তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
খা তু নে জা ন্না ত ক ণা : মানুষ সৌন্দর্যপ্রিয়। সুন্দর যা কিছু মানুষকে আকৃষ্ট করে, তার মধ্যে তার নিজের শারীরিক সৌন্দর্যের ভূমিকাও কম নয়। তবে নিজের শারীরিক সৌন্দর্য যতটা না তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে তার ভালোবাসার মানুষ, তার প্রেমিকা বা স্ত্রীর সৌন্দর্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আর এই সৌন্দর্যের অনেকটা জুড়ে আছে ‘চুল’। সাহিত্যে নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় যেমন চুলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, তেমনি পুরুষের সৌন্দর্য প্রসঙ্গে রুক্ষ, এলোমেলো অথবা বাবড়ি দোলানো চুলের কথাও আছে। কাজী নজরুল ইসলামের কথা লিখতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো মহান পুরুষ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’। কখনো কখনো এই চুল, যাকে আমরা কেশও বলে থাকি, এর রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যেমন-
কবি জসীম উদ্দীন তার ‘দেশ’ কবিতায় বলেছেন : ক্ষেতের পরে ক্ষেত চলেছে, ক্ষেতের নাহি শেষ, সবুজ হাওয়ায় দুলছে ও কার এলো মাথার কেশ।
কাজী নজরুল ইসলামের একটি দেশাত্মবোধক গানে এর চমৎকার উপস্থাপন দেখা যায়। ‘কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘবরণ কেশ।
ওরে আমায় নিয়ে যাও রে নদী সেই সে কন্যার দেশ রে।
পরনে তার মেঘ-ডম্বুর উদয়-তারার শাড়ি
ওরে রূপ নিয়ে তার চাঁদ-সুরুজে করে কাড়াকাড়ি রে
আমি তারি লাগি বিবাগী ভাই আমার চির-পথিক বেশ রে।’ শুধু সৌন্দর্য বর্ণনা বা রূপক অর্থেই কাব্য, কবিতায় চুলের প্রসঙ্গ আসেনি। কারো অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গেও চুলকে ব্যবহার করা হয়েছে। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তার একটি কবিতা ‘শুকনো মুখ উস্কোখুস্কো চুল’-এ লিখেছেন : শুকনো মুখ, উস্কোখুস্কো চুল, বিষাদপ্রতিমা
রোজই রাস্তায় দেখি ফুটপাথের হাঁড়িকুড়ি-ছড়ানো সংসারে
শুকনো মুখ উস্কোখুস্কো চুল/শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়া উদ্বাস্তু সংসারে/বিষাদ প্রতিমা...শুকনো মুখ, উস্কোখুস্কো চুল
বিষাদ প্রতিমা হারানো মা,/আমারে কি হারানিধি বলে মনে ধরে!
নায়িকার রূপের পরিপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় আলাওলের কবিতায়। তিনি পদ্মাবতীর চুল, সিঁথি, চোখ, ঠোঁট ইত্যাদির পূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন।
‘পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ/তুলনা দিবার নাহি ত্রিভুবন মাঝ/ আপাদলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ। মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব।।/তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি। বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী।’
এই কয়েকটি লাইনে আলাওল পদ্মাবতীর চুল এবং সিঁথির বর্ণনা দিয়েছেন। পদ্মাবতীর চুল পা পর্যন্ত লম্বা। আর তা মৃগনাভির সৌরভে ভরপুর। তার চুল এতটাই কালো যে, চোখের দৃষ্টি সেখানে পরাজিত হয়। চুলের পরে সিঁথির বর্ণনা- পদ্মাবতীর সিঁথি খুব তীক্ষè। এমনকি তরবারির ফলার চেয়েও তীক্ষè। দেখে মনে হয় যেন কালো মেঘের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ চমক।
কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘বনলতা সেন’ কবিতায় বনলতা সেনের সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’
আমাদের দেশের সাহিত্যে কাব্যে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নারীর সৌন্দর্যের সাথে তার চুলের বর্ণনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের নায়িকারা সম্ভাষিত হচ্ছেন কখনো সুকেশী, কখনো চারুকেশী কখনো বা মুক্তকেশী নামে। আর তাদের চুলের প্রশংসায় শব্দেরই বা ছড়াছড়ি কত রকমের। কুন্তলকলাপ, চিকুরকদম্ব, কেশাবলী, কেশবৃন্দ, চিকুরভার।
পাবলো নেরুদার একটি কবিতা আছে চুল নিয়ে। কবিতার শিরোনাম- ‘তোমার চুলের বর্ণনায় কাটাতে পারি’। আনন্দময়ী মজুমদার কবিতাটির যে ভাবানুবাদ করেছেন, তা নিচে দেয়া হলো-
তোমার চুলের বর্ণনায় কাটাতে পারি তামাম জীবন/আঁকতে পারি এক একটি নিবিড় সুন্দরতা/অন্য প্রেমিক অন্য চোখে দেখে নেয় ভালোবাসার মুখ, তোমার চুলের বিন্যাসে আমি পাই আমার মুগ্ধতা।
ইতালিতে তোমার নাম ওরা রেখেছে মেডুসা, নাগিনীর মতো আউলানো চূর্ণকুন্তল/আমি বলি তরঙ্গময়ী; আমার হৃদয়/খুলতে জানে সে চুলের তাবৎ আগল।/যদি নিজের দুর্ভেদ্য চুলের কোনো জটিল ধাঁধায়/তুমি হারাও বেভুল, তবু ভুলো না প্রেম/কত জাদুময়, কত অপরূপ তোমার চুলের বিস্ময়/আনপথে, নির্জন অন্ধকারে,
মুহূর্তের কান্না ভেঙে সূর্য-রোশনাই / তোমার চুলের মিনারকে যেন সমুজ্জ্বল করে।/ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার গানের কথায় লিখেছেন-
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেবো খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল ।
কণ্ঠে তোমার পরাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা
বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব মেঘ রঙ এলো চুল ।
অর্থাৎ, এখানেও কবি তার প্রিয়ার চুল সাজাতে চেয়েছেন। তাই কাব্য, কবিতা আর গানে ‘চুল’ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে, এটা ধরেই নেয়া যায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।