মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
আবুল কাসেম হায়দার : পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। পর্যটনে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৫ নম্বরে। এমনকি পাকিস্তানও এক ধাপ ওপরে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাত নিয়ে এমন হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডবিøউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগিতা সূচক ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। পর্যটক আকর্ষণে একটি দেশ কতটা নিরাপদ, অবকাঠামো সুবিধা কেমন, বিমানবন্দর কতটা উন্নত, আবাসন ব্যবস্থার মান কেমন। এমন ১৪টি বিষয় বা সূচকের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি সূচকে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৭, আর সর্বনিম্ন নম্বর ১। একেকটি সূচকে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে একটি দেশের সার্বিক নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ক্রমণতালিকা করা হয়েছে।
বিশ্বের ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্প নিয়ে ডবিøউইএফ প্রতি দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৭। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাংলাদেশে ব্যবসা আছে এবং ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে দেশি-বিদেশি এমন ৮৭ কোম্পানির নির্বাহীদের মতামত এ প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়েছে। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে যে ধরনের ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা দরকার, বাংলাদেশে সেটির বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। শ্রেণি অনুযায়ী পর্যটক আকর্ষণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই। পর্যটনে বাংলাদেশের এসব ঘাটতিই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের ১ নম্বর দেশ হলো স্পেন। দেশটির স্কোর হলো ৫ দশমিক ৪৩। আর ১২৫ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ২ দশমিক ৯। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও কানাডা। পর্যটক আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভারত। তালিকায় দেশটি আছে ৪০ নম্বরে। এ ছাড়া ভুটান ৭৮ নম্বরে, নেপাল ১০৩ ও পাকিস্তান আছে ১২৪ নম্বরে।
যে ১৪টি সূচকের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১২৫ নম্বরে রয়েছে তার প্রথমেই আছে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ। এই সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ১০৪। বাংলাদেশে একটি ব্যবসা শুরু করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়, সে বিষয়গুলো এই সূচকে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বিমানবন্দর অবকাঠামো সুবিধায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩। এর মধ্যে বিমানবন্দরের ঘনত্ব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৪। প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য একটি দেশে কতটি বিমানবন্দর আছে, সেটি এই সূচকে তুলে ধরা হয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ ১৩৩ নম্বরে। পর্যটকদের আবাসন বা হোটেলের মান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। এ সূচকে বাংলাদেশ আছে ১৩৫ নম্বরে। অর্থাৎ শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে। বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে ভাড়া গাড়ির সেবার দুরবস্থার বিষয়টিও এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সূচকে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১২৯ নম্বরে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পের প্রসারের বিষয়টিও বাংলাদেশে কম গুরুত্বপূর্ণ। এ সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ১২৭। সরকারের অগ্রাধিকার খাত সূচকে বাংলাদেশ আছে ১১১ নম্বরে। অর্থাৎ পর্যটন খাতের উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণা, তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ, ব্র্যান্ডিংয়ের মতো সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ থেকে ১৩০-এর মধ্যে। বাংলাদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টিও ডবিøউইএফের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সূচকে বাংলাদেশ আছে ১২৩ নম্বরে। বাংলাদেশে পুলিশের সেবার বিশ্বস্ততার বিষয়টিও নিরাপত্তা সূচকে উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আছে ১১৭ নম্বরে। অর্থাৎ পুলিশের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকেরা খুব একটা আস্থাশীল নন।
পর্যটনশিল্পের প্রচারণার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তেমন কোনো বাজেট নেই। ইন্টারনেটে গেলেই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এমনকি ভারতের পর্যটনবিষয়ক অসংখ্য বিজ্ঞাপন চোখে পড়বে, কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনো বিজ্ঞাপন নেই। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর লাগেজ ফেরত পেতে এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগে। এভাবে চললে বাংলাদেশের পর্যটন খাত কখনোই বিকশিত হবে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৫ লাখের বেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছেন। আগের বছরে যা ছিল সাড়ে ৪ লাখের মতো। প্রতিবেশী দেশ নেপালে একই সময়ে পর্যটক এসেছেন ৭ লাখ ২৯ হাজার, ভারতে একই সময়ে পর্যটক এসেছেন প্রায় ৯০ লাখ। যদিও পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসায়িক কাজে যাঁরা বাংলাদেশে আসেন, তাঁদের পর্যটক বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়।
পর্যটন শিল্পের জন্য জন্য করণীয়: ১. পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নতুন করে র্দীঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় সাজাতে হবে। বর্তমানে পর্যটন মন্ত্রণালয় খুবই দুর্বল মন্ত্রণালয় হিসেবে চিহ্নিত। বার্ষিক বাজেটও তেমন থাকে না। উন্নয়ন কর্মকাÐ তেমন নেই বললেই চলে। পর্যটন শিল্প অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাÐের উপর নির্ভরশীল। তাদের কাজে সমন্বয় থাকা জরুরি।
২. পর্যটন মন্ত্রণালয়কে কম পক্ষে তিনটি আকর্ষণীয় পর্যটন বহুমুখী কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। তা হতে পারে ঢাকা বা ঢাকা জেলার আশে পাশে, দ্বিতীয়টি চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারে, তৃতীয়টি সিলেট জেলায়। এই সকল পর্যটন কেন্দ্র এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তা হতে পারে উন্নত দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সমান। সকল ধরনের বিনিয়োগের ব্যবস্থা রাখতে হবে। চমৎকার হোটেল থেকে শুরু করে সকল প্রকার বিনোদন ব্যবস্থা তাতে থাকতে হবে।
৩. এই তিনটি পর্যটন কেন্দ্রকে গড়ে তুলতে হলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সকল সংস্থার সক্রিয় সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাই এই কেন্দ্রসমূহ গড়ে তোলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তত্ত¡াবধায়নে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু পর্যটন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
৪. ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট ও কক্সবাজার বিমান বন্দরকে অত্যাধুনিক বিমান বন্দব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তা হলে নতুন নতুন পর্যটকদের মধ্যে আমাদের দেশে ভ্রমণে আসার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে বিমান বন্দরগুলোর অবস্থা খুবই নি¤œ মানের। অপরিছন্ন ও আধুনিক নয়। ঝকঝকে এবং তকতকে বিমান বন্দর ছাড়া পর্যটক আকর্ষণ করা যাবে না।
৫. পর্যটনের জন্য নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে আইনের সুশাসন কায়েম করতে হবে। পুলিশ, র্যাবকে ভয় না করে বন্ধু মনে করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে বিদেশি তো দূরের কথা আমরা বাংলাদেশিরা পুলিশ, র্যাবের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহস কম পাই। সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে পর্যটন শিল্প শিল্প হিসেবে কখনো দাঁড়াতে পারবে না।
৬. ভাড়া গাড়ির অবস্থা বাংলাদেশে খুবই খারাপ অবস্থানে রয়েছে। উল্লেখিত প্রতিবেদেনে ভাড়া গাড়ির অবস্থান ১৩৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১২৯ নম্বরে। বাস্তব আস্থা হচ্ছে ভাড়াটেক্সি, চট্টগ্রাম, সিলেট তো দূরের কথা ঢাকা শহরে অনেক চেষ্টা করেও সহজে ভাড়া টেক্সি পাবেন না। ভ্রমণের প্রধানতম শর্ত হচ্ছে সহজ ও কম খরচে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই অবস্থার উন্নতি ব্যতিরেকে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন অনেক অনেক কঠিন কাজ।
৭. আমাদের দেশে বহু প্রাচীনতম ও দর্শনীয় নিদের্শন রয়েছে। কিন্তু এই সকল স্থাপনা তেমন সুন্দরভাবে পরিপাটি নয়। তাই এসব স্থাপনা পর্যটকগণ দর্শন করে মনের তৃপ্তি লাভ করতে পারছে না। তাই এই সকল পর্যটন স্থানকে আকর্ষণীয় করে সাজাতে হবে। এই সকল স্থানে কিছিু কিছু আকর্ষণীয় বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেশীয় শিল্প সংস্কৃতির আদলে এই সকল পর্যটন কেন্দ্রে কিছু কিছু আকর্ষণীয় বিনোদন পর্ব তৈরি করা যেতে পারে যা দেখলে পর্যটকগণ আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সর্ম্পকে সহজে ধারণা লাভ করতে পারেন। এবং তারা আনন্দও পাবেন।
৮. বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পখাতের কিছু বিদেশি বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। অন্যদিকে সরকারের বড় বড় প্রকল্পে কিছু বিনিয়োগের কারণে বেশ কিছু বিদেশি দেশে আসা যাওয়া করছেন। এই সকল বিদেশিকেও আমরা পর্যটক হিসেবে গণ্য করছি। তা ঠিক নয়। সরকারি কাজ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দেশের মানুষ আসেন। তাদেরকেও পর্যটক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা কোন ক্রমেই পর্যটক নন। তাই এদের বাইরেও যাতে বিদেশিরা আমাদের দেশে আসেন, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯. পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য প্রচার অভিযান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশে নয়, বিদেশে আমাদের দেশ সম্পর্কে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রচার পরিকল্পনা করতে হবে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সেমিনার ও বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে পর্যটক আকর্ষণের জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে পারে। বিদেশি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে পযর্টনের স্থান সমূহ উল্লেখ করে নিয়মিত প্রচার অভিযান চালাতে হবে। এই ক্ষেত্রে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার চিন্তা করা যেতে পারে। তাতে ব্যয়ও কম হবে। প্রচার কাজেও বেশ সুবিধা পাওয়া যাবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।