Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গতি বেড়েছে সেবা বাড়েনি

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল ভ্রমণ

প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১১ এএম, ২২ মে, ২০১৭



রফিকুল ইসলাম সেলিম : কমলাপুর স্টেশন থেকে সকাল পৌনে ৮টায় ছেড়ে আসা ‘মহানগর প্রভাতী’ ঠিক ২টায় চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে থামে। এ দীর্ঘপথে ৮টি স্টেশনে যাত্রী উঠা নামার পরও মাত্র ৬ ঘন্টায় গন্তব্যে পৌঁছে আন্ত:নগর ট্রেনটি। স্বল্প সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতে পেরেও তেমন খুশি নয় যাত্রীরা। কারণ পথে তাদের চরম বিড়ম্বনা আর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ - রেলে গতি এলেও যাত্রী সেবার মান বাড়েনি। টিকিট ছাড়া অতিরিক্ত যাত্রীর ভিড়, হকারদের হাক-ডাক, স্টেশনগুলোতে চরম বিশৃঙ্খলায় যাত্রীদের দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। আছে পকেটমার, চোর, মাদকাসক্ত ও হিজড়াদের উৎপাতও। গতকাল ওই আন্ত:নগর ট্রেনে ভ্রমণ করে যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে আন্ত:নগর মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি তূর্ণা নিশিথা নামে রাত ১১টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। পরদিন সেটি প্রভাতী হিসাবে ফের চট্টগ্রাম আসে। এই প্রতিবেদক শুক্রবার রাতে ওই ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যান। সম্প্রতি বিদেশ থেকে আনা লাল-সবুজের এই ট্রেনের সৌন্দর্য্য ¤øান হতে চলেছে নানা অব্যবস্থাপনায়। যাত্রীরা বলছেন, ট্রেনের ভেতরে যাত্রীদের ভিড় ঠেলে উঠা হকার, ভিক্ষুক আর হিজড়াদের উৎপাত নিত্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আছে টানা পার্টি ও পকেটমারের উপদ্রপ। শোভন শ্রেণির পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচেও চলে তাদের দৌরাত্ম্য।
ট্রেনটি যথাসময়ে কমলাপুর থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার আগেই তাতে বিপুল সংখ্যক টিকিটছাড়া যাত্রী উঠে পড়তে দেখা যায়। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেন থামতেই ওইসব যাত্রীরা দ্রæত নেমে পড়ে। সেখানে অপেক্ষমান যাত্রীদের পাশাপাশি টিকিট ছাড়াই আবার অনেকে ট্রেনে উঠে পড়েন। যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে ট্রেনের প্রায় প্রতিটি বগিতে উঠে পড়ে বিপুল সংখ্যক হকার। যত স্টেশনে ট্রেন থেমেছে ফেনী ছাড়া প্রায় প্রতিটি স্টেশন থেকে অতিরিক্ত যাত্রীদের সাথে উঠেছে বিপুল সংখ্যক হকার। কি নেই হকারদের কাছে- কলা, লিচু, আম, ডাব, কোমল পানীয়-পানির বোতল, সিদ্ধ ডিম, সিঙ্গারা, চমুছা থেকে শুরু করে আতর সুরমা, বইপুস্তক, গামছা, লুঙ্গি, রুমাল প্লাস্টিক সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।
এমনিতে যাত্রীদের ভিড় তার উপর বিপুল সংখ্যক হকারের জিনিসপত্র ফেরি করে হাকডাক শোর চিৎকারে মনে হচ্ছিল এটি ট্রেন নয় যেন স্টেশন। প্রতিটি আসনে যাত্রী, আছে যাত্রীদের মালামাল। আসন ছাড়া টিকিটের যাত্রীর চেয়ে বেশি বিনা টিকিটে যাত্রী। এসব যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে আসন ধরে, অনেকেই টয়লেটের সামনে ও দুই বগির মাঝখানে ফাঁকাস্থানেও দাঁড়িয়ে বসে ভ্রমণ করছে। প্রতিটি কোচে প্রচন্ড ভিড়, পা ফেলার সুযোগ নেই। এরমধ্যে মাথায় ও কাঁধে হরেক পণ্যের পসরা নিয়ে উঠে পড়ছে হকারের দল। কেউ কিছু কিনুক না কিনুক প্রতিযোগিতা দিয়ে চলছে হকারদের শোর চিৎকার হাকডাক। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোচেও আছে তাদের উৎপাত।
একেকটি স্টেশনে ট্রেন থামার সাথে সাথে জানালা দিয়ে পণ্যের পসরা ঢুকিয়ে দিচ্ছে হকার। ভিক্ষুক ও মাদকাসক্তরা যাত্রীদের গায়ে হাত দিয়ে ভিক্ষা চাইছে। ভিড়ের মধ্যে উঠে পড়ছে হিজড়ার দল। যাত্রীদের ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে এক কোচ থেকে অন্য কোচে গিয়ে সাহায্য চাইছে তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে দেখা গেল উৎকট সাজে এক তরুণী আর্থিক সাহায্য চাইছে। তাকে কয়েকজন যুবক যাত্রীর গায়ে লজ্জাজনকভাবে ঢলে পড়তেও দেখা যায়। এতে বিব্রত হন যাত্রীরা।
টিকিট ছাড়া যাত্রীদের ধরতে রেল কর্মকর্তাদের তৎপরতাও চোখে পড়ছে। লাকসাম স্টেশন থেকে চট্টগ্রামে আসার উদ্দেশে এক যুবক তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে উঠে পড়ে। টিকিট না পেয়ে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। এভাবে বেশ কয়েকজন যাত্রীকে বিনাটিকিটে ভ্রমণ করায় জরিমানা আদায় করা হয়। রেলের একজন টিএ (টিকিট এক্সামিনার) বলেন, যারা নিয়মিত বিনাটিকিটে ভ্রমণ করে তাদের ধরা কঠিন। কারণ টিএ দেখলে এরা হাঁটতে শুরু করে। হকার আর যাত্রীদের ভিড়ে মিশে যায় কিংবা টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। যাদের পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। অনেকের কাছ থেকে শুধুমাত্র ভাড়া আদায় করে সতর্ক করা হয় বলে জানান ওই টিএ। কসবা স্টেশনের কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ ট্রেনটি থেমে যায়। এ সময় অনেক যাত্রীকে ট্রেন থেকে নেমে দ্রæত চলে যেতে দেখা যায়। জানা গেছে, প্রায় এমন ঘটনা ঘটে।
একটি সংস্থাকে ট্রেনে খাবার সরবরাহ করার দায়িত্ব দেয়ার পরও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দলে দলে হকার কেন উঠছে এর জবাব টিএ, রেল পুলিশ, রেল নিরাপত্তা কর্মী কেউই দিতে চান না। ওই সংস্থার কর্মীরা বলেন, আমরা তাদের বাধা দিতে পারি না। একজন টিএ বলেন, এসব হকারদের সাথে স্টেশন মাস্টারদের যোগাযোগ রয়েছে। স্টেশনে ট্রেন থামতেই তারা দলে দলে ট্রেনে উঠে পড়ছে। এদের নামানোর ক্ষমতা রেলে দায়িত্বরত কর্মীদের নেই। তাদের বাধা দিলে পরদিন ওই স্টেশনে ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর মারা হবে। দীর্ঘদিনের এ সিন্ডিকেট ভাঙা সহজ নয় বলেও উল্লেখ করে তিনি।  
যাত্রী আর হকারদের ভিড়ের মধ্যেই ঢুকে পড়ছে পকেটমার, ছিনতাইকারী ও টানা পার্টির সদস্যরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্যাসফিল্ড কোম্পানীর সাবেক কর্মকর্তা ট্রেন যাত্রী দিলীপ কুমার দাশ বলেন, কয়েকদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠার সময় তার মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা দিলীপ কুমার বলেন, নিয়মিত তিনি আন্তঃনগর ট্রেনে ভ্রমণ করেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্টেশনে পকেটমারের ঘটনা ঘটে। কয়েকদিন আগে তার অফিস থেকে দেয়া বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা তার এক নিকটাত্মীয় ও পরিবারের এক সদস্যের ৫০ হাজার টাকা এবং একটি স্বর্ণের চেইন ছিনতাই হয় বলে জানান তিনি।
যাত্রীরা জানান, স্টেশনে ট্রেন থামতেই কিছু যাত্রী নামে আবার কিছু যাত্রী উঠার চেষ্টা করেন। এ ভিড়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক হকারও ট্রেনে উঠতে যায়। এ সুযোগে পকেটমার ও ছিনতাইকারীরা লোকজনের মালামাল কেড়ে নেয়। ট্রেনের ভেতরও চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবার রাতে তূর্ণা নিশিথার ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কোচের এক যাত্রীর মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে যায়। মধ্যরাতে ওই কোচে লাইট জ্বলছিল, এ অবস্থায় অসংখ্য যাত্রীর সামনে তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি হাওয়া হয়ে যায়।
বর্তমান সরকারের সময়ে রেলের উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন লাইনে নতুন নতুন ট্রেন যুক্ত হয়েছে। রেলপথের উন্নয়ন হওয়ায় ট্রেনের গতি বেড়েছে। অত্যাধুনিক বিলাসবহুল ট্রেন চলছে বিভিন্ন লাইনে। যাত্রীরা বলছেন, রেলের উন্নতি হলেও রেলস্টেশন কেন্দ্রিক পুরনো সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন হয়নি। লক্কর-ঝক্কর কিংবা লোকাল ট্রেনে যেভাবে হকার আর বিনা টিকিটের যাত্রী উঠে ঠিক একইভাবে বিলাসবহুল ট্রেনেও তারা উঠে পড়ছে। এ কারণে যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ বিঘিœত হচ্ছে



 

Show all comments
  • আসমা ২২ মে, ২০১৭, ৩:৪৬ এএম says : 0
    রেলের সেবার মান বাড়াতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Rezaul Islam (Salim) ২২ মে, ২০১৭, ১০:০৩ এএম says : 0
    Always thanks to Inqilab for reporting the BD Railway. I want to know the Bogra-Sirajgonj rail line.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ