Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলের লাখো মানুষ এখনও অরক্ষিত ৮ বছরে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা এলাকাবাসীর

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ

| প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম



আবু হেনা মুক্তি : প্রকৃতি যেন দম মেরে আছে। প্রকৃতির রুদ্র রোষে অতিষ্ঠ জনজীবন। যে কোন মুহুর্তে রুক্ষ রুষ্ট কিংবা প্রলয়ঙ্কারী হতে পারে এই প্রকৃতি। অথচ সুদূর প্রসারী কোন বাস্তবমুখী নতুন প্রকল্প প্রণয়ন হচ্ছে না। তাই উপকুলের বসবাসরত প্রায় ৪ হাজার পরিবারের পুণর্বাসনের ব্যবস্থা আজও সুদূর পরাহত। আর এভাবেই নিরবে নিভৃতে কেটে গেল আইলার ৮টি বছর। যে কোন মুহুর্তে প্রকৃতি এ অঞ্চলে আবারও যে আঘাত হানবে না হলফ করে কেউ বলতে পারে না। মানবাধিকার কর্মীরা তাই এখনই সজাগ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ।
সূত্রমতে, আইলার ক্ষত এখনও শুকায়নি এই জনপদ থেকে। ভিটে মাটি হারানো শত শত পরিবার এখনো রাতে ঘুমের ঘরে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। এ কান্নার যেন শেষ নেই। দেখার যেন কেউ নেই। এখনো খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও বাগেরহাটের শরনখোলা, মংলার শত শত পরিবার গৃহহীন। সরকারের কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফ ও একশো দিনের কর্মসূচি বিভিন্ন সময়ে বাস্তবায়িত হলেও পুণর্বাসনের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে শুভংকরের ফাঁকি। ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় আইলার  তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়েছিল খুলনার কয়রা উপজেলাসহ গোটা দক্ষিণ উপকূলের বিস্তিন্ন জনপদ। আইলার জলোচ্ছসের তান্ডবে উপকূলের শতাধিক মানুষের প্রাণহানিসহ বিলিন হয়েছিল ঘরবাড়ী রাস্তাঘাট দালানকোটাসহ সব কিছু। শতশত বছরের পুরান জনপদগুলির কোন চিহ্নই ছিলনা। আইলার ৮ বছর অতিবাহিত হলেও আজও অরিক্ষিত উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করে
ঘুরে দাড়ানোর মনোবল আর প্রাণশক্তি উপকূলীয়দের সহজাত প্রবণতা। মা মাটি প্রকৃতি যেমন সবকিছু উজাড় করে মানুষকে সহায় করেছে তেমনি প্রকৃতির রুদ্র রোষেও ক্ষতবিক্ষত হতে হয় নিমেষেই। তবু শত বাধা বিপত্তি প্রতিকূলতার মাঝেও লোনা হাওয়ার মানুষগুলো বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখে। সিডরের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় লন্ডভন্ড করে দেয় গোটা উপকূলীয় অঞ্চল। গত ৮ বছরে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে নিজের ঘরে মাথা গোজার ঠাই করেছে কয়েক লাখ পরিবার। অবশ্য এখনো মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। অধিকাংশ বাঁধ মেরামত হলেও বেশকিছু বাঁধ এতো দিনেও পাউবো আটকাতে পারেনি।  তবে সরকার আইলার মানুষের পাশে থেকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা দিয়েছে, করেছে সংগ্রামী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুদীর্ঘ বেদনা বিধুর অধ্যায় আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন থেকে ৮ বছর কেড়ে নিলেও সংগ্রাম মুখর জীবনের অধিকারী কালজয়ী এসকল উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ শত প্রতিকূলতার মাঝেও ঘুরে দাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত মানুষগুলোর জীবনে যেন ভোরের সোনালী সূর্য উঁকি দিচ্ছে। উন্নয়ন বঞ্চিত বৃহত্তর খুলনার মানুষের শেষ ভরসাস্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদন্যতায় সরকার আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কয়েক দফায় শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আইলা দূর্গত এলাকার উন্নয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬শ কোটি টাকার যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল তা এখন শেষের দিকে।
আমাদের কয়রা উপজেলা সংবাদদাতা মোস্তফা শফিকুল ইসলাম জানান, কয়রা উপজেলায় আইলার সময় গুরুত্বপূর্ন ২৮টি পয়েন্টে ভেড়ীবাঁধ ভেঙে গোটা কয়রার পানির নিচে তলিয়ে যায়। বর্তমানে সব কয়টি বাধ আটকানো হয়েছে। তবে আটকানো বাঁধগুলো এখনো দুর্বল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রæতি ছিল সে অনুযায়ী বাধের উচ্চতা হয়নি। যে কারণে প্রতি আমাবশ্য পূর্ণিমার গোনে বিভিন্ন পয়েন্টর বেড়ীবাঁধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি উপছে পড়ায় এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বেড়ীবাঁধ ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। এছাড়া চিংড়িঘের করার কারণে সহস্রাধিক জায়গায় বেড়ীবাঁধ ফুটো করায় তা মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা অবিলম্বে সংস্কার না করা হলে যে কোন মুহুর্তে অঘটন ঘটতে পারে। অপরদিকে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ এখনো ভিটে ছাড়া। গোটা ইউনিয়নটি এখনো বিরান ভূমি রয়েছে। কোন রাস্তাঘাট নেই। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। খোলা মাঠে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
আইলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা স্থায়ী এবং সদূর প্রসারী। ১০ লাখ মানুষের মধ্যে এখনো সবাইকে পুণর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। অবর্ণনীয় কষ্টে রয়েছে তারা। কিছু কিছু গ্রামে এখনো প্রতিদিন জোয়ার ভাটা হচ্ছে। মনে হবে এখানে কোন বসতি ছিল না। নতুন সভ্যতার জন্ম হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়া দুর্গত মানুষ আর ত্রানের দিকে চেয়ে থাকতে চায় না। তারা নিজ বাড়িঘরে আবার ঘর গৃহস্থালী করতে চায়। মাথা উচু করে এ লড়াইয়ে জিততে চায়। কারন উপকূলীয়  অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে।
সূত্রমতে, আজ থেকে ৮ বছর আগে দক্ষিন উপকূলবাসীর জন্য এই দিনটি ছিল অভিশপ্ত। এ দিনটির  কথা মনে করলে ভয়ে শিউরে ওঠে উপকূলবাসী। স্বজন হারানোদের মনে করিয়ে দেয় তাদের প্রিয়জনের কথা, কবর দেওয়ার জায়গা অভাবে অনেকের লাশ শিয়াল কুকুরে ছিড়ে খেয়েছে। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে দূর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকলেও এখনো পর্যন্ত সেই ক্ষতি পুষিয়ে উপকূল এলাকায় গড়ে উঠেনি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিবছর মে মাস এলে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ আতঙ্কে থাকে কোন রকম জোড়া তালি দেয়া পাউবোর বেড়ি বাধের অবস্থা এতই নাজুক যেন তেন দুর্যোগ এলেই বাধ ঘেঙে আবারও বিপদ ঘটাতে পারে। নেই বেড়ি বাধ, নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়স্থলে ছুটে যাওয়ার নেই কোন ব্যাবস্থা। ৮ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি নির্মাণ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। আইলা পরবর্তী কয়রা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন প্রতিশ্রæতির মধ্যে অন্যতম উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বাঁধের পার্শে গাছ লাগিয়ে সবুজবেষ্টনী গোড়ে তোলা  কিন্ত ৮বছর পার হলেও টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয়নি। বিগত ৮ বছরে পাউবোর বরাদ্দ কৃত অর্থের সিংহ ভাগ লুট পাট হয়েছে কতিপয় পাউবো কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা করে ৪/৫ জনের একটি চক্র কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করে প্রক্কলীত ব্যায় কয়েক গুন বেশি দেখিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট করেই চলেছে। ফলে উপকূলীয় এলাকাটিতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছেনা। এলাকাবাসির মনে দুর্যোগ আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। ঘুর্নিঝড় আইলার  ৮ বছর অতিবাহিত হলেও উপজেলার ১৩০ কিঃমিঃ পাউবোর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ, সøুইজ গেট নির্মাণ-পুননির্মাণ, বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়নি। স্থানীয় গ্রামীন অবকাঠামো সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনি এখানেও বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহ ভাগ লোপাট অব্যাহত রয়েছে। অধিকাংশ স্থানে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট রয়েই গেছে। স্যানিটেশন ব্যাবস্থার উন্নতি হলেও জনবল সংকট, দুর্নীতি ও নানা কারনে সাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ১৮০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংষ্কার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। সংষ্কার ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্র ঝুকিপুর্ন হয়ে পড়েছে। এসব কেন্দ্রে মানুষের বসবাস কিম্বা আশ্রয় গ্রহন নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। নির্মানাধীন আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি তাছাড়া নির্মাণাধীন আশ্রয়কেন্দ্র গুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। অতিসত্তর আইলা কবলীত এই এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ-পুননির্মাণ, সংষ্কার ও উপকূলীয় অরক্ষিত বেড়িবাধ দ্রæত মেরামত করে ও পাউবোর বাধ থেকে অবৈধ পাইপ গেট তুলে দিয়ে উপকূলবাসীকে দুর্যোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী। খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের এমপি অ্যাডভোকেট শেখ মো: নুরুল হক বলেন, আইলার প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ের পরে বেড়িবাঁধগুলো যেভাবে সংষ্কার হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উপকূল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ