Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বখতিয়ার খলজি ও আজকের বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৯:১৪ পিএম, ৩ জুন, ২০১৭

মা হ মু দ ই উ সু ফ : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি স্বাধীন অ্যাডভেঞ্চার এবং দুঃসাহসিক অভিযানকারী। এ মহাবীরের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। মাত্র ১৭ জন মুজাহিদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র বিজয় ইতিহাসে এই প্রথম। অদ্যাবধি তার রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। অসাধারণ সমরকৌশল, তী² বুদ্ধিমত্তা এবং ক‚টনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় এ অসাধ্য সাধিত হয়েছিল। চৌকস গোয়েন্দা বাহিনী এ অভিযানে মূল ভ‚মিকা রাখে। ১২০৫ সালের রমজান মাসে সংঘটিত হয়েছিল এই মহাবিপ্লব। সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতি না জানলে বখতিয়ার খলজির নদিয়া ও লাখনৌতি বিজয় অভিযান সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির পয়দা হতে পারে। তাই প্রথমেই আমরা সমসাময়িক ঘটনাবলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করব।
সমকালীন সমাজ
বখতিয়ার আগমনের আগে বাংলাদেশের সার্বিক পরিবেশ ছিল খুবই নাজুক। বর্বরতা আর নোংরামির দাপট সর্বত্র। বাংলাভাষা নির্বাসনে, সাধারণ নাগরিকরা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। নারী নিগ্রহ অতীতের পরিসংখ্যান ভেঙে দেয়। রামপালে বল্লালসেন কর্তৃক আদম শাহ ও তার সাত হাজার মুজাহিদকে হত্যার রেশ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত। উচ্চবিত্তদের আধিপত্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব জায়গায় পয়দা হয় বিশৃঙ্খলার রাজত্ব। ফলে মানবতার পক্ষে একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেই রেনেসাঁ বহন করে নিয়ে আসেন বাঙালির মুক্তির দূত, ইতিহাসের কাÐারি, সিপাহসালার বখতিয়ার খলজি। কিন্তু কেন বাহির থেকে আসা একজন সেনাধ্যক্ষ ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়ক হয়ে রইলেন, সে বিষয়টি জানতে তৎকালীন মানবীয় সঙ্কট ও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
গৌড়রাজ্যের শাসক শশাঙ্ক তার পুরো শাসনামলে বৌদ্ধ নিধনে নিযুক্ত ছিলেন। নামজাদা ভাষাবিজ্ঞানী কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর বলেন, কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছিলো-সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তাদের হত্যা করবে, যে না করবে তার মৃত্যুদÐ হবে (শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পৃ-১২)। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জুলুমবাজ শোষক শশাঙ্ক সম্পর্কে এরপর আর কী বলার থাকতে পারে? ‘বৌদ্ধধর্মকে পরাভ‚ত করে হিন্দুরা যেভাবে বৌদ্ধ-ইতিহাস লোপ করেছিলেন, তা অকথ্য অত্যাচার-লাঞ্ছিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন, ‘বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দগুলো জনসাধারণের ভাষা হতে অন্তর্হিত হয়েছে। যে জনপদে (পূর্ববঙ্গে) এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১ হাজার ৫০০ ভিক্ষু বাস করত, সেখানে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ ৩০ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই।’...হিন্দুরা বৌদ্ধকীর্তি একেবারে লোপ করার জন্য যেখানে-সেখানে তাদের প্রাচীন কীর্তি ছিল, তা মহা-ভারতোক্ত পঞ্চ-পাÐব অথবা আর কোনো হিন্দু রাজ-রাজড়ার সম্পর্কিত এরূপ পরিকল্পনার দ্বারা বৌদ্ধাধিকারের চিহ্নমাত্র লোপ করার চেষ্টা পেয়েছিলেন (ওই; পৃ-১২-১৩)। এ ছাড়া প্রাচীন ভারতীয় রাজা মিহির কুল বা কুমারিল ভট্টের সন্ত্রাস-জাহেলিয়াত কারো অজানা থাকার নয়।
শশাঙ্কের পর প্রায় চার শ’ বছর বাংলায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল পাল বংশ। পাল রাজাদের পরে এগারো শতকে আবার সরকারে আসে শশাঙ্কের উত্তরসূরী সেনবংশ। প্রফেসর ড. এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেন রাজাগণ ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ^াসী এবং এর কঠোর বাস্তবায়নে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিল না।...এ সময় বাংলার সামাজিক জীবনে আমলাতন্ত্রের প্রভাব দারুণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেও পরিবর্তন ঘটেছিল। বর্ণাশ্রম প্রথার কড়াকড়ি প্রয়োগ শুরু হয়। আবার বর্ণে বর্ণে বিভক্তির ফলে সামাজিক জীবনে অসংখ্য বর্ণের উৎপত্তি হয়। প্রধানত পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সামাজিক জীবনকে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি সংস্কৃতির আলোকে সজ্জিত হলো এবং সেন প্রশাসনের উচ্চতর হতে শুরু করে নিম্নতর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন বাংলার সামাজিক কাঠামোতে নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটল। অন্য দিকে বৌদ্ধধর্ম তথা তদীয় সমাজের করুণ অবস্থা শুরু হয়। বৌদ্ধগণ কেউবা স্বদেশ পরিত্যাগ করল অথবা স্বদেশে থেকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদর্শের অন্তরালে নিজেদের অস্তিত্ব কোনোক্রমে টিকিয়ে রাখল। সুতরাং সেন আমল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ হিসেবে গণ্য করা যায়। সমকালীন সময়ে এই যুগের অবদান ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্য সুদৃঢ়করণ। ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যতীত অন্য বর্ণগুলো হলোÑ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র বা সঙ্কর বর্ণের শুদ্র। ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন হিন্দু সমাজকে করেছিল আরো রক্ষণশীল ও সনাতনপন্থী এবং সেই সাথে মানুষে মানুষে পার্থক্য আরো সুচিহ্নিত করেছিল। এর ফলে নিম্নবর্ণের লোক, নারীসমাজ ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ নিপীড়নের শিকার হয়েছিল (ড. এস এম রফিকুল ইসলাম : প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস : সেনযুগ, পৃ-২০৬-২১৪)।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জীবন প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। তাদের ধর্ম ও প্যাগোডা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে। তাদের উপাসনালয় বর্ণহিন্দুদের দখলে চলে যায়। নলিনী নাথ দাশগুপ্ত ‘বাঙ্গালায় বৌদ্ধধর্ম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘পুরীর জগন্নাথ মন্দিরটি একটি পুরাতন বৌদ্ধ মন্দিরের ভিটার উপরই নির্মিত হয়েছে। মন্দির অভ্যন্তরস্থ বিগ্রহদ্বয় বৌদ্ধ ত্রিরতেœর অনুকরণ ব্যতীত অন্য কিছু বলে মনে হয় না। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে যথেষ্ট পাওয়া যায়।’ ভিক্ষু সুনীথানন্দ বলেছেন, ‘হিন্দুসম্প্রদায় রীতিমতো বৌদ্ধভাব, মত, আচার-আচরণ রপ্ত করে বৌদ্ধদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়কে এ দেশীয় ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন’ (ভিক্ষু সুনীথানন্দ : বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃ-৭৭)।
বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের অন্যায় আচরণ, বিদ্বেষ অত্যাচার ইত্যাদি তাদেরকে ভীষণভাবে শঙ্কিত করেছিল। এর প্রমাণ বিভিন্ন তাওয়ারিখে (গ্রন্থে) যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। এই প্রকারের গ্রন্থাবলির মধ্যে ‘শংকর বিজয়’ ও শূন্য পূরাণ অন্যতম। চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত শূন্যপূরাণ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রাহ্মণদের অত্যাচার এতই জঘন্য হয়েছিল, বৌদ্ধেরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকত, শুধু এমন নয়, ব্রাহ্মণেরা সদ্ধর্মসেবীদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের ধ্বংসের দিকেও ঠেলে দিতে দ্বিধা করেনি (নিরঞ্জনের রুষ্মা পরিচ্ছদ, সংগৃহীত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ : বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃ ৭৭)।
নারী-পুরুষে পর্দা, ভদ্রতা, রুচি বা শালীনতা বলতে কিছু ছিল না। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, নগ্নতা, যৌনতা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে দিগি¦দিক। শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, শবর জাতির ন্যায় কেবল বৃক্ষপত্র পরিধান করে এবং সারা গায়ে কাঁদা মেখে, ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাইত এবং তদনুরূপ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করত। জীমৃতবাহন ‘কাল বিবেক’ গ্রন্থে যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করেছেন, বর্তমানকালের রুচি অনুসারে তার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও অসম্ভব (শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলা দেশের ইতিহাস, পৃ-২০২)।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ভারতবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শ্রী অতীন্দ্র মজুমদার তার ‘চর্যাপদ’ কিতাবের চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশ প্রবন্ধে বলেন, ব্রাহ্মণরা ছিলেন সমাজের উচ্চ মঞ্চে, কিন্তু সাধারণ লোকের ভাবনা, ধারণা চিন্তাকর্মের সংস্পর্শের বাইরে। গোটা সমাজ তখন তিনটি বৃহৎ প্রাচীরের দ্বারা বিভক্ত-সবার উপরে ব্রাহ্মণ, মাঝে অগণিত শুদ্র পর্যায়ের সাধারণ লোক আর সবার নিচে সমস্ত রকম সামাজিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত অস্পৃশ্য দীন ও নিরন্তর দুঃখের দহনে দগ্ধ অন্ত্যজ ও মেøচ্ছ সম্প্রদায়।...বাৎসায়ন পরিষ্কারভাবে বলেছেন, গৌড়বঙ্গের রাজান্তঃপুরে মহিলারা নির্লজ্জভাবে ব্রাহ্মণ রাজকর্মচারী ও দাসভৃত্যদের সঙ্গে কামচর্চা, কামষড়যন্ত্র ও কামসম্ভোগ করতেন। তিনি আরো বলেছেন, কামচরিতার্থতার জন্য নগরে এবং গ্রামে বিত্তবানদের ঘরে দাসি রাখা হতো এবং ছিল বাররামা ও দেবদাসী’ (সংগৃহীত, আসকার ইবনে শাইখ, মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা, পৃ-৫১-৫২)। অতীন্দ্র মজুমদারের এ বয়ান একাদশ ও দ্বাদশ শতকের সেন যুগের। বর্তমান বাংলাদেশও কী সেই আমলে ফিরে যাচ্ছে? হাল আমলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অরাজকতা, গুম, খুন, মাৎস্যন্যায়, সেক্স ভায়োলেন্স সেই জননিরাপত্তাহীন অধঃগতির চিত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেই সমাজে নারীরা ছিল শুধুই ভোগ্যপণ্য। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। লেবাসের ক্ষেত্রেও ছিল বিশ্রী প্রক্রিয়া। পুরুষরা ধুতি ও নারীরা শাড়ি পড়ত। তবে ইহা দ্বারা শুধু দেহের নিম্নাংশ আবৃত থাকত। আর ঊর্ধ্বাংশ থাকত খোলা। আজব রুচি! যেখানে নারীরা অর্ধউলঙ্গ থাকে বা উপরি ভাগ অনাবৃত উদোম থাকে, সেখানকার সামাজিক অবস্থার কথা কল্পনা করুন! পুরুষের বহুবিবাহ ও নারীর সহমহরণ প্রথা প্রচলিত ছিল। বৃহদ্ধর্ম পূরাণে বলা হয়েছে, স্ত্রীলোক কখনো স্বাধীন হবে না। পতিসেবাই পরম ধর্ম ও স্বর্গফলদায়ক। নারীগণের একমাত্র পতিই গতি। পতি উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট হলেও তাকে ত্যাগ করা যাবে না। এই বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বাঙালি ইনসানকে বাঁচাতেই বখতিয়ারের পদার্পণ গৌড় বাংলায়। রমা প্রসাদ চন্দ্র তার ‘গৌড় রাজমালা’ কিতাবে বলেন, ‘মহাম্মদ-ই-বখতিয়ারের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্বনাশের মূল বা সর্বনাশের ফল বলে কথিত হতে পারে না। বিজয় সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলে কথিত হতে পারে’ (সংগৃহীত, আসকার ইবনে শাইখ, ওই, পৃ-৫৩)।
বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের মিথ্যা অভিযোগ
নালন্দা মহাবিহার পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি প্রাচীন উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বিহারের পাটনা থেকে ৮৮ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গড়ে তোলা একটি প্রতিষ্ঠান যা পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ খ্রিষ্টীয় শতাব্দির মধ্যে নির্মিত।
এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঠিক সময়কাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই একমত যে রাজা কুমারগুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা মগধে ৪২৭ সালে নালন্দা প্রতিষ্ঠিত হয়। নালন্দা মূলত বৌদ্ধধর্মের গবেষণা ও ধর্মচর্চার জন্য নির্মিত হলেও সেখানে হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত¡, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত¡, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনেক বিষয় পড়ানো হতো। এ বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তথা তিব্বত, চীন, কোরিয়া, গ্রিস, পার্সিয়া, তুরস্ক থেকে বহু শিক্ষার্থীর সমাগম হতো।
২০০৬ সালে চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সহায়তায় মাটিতে চাপা পড়া ধ্বংসস্ত‚প থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। নালন্দাকে উদ্ধারের পর এর ব্যাপ্তি, ভবনগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। ৮০০ বছর পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারো চালু করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রæর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) প্রচÐ রকমের বৌদ্ধবিদ্বেষী মিহিরাকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। তারা নির্মমভাবে বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধররা নালন্দাকে পুনর্গঠন করেন। প্রায় দেড় শতাব্দি পরে আবার এটি ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। মুর্শিদাবাদের শাসক শশাঙ্ক রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস বিরোধে লিপ্ত হন। যার ফলে রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করেন। বুদ্ধের পদচিহ্নকে খÐ-বিখÐ করেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের সফরনামায় শশাঙ্কের সন্ত্রাসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।
বিভিন্ন বøগ, ওয়েবসাইট, খবরের কাগজ ও সোস্যাল মিডিয়ায় মুহাম্মাদ বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ আরোপ করা হয়। তাকে অত্যাচারী, আক্রমণকারী, হিন্দু-বৌদ্ধ নিধনকারী, নালন্দা বিশ^বিদ্যালয় ধ্বংসকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ এগুলো সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, গাঁজাখুরি। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। পূর্বোক্ত ও পরবর্তী আলোচনায় ইটা স্পষ্ট। মানুষ লুণ্ঠন করে স্বর্ণ, রৌপ্য, অর্থকড়ি, টাকাপয়সা। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব মূল্যবান ও দামিও সম্পদ থাকার কথা নয়। তাই নালন্দা বিশ^বিদ্যালয় বা ওদন্তপুরি বিহার লুণ্ঠন করার প্রশ্নই আসে না।
দ্বাদশ শতকে তুর্কি বাহিনীর এক অভিযানের সময় নালন্দা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। (দৈনিক প্রথম আলো, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বিবিসি বাংলা পহেলা সেপ্টেম্বর ২০১৪, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া) বখতিয়ার খলজি ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম আলো, বিবিসি, বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়ার কেন এই মিথ্যাচার? এমনকি ভারতের রাজ্যসভায়ও ২০১৪ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সভায় কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দা বিলুপ্তি নিয়ে বাহাস হয়। করণ সিং অধিবেশনে বখতিয়ার খলজি যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন সেটি উল্লেখ করেন। দুঃখের বিষয়, ইতিহাস এখন ঐতিহাসিক একাডেমিনিসিয়ানদের হাত থেকে রাহাজান হয়ে মতলববাজ রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও হলুদ সাংবাদিকদের দখলে চলে গেছে। এ জন্যই দুনিয়াজুড়ে এত অশান্তি, বিপর্যয়।
দুর্মুখেরা মিনহাজই সিরাজের তবাকাত-ই-নাসিরির সূত্রে নালন্দা ধ্বংসের বিভ্রান্ত তথ্যটি পেশ করে থাকেন। কিন্তু মিনহাজের বয়ানে এ রকম তথ্য নেই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও কথাসাহিত্যিক বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় মিনহাজের বিবরণী ‘বাংলার ইতিহাস’ শীর্ষক কিতাবে তরজমা করেছেন (সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৩-৬)। ঐতিহাসিক মিনহাজের বর্ণনায় বিহার ও নদীয়া জয়ের কাহিনী পাওয়া যায়। নালন্দা অভিযান, নালন্দা জয়, নালন্দা বিশ^বিদ্যালয় ধ্বংসের কোনো ঘটনা বা তথ্য বর্ণিত হয়নি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আবদুল করিমও সহমত। এ দুজন গবেষকই বখতিয়ার খলজির ওপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন (আবদুল করিম : বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, পৃ-৮০-৯০), বাংলার ইতিহাস মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব, পৃ-১৫-২২ এবং সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৩-২৪)। তাছাড়া শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ কিতাবে (পৃ-১০২-১০৬)। মিনহাজের তাওয়ারিখ ও বখতিয়ার সংক্রান্ত তথ্যাবলির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ তিন বরেণ্য মনীষী তাদের কোনো ইতিহাস গ্রন্থে বখতিয়ারের নালন্দায় অভিযানের সত্যতা স্বীকার করেননি। আর সি মজুমদার বলেছেন, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা দেশ জয় সম্বন্ধে যত কাহিনী ও মতবাদ প্রচলিত আছে, তা মিনহাজের বিবরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্বন্ধে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই’ (শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলা দেশের ইতিহাস, পৃ- ১০৪)। পরবর্তীকালের আরো দুটি তাওয়ারিখ (ইতিহাস গ্রন্থ) ইসামি রচিত ফুতুহ-উস-সালাতিন এবং হাসান নিজামি রচিত তাজ-উল-মাসিরেও নালন্দা অভিযানের কোনো ঘটনা নেই। তারপরও বখতিয়ার বিদ্বেষীরা কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তুর্কি মুজাহিদদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন।
ওদন্তপুরী বিহারের বিষয়টা আলাদা। সেখানে শত্রæসৈন্যদের দুর্গ মনে করে ভুলবশত খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। মুয়াররিখ মিনহাজের বয়ানে জানা যায়, বখতিয়ার বিহার দুর্গ আক্রমণ করেন। এ জায়গার বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিল নেড়া মাথা ব্রাহ্মণ। ড. আবদুল করিম ও সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, এটি ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার। যার নাম উদন্তপুর (আবদুল করিম : বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, পৃ-৮২ এবং সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৪)। তবে ড. দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। এ ছাড়া আরো অনেক গবেষক বলেছেন, উদন্তপুর ধ্বংস হয় ১১৯১-৯৩ সময়কালে। অথচ সুখময় মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, বখতিয়ার বিহার বিজয় করেন ১২০৪ সালে (সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-২৪) তাই বখতিয়ার কর্তৃক উদন্তপুর বা ওদন্তপুর বিহার ধ্বংসের কাহিনীও নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। অন্য কেউ সেটা নিশ্চিহ্ন করতে পারে বা দৈব দুর্বিপাকেও পরিত্যক্ত হতে পারে। তাছাড়া সেটা কোনো স্বর্ণভাÐার বা গুপ্তধনকেন্দ্র নয়, সেখানে লুটতরাজ চালাতে হবে। তাছাড়া বই কিতাবাদি বিনষ্টের ঘটনাও নির্ভরযোগ্য নয়। আবার কোনো কোনো গবেষক প্রমাণ করেছেন, সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে।
এতদ্ব্যতীত মুয়াররিখ গোলাম হোসেন সলিম, চার্লস স্টুয়ার্ট, ড. এম আবদুল কাদের, ড. এম এ রহীম, ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, আবদুল জব্বার, মোহাম্মাদ হান্নান, মোহাম্মাদ আবদুল মান্নান, সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ড. মোহাম্মদ আবদুর রহিম, মোহর আলী, ড. মমিন চৌধুরী, ড. এ বি এম মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম, সিরাজ উদদীন আহমদ, ড. কে এম মোহসীন, ড. আসকার ইবনে শাইখ, ড. এম এ আজিজ, এম আর আখতার মুকুল, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ গবেষক বা ঐতিহাসিকরাও কেউ বখতিয়ারের নালন্দা অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করেননি।
তারপরও নালন্দা বিশ^বিদ্যালয় ও তার গ্রন্থরাজি পোড়ানোর কাল্পনিক অভিযোগ কেন দাঁড় করানো হয় বখতিয়ার খলজির নামে? প্রকৃতপক্ষে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদী কারসাজি। মুসলমানদের সন্ত্রাসী জঙ্গি বানানোর অতি প্রাচীন নীতিকে তারা আজও লালন করছে। একই সাথে তাদের প্রতারণা, শঠতা, মিথ্যাচার, বিশ^াসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখছে। এই কাজে কারা জড়িত বা কারা এরূপ নিধনপ্রক্রিয়ায় জড়িত নিচের আলোচনা থেকে বিষয়টি অবহিত হওয়া যাবে। ইসলাম বরাবর সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধ্বংসযজ্ঞের বিপক্ষে। নামজাদা বুদ্ধিজীবী গোপাল হালদার বলেছেন, হিন্দুধর্মের পরিবেশ ভারতবর্ষ। তাই এ ধর্মকে সত্যই ‘ভারতধর্ম’ও বলা চলে। এ দেশের নদ-নদী, গিরিপর্বত, আহার্য পানীয় এবং এর ইতিহাসের উপলব্ধিই হলো সেই হিন্দুধর্মের দেহ ও প্রাণ। ইসলাম দেশগত বা জাতিগত ধর্ম নয়, তা সব মানুষের একমাত্র ধর্ম হইবার স্পর্ধা রাখে।---ইসলাম কোনো জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। উহা অন্যকে জয় করিয়াই ক্ষান্ত হয় না। কোলে টানিয়া লয়। তাই ইসলামের বিজাতীয় ও বিজেতা প্রচারকের দল ভারতের জনগণকে বিন্দুমাত্রও অবজ্ঞা করিল না (গোপাল হালদার : সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃ-১৮০-১৮১)। ইসলামি নীতিতে সব মানুষ সুষম অধিকার ভোগ করবে। সেখানে বেইনসাফির সুযোগ নেই।
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দুদের অনেক অত্যাচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বৃহৎবঙ্গ প্রথম খÐ শীর্ষক কিতাবে লিখেছেন, হিন্দুরা শুধু বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষান্ত হননি, তারা এতকালের সঞ্চিত বৌদ্ধ ভাÐারের সর্বৈব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির উপর স্বীয় নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সর্ববিধ নিজস্ব করে নিয়েছেন। হিন্দুদের পরবর্তী ন্যায়, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদির মধ্যে এ লুণ্ঠন পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে হিন্দুগণ কর্তৃক বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যময় ইতিহাস বিলোপ প্রাপ্ত হয়েছে। এর জন্য হিন্দুগণই একমাত্র দায়ী (সংগৃহীত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ : বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃ-৭৮)। হিন্দুরাই বৌদ্ধকীর্তি নিধনের নায়ক। তারপরও আজ হিন্দু-বৌদ্ধ মিলে বখতিয়ারকে দোষারোপ করছে। যিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এলেন আজ তাকেই খলনায়ক বানাচ্ছে উপকারভোগীরা!
বিশ^বিখ্যাত দার্শনিক মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ-বিপ্লব যখন পর্যুদস্ত হয়ে গেল আর তাতেই হলো ভারতের সমাজে বিশঙ্খলার উৎপত্তি; তখন অগণিত জনসসাধারণ তা থেকে স্বস্তি ও মুক্তির নিঃশ^াস ফেলে বাঁচার জন্য ইসলামের বার্তাকেই জানালো সাদর সম্ভাষণ (এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃ-৮৬-৮৭)। ইসলাম চিরদিন জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকাশের পক্ষে। আল কুরআনে প্রথম আহŸান ইক্র বা পড়। দুনিয়ার সব মহামানবদের মধ্যে ইলম অর্জনকে বা লেখাপড়াকে সর্বাপেক্ষা বেশি উৎসাহিত করছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তাই তাঁর উত্তরাধিকারের পক্ষে বইপুস্তক পোড়ানো বা বিশ^বিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো অসম্ভব ব্যাপার। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান এফ বি ব্রাডলি বার্ট বলেন, ‘প্রাচীন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্ব বাংলার প্রাথমিক যুগও রহস্যের দুর্ভেদ্য অবগুণ্ঠনে আবৃত। মুসলিম অভিযানের পূর্ববর্তী সময়ের যা কিছু জানা যায়, তা উপখ্যান ও লোককাহিনী মাত্র। মুসলমানদের আগে এ দেশে বৌদ্ধ এবং হিন্দুরা বাস করত। তারা ইতিহাস লিখতে জানত না। বংশপঞ্জি সঙ্কলনের মধ্যেই তাদের সাহিত্য-নৈপুণ্য সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। দেশের স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি তারা লিপিবদ্ধ করত না।---কেউ যদি তা করত (ইতিহাস রচনা), তবে নিশ্চয়ই তার লিখিত কাগজপত্রসুদ্ধ তাকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হতো (এফ বি ব্রাডলি বার্ট : প্রাচ্যের রহস্য নগরী, পৃ-১৭-১৮)। বাংলাদেশের আদিম জনসাধারণকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস-দর্শন-চিকিৎসা শিক্ষা দিয়েছেই মুসলমান উস্তাদরা। এখানে জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ বিবেচনায় আনা হয়নি। ভয়ঙ্কর উগ্র মুসলিম বিরোধী ই বি হ্যাভেল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও ‘এরিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার, আর ব্রাহ্মণদের উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইউরোপের পুনর্জাগরণের মতো চিন্তাজগতে এও তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক অত্যদ্ভূত মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এও ছিল আসলে এক পৌঢ় আদর্শ।---এরই ফলে গড়ে উঠল বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা (সংগৃহীত, এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃ-৮৭-৮৮)। বখতিয়ারের বাংলা জয় কোনো উপনিবেশবাদী বিপ্লব ছিল না। এটা ছিল আমজনতার গণবিপ্লবও বটে।

বখতিয়ারের কৃতিত্ব
বখতিয়ার খলজি বাংলা জয়ের পর খুব বেশি দিন এর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেননি। কিছুদিনের মধ্যেই তিব্বত অভিযানে বের হন। তিনি তার অধিনস্তদের হুকুম দেন, আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে মনোযোগ দেন তারা। মোটকথা, একটি স্বাধীন স্বপ্নভ‚মি, আজাদ আবাসভ‚মি সৃষ্টিতে যা যা করা দরকার সব ক্ষেত্রেই তাদের দৃষ্টি পড়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বখতিয়ার খলজি দিল্লি সুলতানের অধীন একটি প্রাদেশিক সরকার লাখনৌতিতে গঠন করেন এবং ক্রমে ক্রমে রাঢ়, গৌড় ও বরেন্দ্র এলাকা দখল করেন। তিনি মগধ ও মিথিলা বিজয় করে বঙ্গে আসেন এবং কামরূপ ও তিব্বতের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন (আবুল মাল আবদুল মুহিত : বাংলাদেশ : জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, পৃ-২৫)।
ড. মোহাম্মদ হাননান বলেন, ‘বখতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযান : বাঙালির ইতিহাসে নতুন ধারার সূচনা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলার এই প্রথম মুসলিম শাসনকর্তা কখনোই অত্যাচারী ছিলেন না। মধ্যযুগের ইতিহাসের জনক বখতিয়ার খলজি নিজের থেকে বাংলার সুলতান উপাধি গ্রহণ করেননি। তবে খলজি বংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আইওয়াজ (১২১৩-২৭) দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ১২ বছর বাংলা শাসন করেন। ফলে তিনি ইতিহাসে লাভ করেন বাংলার প্রথম সুলতানের মর্যাদা। গিয়াস উদ্দিনের এই ক্ষমতা গ্রহণ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে, মধ্যযুগে ভারত ও বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমানদের অভিযান নিছক রাজ্য জয় ছিল না। ছিল সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম অভিযান (ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস, পৃ-৬৭)।
বাঙালাহ নামের দেশ, বাঙালি নামে ভাষা সৃষ্টি, স¦াধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বখতিয়ারের কৃতিত্ব অসাধারণ। ‘অস্পষ্ট পরিচয় এক তুর্কি সন্তান তখনকার শক্তিস্তম্ভ সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি বা দিল্লি প্রধান কুতুব উদ্দিনের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই ইসলাম অনুসারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে যায় এমন এক রাজ্য, গুরুত্বে যা অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে দাঁড়ায় দিল্লি-সালতানাতের ঈর্ষার ব্যাপার। উচ্চতায় খাটো হলেও মুহাম্মাদ বখতিয়ার এমন এক সেনাপতি যার সাহস, উদ্যম ও নেতৃত্বের তুলনা মেলা ভার। রণকৌশলের মতো প্রশাসন দক্ষতায়ও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়, রণক্ষেত্রে দুর্জয় ও রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে অতুলনীয় এই মর্দে মুজাহিদ রাজ্যবাসীর সর্বরকম কল্যাণ সাধনে ছিলেন তৎপর’ (আসকার ইবনে শাইখ, মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা, ৬৫-৬৬)।
মুক্তির প্রতীক বখতিয়ারকে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য ও নির্মূল অভিযানের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে দুই বাহু বাড়িয়ে স্বাগতম জানায়। জনগণ ও সমাজব্যবস্থায় বিভেদ, বিসম্বাদের ফলে আশপাশের কোনো রাজা বা বাংলার প্রজারা নদিয়া-বিক্রমপুরের রাজা ল²ণ সেনকে কোনোপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা করেনি। মুসলিম আগমনে ক্রমে ক্রমে জীবনের ক্লেদ, গøানি, সাংস্কৃতিক পঙ্গুত্ব, ব্রাহ্মণ পূজা, নরবলি, প্রকৃতির উপাসনা ও সীমাহীন ব্যাভিচার, বলাৎকার থেকে রেহাই পায় বনি আদম। বাংলাদেশে এভাবেই হাজির হয় সহসা নতুন ভোর। শুরু হয় নতুন বিপ্লবের পদধ্বনি। দীনেশচন্দ্র সেন ‘বৃহৎবঙ্গ প্রথম খÐ’ কিতাবে স্বভাবতই বলেন, মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল’ (সংগৃহীত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ : বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃ-৭৫)।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মলাভ
হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মকিতাব ঐতরেয় আরণ্যকে বাঙালিরা পিশাচ, ইতর, দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর, মেøচ্ছ হিসেবে আখ্যায়িত। বাংলাবুলিকে আর্য ঋষিরা পক্ষীভাষা হিসেবে প্রতিপন্ন করে। সেন আমলে বাংলা জবানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে সংস্কৃত বুলি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে সরকার। গৃহকোণে বন্দি হয়ে পড়ে বাংলাভাষা। ‘জানিনা কতদিন বাঙ্গবানী জমিয়া ঘরের কোণে লাজুক বধূটির  মতো নিরিবিলি বাস করেছিল। সেদিন বাঙ্গালার অতি স্মরণীয় সুপ্রভাত যেদিন সে সাহিত্যের বিস্তীর্ণ আসরে দেখা দিলো। বাস্তবিক সেদিন বাঙালির এক নবযুগের পূণ্যাহ।---যারা বলেছিলেন : অষ্টাদশা পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব : শ্রæত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। নিশ্চয় তারা বাংলা ভাষাকে আবাহন করে আনেন নাই। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিপক্ষরাই সনাতনপন্থীগণকে বিমোহিত করে বেদমার্গ হতে ভ্রষ্ট করবার জন্যই এই মোহিনী বঙ্গবাণীর সাধনা করেছিল’ (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ : বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খÐ)।
আচার্য শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন তার ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’ প্রবন্ধে বলেন, ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করতেছিল।---হীরা-কয়লা খনির মধ্যে থেকে যেমন জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকিয়ে থেকে যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করে থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল।---বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালা মুসলমানদের মাতৃভাষা (মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, পৃ-১৮-২৯)। এটাই চিরন্তন সত্য। মুসলম শাসনের প্রভাবে বাংলা বুলি ও সাহিত্যে পয়দা হয় রেনেসাঁ। এই নবজাগরণে সৃজিত হয় কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। সুলতানি ও মুঘল আমলে ৪০ জন মুসলিম কবি ও ৩০ জন হিন্দু কবি ধর্মীয় কাব্য, রসপ্রধান কাব্য, বীরগাঁথা, রম্যকাব্য ও মর্সিয়া কাব্য রচনা করেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম-হিন্দুতে কোনো তফাৎ ছিল না।
‘মুসলিম বিজয় ছিল বাংলার প্রতি বিরাট আশির্বাদস্বরূপ। এটা বাংলাভাষী লোকদেরকে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ করে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। কেবল এই বিরাট সংহতি এবং মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার গুণেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি উৎসাহিত হয়। যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকত। তাহলে বাংলাভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো’ (ড. এম এ রহিম : বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাস প্রথম খÐ, ভ‚মিকা, পৃ-৮)। তাই মুসলমানরাই বাঙালি, বাঙালিরাই মুসলমান। আজকের বাংলাদেশ
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সমরবিদ বখতিয়ার খলজি। অবিশ^াস্য হলেও এটাই নির্মম সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাকসনের অরিজোনা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটন বলেন, ১২০৪ সালে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনাটি দিয়েছেন ঐতিহাসিক মিনহাজ উস-সিরাজ। তিনি ওই সময়ের ৪০ বছর পর বাংলা সফর করেন এবং এ সংক্রান্ত প্রচলিত মৌখিক ভাষা ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করেন (রিচার্ড এম ইটন : ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, পৃ-৫৬)। সবারই জানা আছে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয় ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। আজকের বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এ অংশ পাকিস্তানের অংশীভ‚ত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে পয়দা হয় বাংলাদেশ। এখানকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ মুসলিম হওয়ায় আজাদি অর্জন সম্ভব হয়েছে। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে আজও ভারতের প্রদেশ হয়ে থাকতে হতো। এটাই স্বাভাবিক।
এ ক্ষেত্রে প্রখ্যাত ফিল্ম স্টার, নাট্যাভিনেতা আরিফুল হকের বয়ান গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বাংলার মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, যার আগমন না ঘটলে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না, বাংলা মুল্লুকে ইসলামের প্রসার ঘটত না, বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই বিস্ময়কর পুরুষ, রূপকথার রাজপুত্রের মতো তেজোদীপ্ত, অসীম সাহসী, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথিকৃত, যার নাম মালিক বখতিয়ার খলজি।---তিনিই ছিলেন বাংলার মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভ‚মি প্রতিষ্ঠার প্রথম নিশান বরদার। দুই শতাব্দির পরাধীনতার গøানি মোচন করে বাংলাদেশের মুসলমানরা স্বাধীন ভ‚খÐের বাসিন্দা। নানাবিধ ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে উপমহাদেশের ৫৫ হাজার ৮১৩ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে যে স্বাধীন বাঙালি মুসলিম নিবাস নিশ্চিত হয়েছে, যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন রয়েছে তার পথপ্রদর্শক, দিশারি পুরুষ তো ওই মহান সিপাহসালার বখতিয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মহান পথপ্রদর্শকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। বানের পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানার মতো আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের অসংখ্য ভাগিদারদের ভিড়ে বাংলার স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন