Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধোঁয়াশার স্বর্ণের বাজার

চোরাই পথে আনা স্বর্ণে জমজমাট ব্যবসা : চোরাচালানে স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা জড়িত

| প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম



আপন জুয়েলার্সের মতো আরও যেসব নামকরা জুয়েলারী প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতেও  শুল্ক ও গোয়েন্দাদের অভিযান চালানো উচিত : এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান
বিশেষ সংবাদদাতা : চোরাই পথে আনা স্বর্ণ দিয়ে চলছে জুয়েলারী ব্যবসা। বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতেই এ আয়োজন। অভিযোগ রয়েছে, চোরচালানের সাথে জড়িত স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ শুল্ক বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। আপন জুয়েলার্সের মালিকদেরকে গত বুধবার জিজ্ঞাসাবাদের পর শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, জব্দকৃত ৪৯৮ কেজি স্বর্ণালঙ্কারের বিপরীতে কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেন নি তারা। তাতে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়, সেগুলো চোরাই পথে আনা। আপন জুয়েলার্স সম্পর্কে শুল্ক কর্তৃপক্ষের এই মন্তব্যের পর পুরো স্বর্ণের বাজার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন- এক আপন জুয়েলার্সের ক্ষেত্রে যদি এই অবস্থা হয় তবে বাকীগুলোতে কেনো অভিযান চালানো হচ্ছে না। শুধুমাত্র আপন জুয়েলার্সই কী কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করছে? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, একটা ভাত টিপলে যেমন সবগুলোর অবস্থা জানা যায়, ঠিক তেমনি এক আপন জুয়েলার্সের অবস্থা বিচার করলে বাকীগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আপন জুয়েলার্সের শো-রুমে অভিযান চালানো হলো।
যারা অভিযান চালালেন তারা কি আগে থেকে আপন জুয়েলার্সের এই অবৈধ পন্থা সম্পর্কে জানতেন না? এনবিআর এর সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, শুধু স্বর্ণ নয়, সব সেক্টরেই এরকম অনেক কাহিনী আছে। কেউ ফর্মে থাকলে তার খবর কেউ রাখে না। আবার কেউ একটা সঙ্কটে পড়লে তার সবকিছু নিয়ে টানাটানি শুরু হয়।
গত বুধবার আপন জুয়েলার্সের তিন মালিককে (তিন সহোদর) জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, আপন জুয়েলার্স থেকে জব্দ করা ৪৯৮ কেজি (প্রায় সাড়ে ১২ মণ) স্বর্ণের মধ্যে এক কেজিরও কোনো বৈধ কাগজ দেখাতে পারেনি মালিক কর্তৃপক্ষ। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ডার্টি মানি ও স্বর্ণ-ডায়মন্ড চোরাচালানের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু আপন জুয়েলার্স নয়, ঢাকার আরও নামীদামী জুয়েলারী প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশেই চোরাই পথে আনা স্বর্ণের ব্যবসা জমজমাট। জুয়েলারী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় ১০ হাজারের মতো স্বর্ণের দোকান আছে। আর শুল্ক ও গোয়েন্দা সূত্র দাবি করছে, দেশে গত চার বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে বৈধভাবে কোনো স্বর্ণ আমদানী হয়নি। কিন্তু তারপরেও এত হাজার-হাজার দোকানে স্বর্ণের ব্যবসা চলছে কীভাবে? স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ভেতরে মানুষজন যেসব পুরনো স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে সেগুলো ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে একটা বড় জোগান আসে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসার সময় একজন যাত্রী শুল্ক ছাড়াই ১শ’ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ আনতে পারেন। এগুলোই হাত বদল হয়ে জুয়েলারী দোকানগুলোতে আসে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর কিংবা বিভিন্ন চোরাই পথে বিপুল পরিমান স্বর্ণ আসছে। এর মধ্যে কিছু স্বর্ণ ধরা পড়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের হাতে। ধরা পড়ার ফাঁকে পাচার হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ। সূত্র জানায়, ধরা পড়া স্বর্ণের পরিমাণের চেয়ে পাচার হয়ে যাওয়া স্বর্ণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের মধ্যবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ চোরাচালান রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তাই ঝুঁকি অনেক। শুল্ক গোয়েন্দারা যা আটক করছে তা মূল চোরাচালানের মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আর বাকি ৮০ শতাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের এক হিসাবে দেখা যায়, তিন বছরে তাদের অভিযানে প্রায় ৩ হাজার ৯শ’ কেজি স্বর্ণ আটক হয়েছে। যার মূল্য প্রায় এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এ হিসাবে যে পরিমাণ স্বর্ণ পাচার হয়ে গেছে তার অঙ্ক কয়েক হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু চোরচালানের মাধ্যমে নয়, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই এবং জুয়েলারী দোকানে থেকে লুট হওয়া স্বর্ণগুলো রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু স্পট, বাজার ও দোকানে বেচাকেনা হয় প্রকাশ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার ও তাঁতিবাজার। সূত্র জানায়,  চোরাই স্বর্ণের একটা বিরাট বাজার রয়েছে বায়তুল মোকাররম মার্কেটেও। এই মার্কেটের অনেক নামীদামী জুয়েলারীর মালিকও চোরাকারবারীর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়,  চোরাই পথে আনা এবং ডাকাতি- চুরি হওয়ার স্বর্ণগুলো জুয়েলারীর মালিকরা কম দামে কিনে তাদের নিজস্ব কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যনতুন ডিজাইনের অলঙ্কার তৈরী করে বিক্রি করে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, রাজধানীতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চোরাই স্বর্ণের বেচাকেনা হয়। এসব চোরাই স্বর্ণের সাথে নামীদামী জুয়েলারীর মালিক জড়িত। তবে উপর মহলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলায় তারা যুগ যুগ ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। গত বছর ওয়ারী থানা পুলিশ পুরান ঢাকার গোয়ালানগর এলাকা থেকে ২ কেজি ৪শ’ গ্রাম ওজনের ২২টি স্বর্ণের বারসহ কমল দাস নামে একজনকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে কমল দাস পুলিশকে জানায়, স্বর্ণগুলোর মালিক কণিকা জুয়েলারীর স্বত্তাধিকারী  সঞ্চয় পোদ্দার। কমল ওই দোকানের কর্মচারী।
তাঁতীবাজারে স্বর্ণের কারখানায় কাজ করেন (কারিগর) এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চোরাই পথে আনা স্বর্ণ দিয়েই অধিকাংশ কারখানা চলে। চোরাই পথে স্বর্ণের বারগুলো হাত ঘুরে চলে আসে ঢাকার নামীদামী জুয়েলারীগুলোতে। জুয়েলারী মালিকরা এসব স্বর্ণ তাদের কারখানায় কারিগর দিয়ে অলংকার তৈরি করে বিভিন্ন শো-রুমে সাজিয়ে রেখে বিক্রি করেন। একাধিক সূত্র জানায়, পুরান ঢাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে, যারা লুণ্ঠিত স্বর্ণালঙ্কার অল্প দামে কিনে সাথে সাথে তা গলিয়ে ফেলে। এতে করে এগুলোর মালিকানা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।  চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা করে পুরান ঢাকার অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ডাকাত দল, চোর ও ছিনতাইদের সাথে এসব ব্যবসায়ী নিবিড় সর্ম্পক রয়েছে । এদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকও আছেন। যারা প্রতিনিয়ত ভারত আসা যাওয়া করেন।
অভিযোগ রয়েছে, স্বর্ণ চোরাইকারবারি এবং জুয়েলারী মালিকদের সাথে একশ্রেণির অসাধু শুল্ক কর্মকর্তার যোগসাজ্য রয়েছে। অসাধু শুল্ক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা স্বর্ণ পাচার থেকে শুরু করে সেগুলো দিয়ে অলঙ্কার তৈরী করে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছে। সচেতন মহলের মতে, বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজার পুরোটাই অস্বচ্ছ। আর এ অস্বচ্ছতার জন্য শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষই দায়ী। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ইনকিলাবকে বলেন, স্বর্ণের বাজারে কাগজে-কলমে অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা বেশি। যারা এগুলো দেখার দায়িত্বে আছেন তারাও বেশ স্পর্শকাতর। এই অস্বচ্ছতা, অষ্পষ্টতা  দূর করার জন্য আপন জুয়েলার্সের মতো আরও যেসব নামকরা জুয়েলারী প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতেও শুল্ক ও গোয়েন্দাদের অভিযান চালানো উচিত।



 

Show all comments
  • রবিউল ১৯ মে, ২০১৭, ১২:৩৬ পিএম says : 0
    সকল অবৈধ ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বর্ণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ