Inqilab Logo

রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভিমত : হাওর থাকবে, দুর্নীতিবাজরা হারিয়ে যাবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শাহ সুহেল আহমদ : বলা হয়, শুধু শনির হাওরের ধান দিয়ে দেশের জনগণের তিন দিনের ভাতের যোগান দেওয়া সম্ভব। ছোট-বড় মিলিয়ে সুনামগঞ্জে হাওর আছে ১৩৩টি। একটি হাওর থেকে যদি পুরো দেশের মানুষ তিন দিন খেতে পারে তবে এই ১৩৩টি হাওরের ধান দিয়ে কতদিন খেতে পারবে? প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের দেশের হাওরগুলোও একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব সম্পদ রক্ষা করতে সরকার নানাভাবে উদ্যোগী হয়, দপ্তর-উপদপ্তর থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত রয়েছে। বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকে এজন্য। তারপরও কেন এসব সম্পদ রক্ষা করা যায় না, কেন হাওর ডুবে যায় এমন প্রশ্নের উত্তর আছে হাজারটা।
পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে হাওর এলাকার আয়তন দেশের মোট আয়তনের এক-সপ্তমাংশ। একসময় এই হাওর অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল, নলখাগড়ায় ভরা ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এবং জনসংখ্যার চাপে এই হাওরগুলোই একসময় হয়ে ওঠে বোরো ধানের প্রধান উৎস। হাওর এলাকার অর্থনীতি মূলত কৃষি এবং মৎস্যনির্ভর। এখানে বিভিন্ন জাতের ধানের পাশাপাশি অনেক প্রজাতির দেশি মাছ মেলে। হাওরের এই ধান এবং মৎস্য সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট এক ভূমিকা পালন করে। অথচ হাওর এবং হাওরবাসী বরাবরই উপেক্ষিত।
আজও লাগে নি কাক্সিক্ষত উন্নয়নের ছোঁয়া। আজও বন্যা, ঝড়, নদীভাঙন, দারিদ্র্য হাওরপারের মানুষের নিত্যসঙ্গী। তাই তো সামান্য বৃষ্টির পানিতেই তলিয়ে যায় হাওর এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন। সেহেতু হাওর এলাকার জমি বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকে, তাই এখানকার মানুষ বোরো ধানের ওপরই নির্ভর করে। হাওর এলাকার জমি প্রধানত একফসলি। পাহাড়ি ঢল, নেমে আসা বৃষ্টির পানি এবং নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে হাওর এলাকা আজ প্লাবিত। হাওরজুড়ে আজ কেবল ফসলহারা কৃষকের হাহাকার আর আর্তনাদ। এই অকাল ফসলহানির কারণে হাওরপারের দুই কোটি মানুষের ভবিষ্যতের সামনে আজ এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। ফসলহারা মানুষ আজ জীবিকার চিন্তায় শঙ্কিত। মহাজনের ঋণের টাকা শোধের চিন্তায় পাগলপ্রায়।
হাওরের বর্তমান দুরবস্থার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং প্রকৌশলীকে দায়ী করা হচ্ছে। সেই সাথে রয়েছেন প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা। স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনিম ছিল এমন ‘ঠিকাদারেরা প্রভাবশালী, বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকাদারদের প্রায় সকলেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। কেউ আওয়ামী লীগ কেউবা বিএনপির। তবে ঠিকাদার সকলেরই কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক গিয়ে ঠেকেছে ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগের কোনো মন্ত্রী কিংবা এমপি পর্যন্ত। পাউবো কর্মকর্তা আর প্রভাবশালী ঠিকাদার, দুইয়ের সমন্বয়ে চলে লাগামহীন দুর্নীতি। আর এতে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে হাওরের ফসল। কী আশ্চর্যের দেশ আমাদের! রাজনীতি করলেই প্রভাবশালী হয়ে যায় মানুষ। আর ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকলে যেন হাজারো অপরাধ মাফ! এ থেকে পরিত্রাণ পাক দেশ-জাতি, এমনটাই চাই।
হাওর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করতে শুধু সুনামগঞ্জের জন্য এবার বরাদ্দ ছিল ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গেল ২৮ ফেব্রæয়ারির মধ্যে এসব বাঁধ নির্মাণের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অভিযোগ, এ সময়ের মধ্যে ১০ থেকে ৩৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র। এ কারণে বন্যার প্রথম ধাক্কাতেই তলিয়ে যায় হাওর। এজন্য তারা পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দূষছেন। এছাড়া বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সব মহল থেকে উপস্থাপনের পর দুর্নীতি দমন কমিশনও কাজ শুরু করেছে। এদিকে দুর্নীতির কারণে ঠিকাদারদের বকেয়া পাওনা দেবে না বলে জানিয়েছে সরকার। পানিসম্পদ মন্ত্রী বলেছেন, হাওরে প্রতিবছরই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত স্থান মেরামত করা হয়। এখানে যে কাজ হয় সেটা হলÑ ২৮ ফেব্রæয়ারির মধ্যে বাঁধ মেরামত করার কথা থাকলেও তা মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত সময় নেয়প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। প্রত্যেকবারই দুর্নীতি করার জন্য এই সময়ক্ষেপণ করা হয়। এবারও সেটা হয়েছে। কাজ শেষ করতে করতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত গেলে তখন উজানে পানি এসে বাঁধ তলিয়ে যায়। কাজ পুরো না করেই টাকা তুলে নেয় পিআইসি। হাওর এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। সঙ্গতকারণেই সরকারের কাছে দাবি উঠেছিল, সুনামগঞ্জকে দুর্গত জেলা হিসেবে ঘোষণা এবং এখানকার মানুষের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার। পাশাপাশি তাদের কৃষিঋণ মওকুফ এবং পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি ওঠে।
সব শেষ হাওর পারের কৃষকের। স্বপ্ন তো নয়-ই, দু’মুঠো অন্ন ব্যবস্থারও এখন আর কোনো পথ নেই। এই অবস্থায় দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের বাঁধ ভাঙার পেছনে বহু কারণ দেখাবেন। এসবে কান না দিয়ে যদি দুর্নীতির প্রমাণ সাপেক্ষে এর পেছনে যারা আছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্ছ ব্যবস্থা নেয়া হয়, তবে আগামীতে হয়তো আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। মনে রাখতে হবে, হাওর থাকবে-কৃষক থাকবে। মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের জন্য যেন আমাদের লাখ লাখ কৃষক-কৃষাণীর বুকে হাহাকার না ওঠে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন