Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লোক দেখানো উচ্ছেদ, ভূমিদস্যুরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

চট্টগ্রামে পাহাড়ে মৃত্যুকূপে লাখো মানুষের বসতি

| প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের পাহাড়ে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে লাখো মানুষ। পাহাড়ের ঢালে অবৈধ এসব বসতি নামের মৃত্যুকূপে উচ্ছেদ অভিযান পরিচলনার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও পাহাড় খেকো ভূমিদস্যুরা। ফলে বর্ষায় এবারও পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে তদারকির অভাবে একের পর এক পাহাড় দখল করে তাতে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বিরান করা হচ্ছে, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। প্রতিবছর বর্ষা আসার আগে পাহাড় ধসে গণমৃত্যু ঠেকাতে উচ্ছেদ অভিযান হয়। তবে বাস্তবে দেখা গেছে এ অভিযান হয় অনেকটা লোক দেখানো। কিছু বাড়ি ঘর উচ্ছেদের পর আবার আগে মতো সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। চলে পাহাড় দখলের উৎসব। কিছু দিনের মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও স্বাভাবিক হয়ে যায়। পাহাড় দখল করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তুলে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া সেইসব ভূমিদস্যুরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
বর্ষা সামনে রেখে এবারও বৈঠকে বসে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদের। মঙ্গলবার থেকে পাহাড়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠা বসতিতে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান শুরু কথা থাকলেও তা এখনও শুরু হয়নি। চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ ও কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ এ অভিযান পরিচালনার কথা। কবে অভিযান শুরু হবে তাও জানা যায়নি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন তারা এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জানা গেছে পাহাড়ে যারা অবৈধ বসতি গড়ে তুলে ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করেন তারা প্রভাবশালী। তাদের পক্ষে আছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় সস্ত্রাসী মাস্তান এবং পাহাড় খেকো ভূমিদস্যুরাও এ চক্রের সাথে জড়িত। আর এই কারণে উচ্ছেদ অভিযান সফল হয় না। লোক দেখানে কিছুু উচ্ছেদ করে তাদের ফিরে আসতে হয়। বিষয়টি গত সোমবারের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। তবে বিভাগীয় কমিশনার রুহুল আমীন হুঁশিয়ারী দেন তারা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন উচ্ছেদ অভিযান চলবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি বলেন যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজে গাফেলতি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্ষা শুরু হতে হতে যাতে এসব স্বল্প আয়ের মানুষগুলো বসতি ছেড়ে চলে যায় সেজন্য এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সভায় মিরসরাই ও সীতাকুন্ড অঞ্চলের পাহাড়ে প্রভাবশালীদের পাহাড় কাটার বিষয়টি উঠে আসে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দ্রæত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান বিভাগীয় কমিশনার।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী মানুষের প্রকৃত সংখ্যা কত তা কারো জানা নেই। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি চিহ্নিত ৩০টি পাহাড়ে কম পক্ষে পাঁচ হাজার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক। ওই ত্রিশটি পাহাড় ছাড়াও নগরীর অদূরে সীতাকুন্ড ও হাটহাজারীতেও অসংখ্য পাহাড় দখল করে বসতবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা আসলে কিছু উচ্ছেদ অভিযান হয়। তবে এর মধ্যেও চলে পাহাড় দখল। থামে না পাহাড় ধসে গণমৃত্যু।
গত এক যুগে কম পক্ষে দুই শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে পাহাড় ধসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ২০০৭ সালে। ওই বছর ১১ জুন একদিনের রেকর্ড ভারী বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড় ধসে ১২৯ জনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে পাহাড় সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাহাড় দখলকারীদের একটি তালিকা প্রনয়ন করা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পূর্নবাসনের উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। বলা হয়, যারা পাহাড়ে থাকছেন তারা ভাড়া দিয়ে থাকছেন। ভূমিদস্যুরা পাহাড় দখল করে বসতি গড়ে তুলে তা ভাড়া দিচ্ছে।
২০০৭ সাল থেকে পাহাড়ে মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে দুর্যোগ থেকে রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এতসব উদ্যোগের মধ্যেও আরও কয়েকটি পাহাড় ধসের ঘটনায় বেঘোরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তখন বলা হয় যারা পাহাড় দখল করে মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদের বিচার হবে। শেষ পর্যন্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। প্রতিবছর বর্ষা আসলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা করে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এবারও নগরীর ৩০টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় এই ৩০টি পাহাড়ের মধ্যে ১১টি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস ৬শ ৬৬টি পরিবারের। এর মধ্যে লালখান বাজার এলাকায় মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৩শ ২০টি, একে খানের মালিকানাধীন পাহাড়ে এক ৮৬টি, ইস্পাহানী পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে ৫টি, লেকসিটি এলাকায় ১২টি, কৈবল্যধাম বিশ্বকলোনি এলাকায় ২৭টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ২২টি, সিটি করপোরেশনের পাহাড়ে ১১টি, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকার কাছে পাহাড়ে ৯টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তরে মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ৩৮টি, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩টি ও জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার বসবাস করছে।এ তালিকার বাইরেও অনেক পাহাড়ে হাজার হাজার পরিবার চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ