিয়মটা একই। বিশ্বের এমন কোন যায়গা নেই যেখানে এই খেলার প্রচলন নেই। যে কারণে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাও এই ফুটবল।
সেই প্রাচীনকাল থেকে ফুটবল খেলার চলন থাকলেও তা আন্তর্জাতিক রুপ পায় কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, মাত্রই একশ’ বছর আগে। বর্তমানের কোপা আমেরিকা হলো সবচেয়ে প্রাচীন আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর। এরও প্রায় দেড় দশক পর বৈশ্বিক রুপ পায় ফুটবল। যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতি ও পেশাদারিত্বের কারণে খেলার ধরণেও এসেছে আমুল পরিবর্তন এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তা হয়ত সংস্কার হবে আরো।
সে যাই হোক না কেন, তাতে যে ফুটবলের প্রতি মানুষের আকর্ষণের ভাটা পড়বে না তা হলফ করে বলা যায়। ছোট্ট পরিসরে হলেও ফুটবলের এই ইতিহাস যে প্রতিটা সাধারণ মানুষই বহন করে বেড়ান বুকে। পেলে, ম্যারাডোনা, জিনেদিন জিদান, জর্জ বেস্টরা ফুটবল ভক্তদের হৃদয়ে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছেন তা তো ফুটবলের ইতিহাসকেই বুকে ধারণ করারই নামান্তর।
এটাও ঠিক, ইতিহাস বড়ই নির্মম। সবাইকে সে মনে রাখে না। সময়ের ভেলায় জীবন নামক ক্ষণিক যাত্রায় যারা নিজেকে ভিন্নভাবে ভিন্নরুপে তুলে ধরতে পারেন, কোন বিশেষ ক্ষেত্রে যিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যানÑ ইতিহাস মনে রাখে শুধু তাদেরই। ব্রাজিলকে তিনটি বিশ্বকাপ এনে দিয়ে কিংবদন্তির আসনে জায়গা পাওয়া পেলে, আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ এনে দেয়া ডিয়াগো ম্যারাডোনা, ফ্রান্সকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ এনে দিয়ে কিংবদন্তি বনে যাওয়া জিনেদিন জিদান তেমনি কয়েকটি নাম। ইতিহাসে যা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।
এ তো গেল ফুটবলের সাম্প্রতিক অতীতের কথা। বর্তমানের ফুটবল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে চলে আসে যার নামটি তিনি হলেনÑ লিওনেল মেসি। এছাড়া ভক্তদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমার, লুইস সুয়ারেজের মত আরো অনেক তারকাও। একটা সময় ছিল ফুটবলে ভালো কোন স্ট্রাইকার তৈরী হলেই তাকে তুলনা করা হতো ম্যারাডোনার সঙ্গে। ম্যারাডোনা পরবর্তী সময়ে এ পর্যন্ত ‘নতুন ম্যারাডোনা’র খেতাব পাওয়া ফুটবলারের সংখ্যা তাই নেহাত কম নয়। বিশ্ব ফুটবলেই নতুন কোন শিল্পীর জন্ম হলেই তাকে তুলনা করা হত ম্যারাডোনা বা পেলের সঙ্গে। নিজেদের ফুটবলকে এমনি শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তর্ক সাপেক্ষে দুই সর্বকালের সেরা এই খেলোয়াড়। আশ্চর্য হলেও এখন কিন্তু আর কেউ পেলে কিংবা ম্যারাডোনা হতে চান না। সময়ের সেরা খেলোয়াড় মেসিতে তারা এতটাই মুগ্ধ তাদের ধ্যান-জ্ঞান কেবল মেসিই কেন্দ্রিক।
ফুটবল মঞ্চে নিজেকে প্রমাণ দিয়েই নিজেকে সর্বকালের সেরাদের কাতারে নিয়ে গেছেন মেসি। অনেকের মতে ফুটবল শৈলীতে পেলে-ম্যারাডোনাকেও ছাড়িয়ে সময়ের সেরা এই খেলোয়াড়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় অর্জনের বিচারে পেলে-ম্যারাডোনারা এগিয়ে ঠিকই, কিন্তু মনমুগ্ধকর ফুটবলের বিচারে ফুটবল বোদ্ধারা এগিয়ে রাখেন মেসিকেই। বল পায়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ভয়ঙ্কর রাজকীয় পদচারণা অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে মেসিকে। অনেকে মেসির সঙ্গে রোনালদোকে তুলনা করতে ভালোবাসেন। কিন্তু এটা ভুলে যান রোনালদো হলেন ‘খুবই উন্নতমানের একজন ফিনিশার’ মাত্র। বলকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কাজে যিনি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু মেসি শুধু তাই নন, তার পায়ে বল গেলে যেন সুর ওঠে কানপুরা কিংবা বেহালায়। কখনো মনে হয় আয়াতকার মাঠকে বিশাল ক্যানভাসে পরিণত করে সেখানে যেন আপন মনে তুলির ছোঁয়া দিয়ে চলেছেন তিনি। আর সেই কীর্তি দেখে ফুটবল ভক্তদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় এমনকি কোচও তখন হয়ে যান একজন বিস্মিত দর্শক। এখানেই রোনালদোর চেয়ে সহস্র গুণ এগিয়ে মেসি।
একসময় মেসির নামের পাশেও জুড়েছিল ‘নতুন ম্যারাডোনা’র তকমা। কিন্তু শুধু এই বিশেষণে যেন স্বাদ মিটছিল না ফুটবলের। প্রকৃতি নিজেই তাই তাকে নামায়ীত করেছেন একের পর এক বিশেষণে। সেই ছোটবেলাতেই নামের পাশে জুটেছিল ‘ক্ষুদে জাদুকরে’র তকমা। পরবর্তীতে তা রূপ নেয় ‘ফুটবল জাদুকরে’। যাকে বলা হত ফুটবলের ‘বিস্ময় বালক’ বড় হয়ে তিনি পেলেন ‘ভিন গ্রহের ফুটবলারে’র খেতাব। ফুটবলকে যারা কাব্যের দৃষ্টিতে দেখতে ভালোবাসেন তাদের কেউ কেউ আবার মেসিকে বলেন ‘ফুটবলের পিকাসো’। আবার তার বিশেষত্ব প্রকাশে কোন বিশেষণই খুঁজে না পেয়ে বলেন, কোন বিশেষণেই তাকে বোঝানো সম্ভব না। ক্ষুদে ফুটবলারদেরও তাই এখন আর কেউ পেলে কিংবা ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করেন না, তুলনা হয় লিওনেল মেসির সঙ্গে।
২৯ বছর বয়সী মেসির পুরো নামÑলিওনেল আন্দ্রেস মেসি। খেলেন ফরোয়ার্ড পজিশনে। তার বাঁ পায়ের ফুটবল দক্ষতা, স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা ও জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্প সকল ফুটবল রোমান্টিকেরই জানা। বিশ্বজুড়ে তাকে নিয়ে এত বেশি সাহিত্য, গল্প, ফিচার রচনা ও গবেষণা করা হয়েছে যা সত্যিই বিরল। এ কারণেই জীবনের প্রথম পর্বে তার হরমোনজনিত সমস্যার কারণে শারীরিক বৃদ্ধি থমকে যাওয়া, সেই অবস্থা থেকে কাটিয়ে উঠতে বার্সেলোনার ভূমিকা, এমনকি ব্যাক্তিগত জীবণে ছোট্টবেলার বান্ধবী অ্যান্তোনেল্লা রোকুজ্জোর সাথে ২০ বছর বয়সে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং পরবর্তীতে দুই পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার মত কোন খবরই কারো অজানা নয়।
ব্যক্তিগত জীবনে জিতেছেন ফুটবলের সম্ভব্য প্রায় সব শিরোপা। কেবল একটি ট্রফিই নেই তার অর্জনের তালিকায়, তা হলÑ জাতীয় দলের হয়ে নেই কোন বিশ্বকাপ। এ নিয়ে অনেক আক্ষেপই শোনা গেছে তার মুখে। তবে এটা ছাড়াও ফুটবলে তার যে অর্জন, যে কোন ফুটবলারের কাছেই একটা স্বপ্ন। ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড টানা চারবারসহ মোট পাঁচবার জিতেছেন বর্ষসেরার খেতাব। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে চারবার জিতেছেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু। এবারো এই পুরস্কার উঠছে তার হাতেই। ক্লাবের হয়ে সতীর্থ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার সাথে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, আটটি লিগসহ মোট শিরোপা জিতেছেন সর্বোচ্চ সংখ্যক, ৩০টি। ক্লাবের হয়ে গোলের প্রায় সকল রেকর্ডই তার দখলে। লা লিগায় এক মৌসুমে ৫০টি, ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে এক মৌসুমে ৭৩টি ও এক বর্ষ পঞ্জিকায় ক্লাব ও আন্তর্জাতিক মিলে ৯১টি গোলের রেকর্ড তার। জাতীয় দলের হয়েও এক মৌসুমে (১২টি) ও মোট সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডও তার (৫৮টি)। সব মিলে ক্যারিয়ারে করেছেন প্রায় ছয়শ’ গোল। এখনো যেভাবে বীরদর্পে মাঠ মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন তাতে কোথায় গিয়ে যে তিনি থামবেন তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে। তাছাড়া খেলোয়াড়ী জীবনের পাশাপাশি ব্যাক্তিগত জীবনেও সফল লিওনেল মেসি। বিশেষ করে তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে নানান রকম নেতিবাচক খবরে যখন গণমাধ্যম সরগম তখন নেহাত ভদ্র বলে এক বাক্যেই সবাই মেনে নেন মেসিকে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে চিকিৎসার বিনিময়ে বার্সা একাডেমিতে নাম লেখান মেসি। এরপর ক্লাবকে দিয়েছেন দুহাত ভরে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সার মূল দলে অভিষেক হয় তার, তখন ২০০৪ সাল। শুরুতে ইনজুরি জর্জর ক্যারিয়ার কাটিয়ে নিজেকে মেলে ধরেন দ্রæতই। ২০০৭ সালে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে মাত্র ২১ বছর বয়সে ব্যালন ডি অর ও ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারের সংক্ষিপ্ত তিনজনের তালিকায় জায়গা করে নেন। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তার তার নৈপূণ্যেই প্রথম ট্রেবল জেতে স্প্যানিশ ফুটবল। সেই বছরই অর্থাৎ মাত্র ২২ বছর বয়সে রেকর্ড ভোট পেয়ে সবচেয়ে কম বয়সে ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জেতেন। পরের তিন বছরও সেই ধরা বজায় রেখে জেতেন টানা চার-চারটি বর্ষসেরা পুরস্কারের ট্রফি। বিশ্ব ফুটবলে যে কীর্তি নেই আর কারোর।
আর্জেন্টিনার হয়েও তার শুরুটা ছিল রাজকীয় ভঙ্গিমায়। যুব বয়সে ফিফা ইয়ুথ টুর্নামেন্টে দলকে চ্যাম্পিয়ন করার পাশাপাশি জেতেন গোল্ডেন বল ও শু দুটোই। অলিম্পিকে জেতেন স্বর্ণ। মূল জাতীয় দলে ২০০৫ সালে অভিষেকের পর ২০০৬ সালে সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে অভিষেক হয় বিশ্বকাপে। সবচেয়ে কম বয়সে দেশের হয়ে বিশ্বকাপে গোলের রেকর্ডও গড়েন সেবার। ২০১১ সালে দলের নেতৃত্বভার পেয়ে তিন তিনটি বৈশ্বিক আসরের ফাইনালে নেন দলকে। কিন্তু ফাইনাল ভাগ্যটা বার বার তার সাথে করেছে উপহাস। ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে অশ্রবদনে তার টুর্নামেন্ট সেরার ট্রফি হাতের সেই দৃশ্য এখনো কাঁদায় মেসি ভক্তদের। তবে ক্লাব ফুটবলে তার প্রাপ্তির বাকি নেই। কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে অপ্রাপ্তিগুলো তাকে পোঁড়ায়। তিনি নিজেই শিকার করেছেন একথা। এমনও বলেছেন ক্যারিয়ারের সকল ট্রফির বিনিময়ে হলেও আর্জেন্টিনার হয়ে একটা শিরোপা জিততে চান তিনি। কে জানে সেটা হয়তো ২০১৮ সালে আসন্ন রাশিয়া বিশ্বকাপেই।
লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন