Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় জমজমাট মদ-মাদকের আসর

রহস্যজনক কারণে নীরব সংশ্লিষ্ট প্রশাসন

| প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


বিশেষ সংবাদদাতা : রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রাইভেট পার্টি, প্যান্স পার্টি, জিকে পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে জমজমাট বিদেশি মদ ও মাদকের আসর সমানে চলছে। হোটেল রোস্তারাঁ, ক্লাব, বার ছাপিয়ে এখন বাসা-বাড়িতেও প্রকাশ্যে এসব চললেও রহস্যজনক কারণে নীরব সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, তাদের সন্তান, শোবিজ জগতের অনেকেই এসব পার্টির আড়ালে রাতভর ফুর্তিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকলেও এসব বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের রহস্যজনক নীরবতায় দিন দিন এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে করে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এবং তাদের সন্তানেরা দিন দিন অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে অবৈধ বিদেশি মদসহ মাদকের জমজমাট ব্যবসা। কয়েকদিন আগে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ম্যানেজারের কক্ষ থেকে হালকা মাত্রার কয়েক বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, একজন বিদেশি নাগরিকের কক্ষে মদ থাকা কোনো অপরাধের মধ্যে পড়ে না। অথচ গুলশান-বনানীর হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাব, বার এমনকি বাসা বাড়িতেও প্রকাশ্যে বিদেশি মদসহ মাদকের আসর বসছে। শুল্ক গোয়েন্দারা গত দুই সপ্তাহে সেগুলোতে কোনো অভিযান চালিয়েছে এমন নজির নেই। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন হোটেল ও বাসা বাড়িতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের প্রবীন শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্যাহ ইনকিলাবকে বলেন, শুধুমাত্র অভিজাত এলাকাই নয়, সারাদেশেই এখন মাদকের নৈরাজ্য অবস্থা বিরাজ করছে। বলতে হয় মাদকের মহোৎসব চলছে। তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যে পরিমাণ কাজ করছে তার ১০ গুণ বেশি কাজ করা দরকার। আর শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগ যাকে ইচ্ছে করে তাকে ধরে, ইচ্ছে না হলে ধরে না। আমার মনে হয়, তাদের গোয়েন্দা বিভাগ এতোকিছু জানেও না। এভাবে আর চলতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এক বছরে শুধুমাত্র ইয়াবা বেচাকেনা হয়  ১৬ হাজার কোটি টাকা মানে দুই বিলিয়ন ডলার। তাহলে বাকী মাদকগুলো মিলে কতো হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।  
রাজধানীর কুটনৈতিক পাড়ার নিñিদ্র নিরাপত্তার নানা আয়োজনের মধ্যেও গুলশান-বনানীর অপরাধ অপকর্ম থামছেই না। আগে রেষ্ট হাউসের আড়ালে চলতো মদ, জুয়া ও অসামাজিক কার্যকালাপ। এখন তা ছাপিয়ে বাসা-বাড়িতে ঢুকে গেছে। প্রভাবশালী ও উচ্চবিত্তরা তাদের ফ্ল্যাট-এ্যাপার্টমেন্টে রাতের আসর বসাচ্ছেন। যেসব আসরের নিয়মিত অতিথি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বিত্তবান ব্যবসায়ী, তাদের সন্তান-স্বজন এমনকি শো-বিজ জগতের কথিত ভিআইপিরা। মধ্যরাতের আয়োজনে প্রকাশ্যে বিদেশি মদ, ইয়াবার সাথে সুন্দরী রমনীও থাকে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অপকর্ম চললেও তারাও যেন এক প্রকার নির্বিকার। লোক দেখানো দু’একটি অভিযান চললেও পরে অজ্ঞাত কারণে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলশানের ৪৩ নম্বর রোডে প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার ছেলের নেতৃত্বে গড়ে উঠে সীসা হাউজ। সেখানে প্রতি সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সীসাসহ নানারকম মাদক সেবনের পাশাপাশি চলে তরুণ-তরুণিদের উদ্যম নৃত্য, হৈচৈ, বেলেল্লাপনা। গত তিন বছর ধরে বাধাহীনভাবে এ নেশার আখড়া চলছে দাপটের সঙ্গেই। বিতর্কিত ওই  নেতার পুত্রের সঙ্গেই যোগসাজস গড়ে উঠে সাবেক এক মন্ত্রীর চাচাতো ভাই ও আরেক মন্ত্রীর গুণধর পুত্রের। তারা সীসা হাউজের পাশাপাশি ইয়াবা কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। তিন বন্ধু মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মংডুতে স্থাপিত ইয়াবা কারখানার কারিগর মোসলেমকে এনে গুলশানের কারখানা বসানোর ব্যবস্থা করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক সময়ের হুক্কাই এখন সীসা হিসাবে ব্যবহার করা হয় অভিজাত এলাকায়। সীসার আড়ালে চলে বিদেশি মদ ও ইয়াবার আসর। সাথে নারী তো আছেই। এসব আসরে শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগ কখনও অভিযান চালিয়ে এমনটা শোনা যায় না। আলাপকালে সীসা হাউজে প্রায়ই যাতায়াত করেন এমন এক ব্যবসায়ী জানান, শুল্ক ও গোয়েন্দারা এসবের খবর জানে না তা বলা যাব না। কি কারণে তারা অভিযান চালায় না সেটা তারাই ভালো জানে। তবে অভিযান না চালানোর পেছনে একটা ‘সমঝোতা’ আছে বলেই মনে হয়। তা না হলে মানুষ  ওই সব আসরে যাবে কেনো? নিরাপদ জেনেই তো সবাই যায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীতে মাদক ব্যবসায়িদের তালিকা তৈরি করা হয়। এতে পেশাদার হিসেবে সাড়ে তিন হাজার মাদক ব্যবসায়ির নাম উল্লেখ থাকলেও তার মধ্যে অন্তত ৭শ’ জনই ক্ষমতাসীন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মির নাম রয়েছে। এ কারণে মাদক নির্মূল করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে স্থানীয় প্রসাশনকে। ঢাকা মহানগর মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং সরকারি দলের লোকজনের মদদে অনেক স্থানে মাদক ব্যবসা চলছে। এ কারণে অনেক সময় মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশানের ৪৩ নম্বর রোডসহ কয়েকটি এলকায় অনুমোদনহীন বার চলছে প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছেলের নামে।
জানা গেছে, গুলশান- ২ এর ক্যাপিটাল ক্লাবসহ, কোর্নিয়া ক্লাব, লেক ভিউ, লেক ডিপ্লোমা, ফু-ওয়াং, কোরিয়ান ক্লাব এবং কেএনবিতে প্রতিরাতেই মদ জুয়ার আসর বসে। এর বাইরে অন্তত অর্ধশতাধিক রেষ্ট হাউস- গেষ্ট হাউসের আড়ালে চলছে নানা ধরনের অপকর্ম। হলিডে ইন, লিভার ডোর, কোয়ালিটি ইন, গার্ডেন ইন, বোনভিটা ইন, ইষ্টার্ন রেসিডেন্স, ডি ক্যাসল, স্কাই পার্ক, ম্যারিনো, লোরেল, ফুজি ইন, পিনাকল-বাহারি নামের অসংখ্য গেস্ট হাউজে কোন ব্রান্ডের মদ মেলে না। অথচ এসব গেস্ট হাউসে শুল্ক ও গোয়েন্দারা অভিযান চালায় না। তারা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে। জানতে চাইলে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি মদের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব শুল্ক কর্তৃপক্ষের। আবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও দেখতে পারে। পুলিশ সরাসরি এসবে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এসব অপকর্ম কিভাবে বন্ধ করা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রবীণ সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্যাহ বলেন, সমাজতাত্মিক ধারায় এসব অপকর্মের সাথে সমাজের প্রভাবশালী, রাজনীতিবিদ, ধনী, ক্ষমতাধর মানুষ এবং তাদের সন্তানেরা জড়িত হয়ে পড়েছে। সে কারণেই প্রশাসন চাইলেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।  তিনি বলেন, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তারা এটাকে কিভাবে দেখছেন- সেটাই হলো বিষয়। তারা চাইলে এভাবেই চলবে, না চাইলে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদক

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ