Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

গোদাগাড়ীতে পাঁচ জঙ্গিসহ নিহত ৬

বেনীপুরের অভিযান সমাপ্ত : জঙ্গি আশরাফুল আইটি বিশেষজ্ঞ

প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০১৭, ১১:২৯ পিএম | আপডেট : ১১:৩৬ এএম, ১৩ মে, ২০১৭

মো: হায়দার আলী, গোদাগাড়ী থেকে : রাজশাহী গোদাগাড়ীর বেনীপুরে জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন সান ডেভিল’ সমাপ্ত ঘোষাণা করেছে রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ। গতকাল শুক্রবার দুপুরে পৌনে একটার দিকে তিনি অনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেন। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে নিহত পাঁচ জঙ্গির লাশ ধানের জমি থেকে তুলে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ২৯ ঘণ্টা খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে লাশগুলো পড়ে ছিল। এই লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছিল। লাশ নিয়ে যাওয়ার আগেই জঙ্গি আস্তানার পাশের একটি ধানে খেতে অভিযানের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ। তার ব্রিফ শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। গত বৃহস্পতিবার সকালের ওই অভিযানে নিহত জঙ্গিরা হলো- বাড়ির মালিক সাজ্জাদ হোসেন (৫০), তার স্ত্রী বেলী বেগম (৪৫), তাদের ছেলে আল-আমিন (২০), মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) ও আশরাফুল ইসলাম (২৩)। আশরাফুল ইসলাম ছাড়া বাকি সবাই একই পরিবারের সদস্য। আশরাফুলের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের চর চাকলা গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল হক। পুলিশ জানিয়েছে, আশরাফুল ইসলাম একজন বিএসসি প্রকৌশলী। সে বড় ধরনের জঙ্গি বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আত্মগোপন অথবা প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সে এই বাড়ি এসেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে খবর পান এ জঙ্গি আস্তানার
সাংবাদিকদের ব্রিফকালে অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ বলেন, গোয়েন্দা সূত্রে তারা জঙ্গি আস্তানাটির খবর পান। এরপরই বাড়িটি ঘিরে রাখা হয়। ভেতরের জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ না করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ তখন গুলি চালায়। তবে নিহত পাঁচ জঙ্গির সবাই সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতি হয়েছে। তিনি জানান, বাড়ি থেকে ১১টি বোমা, একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। বোমাগুলো মাটির নিচে পুঁতে বিস্ফোরিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বাড়ি থেকে পুলিশের পোশাকের কাপড়, সুইসাইডাল ভেস্টের বেল্ট, গানপাউডার, বোমার সুইচ ও কিছু জিহাদী বইসহ নানা ধরনের আলামত জব্দ করা হয়েছে। নিশারুল আরিফ আরও বলেন, আশরাফুল বড় মাপের জঙ্গি। আর বাড়ির মালিক সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী মাঝারি মাপের। সাজ্জাদের ছেলে আল-আমিন ওরফে হামজা ও মেয়ে কারিমার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা কতদূর তা জানতে অনুসন্ধান চলছে। সাজ্জাদের আরেক ছেলে সোয়েবকেও সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে ধরা হচ্ছে। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে। বাড়ি থেকে আত্মসমর্পণ করা সাজ্জাদের মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে জানিয়ে নিশারুল আরিফ বলেন, প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানিয়েছে, বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠে জঙ্গিদের নানা প্রশিক্ষণ চলতো। তাই নিহত একই পরিবারের চারজনের কারোরই লাশ নিতে চান না তার স্বজনরা। এ জন্য এরই মধ্যে কোয়ান্টাম ফাউডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ময়না তদন্ত শেষে লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হবে। তবে জঙ্গি আশরাফুলের ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে লাশ ও আলামত সংগ্রহ করার পর আস্তানাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারাও ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে। বাড়িটির আশপাশে এখনও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে প্রত্যাহার করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। সুমাইয়ার স্বামী জহরুল ইসলামকে প্রায় ৬ মাস আগেই জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও এক ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হলেও বাড়ির ভেতরে অভিযান চালানো হয়নি। অপেক্ষা করা হচ্ছিল ডিএমপির বোমা বিশেষজ্ঞ দলের জন্য। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর তারা ঘটনাস্থলে আসেন। তারা আসতে দেরি করায় ওই রাতে অভিযান স্থগিত করা হয়। এ অভিযানে পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী যোগ দেয়নি। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয় ‘অপারেশন সান ডেভিল’। এ অপারেশনের মধ্যে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমবারের মতো একতলা টিনের ওই বাড়িটিতে ঢোকে। অভিযান চলে প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টা। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
জঙ্গি আস্তনায় দুই দিনের এই অভিযানে চরম উৎকণ্ঠায় ছিলেন বরেন্দ্রের অঞ্চল এই গ্রামের সাধারণ মানুষ। অভিযান শেষ হওয়ায় তারা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। তবে তাদের চোখ-মুখ থেকে এখনও কাটেনি বিস্ময়তার ছোঁয়া।
পাঁচ জঙ্গির লাশ পাঠানো হলো রামেক-এ
গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুর গ্রামের জঙ্গি আস্তানা থেকে জঙ্গিদের লাশ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিফজুর আলম মুন্সি লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, জঙ্গিদের লাশ নসিমনে করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয়েছে। একটি নসিমনে তিন জঙ্গি ও একটিতে দুই জঙ্গির লাশ নিয়ে আনা হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে উপজেলার বেনীপুর গ্রামের সাজ্জাদ আলী ওরফে মিন্টু (৫০) বাড়িটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলারক্ষাতারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহŸান জানানো হয়। কিন্তু জঙ্গিরা তাতে সাড়া দেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তখন বাড়িতে পানি স্প্রে করা শুরু করে। এসময় জঙ্গিরা বাড়ি থেকে বের হয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এক নারী জঙ্গি প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবদুল মতিনকে।
জঙ্গি আস্তানায় অস্ত্র-বোমা
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুরের জঙ্গি আস্তানায় অস্ত্র ও বোমা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গি আস্তানায় ১১টি বোমা, একটি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি ও একটি ম্যাগজিন পাওয়া গেছে। সকাল পৌনে ১০ টা ২৭ মিনিটের সময় বিকট শব্দ শোনা যায়, সেটি উদ্ধার হওয়া বোমার বিস্ফোরণের শব্দ। মাটির নিচে পুঁতে বোমা নিস্ক্রিয় করার সময় বিস্ফোরণের এ শব্দটি শোনা যায়। শুক্রবার সকাল থেকে এই জঙ্গি আস্তানায় দ্বিতীয় দিনের মতো অভিযান শুরু হয়। পরে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী ক্ষুদেবার্তায় সাংবাদিকদের জানান, জঙ্গি আস্তনায় চারটি ঘর আছে। তবে সেখানে জীবিত অবস্থায় কেউ নেই। যদিও আস্তনার ভেতরে কোনো লাশ কিংবা বিস্ফোরকদ্রব্য আছে কী না সে ব্যাপারে কিছু জানাননি তিনি। বৃহস্পতিবার ভোররাতে জঙ্গি আস্তাানায় সন্দেহে মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুর গ্রামের সাজ্জাদ আলীর বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। এরপর ভেতরের জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহŸান জানানো হয়। কিন্তু জঙ্গিরা এতে সাড়া দেয়নি। পুলিশ তখন ফায়ার সার্ভিসকে ডেকে পানি ছিটিয়ে বাড়ির পেছনের মাটির দেয়ালটি ধসিয়ে ফেলতে তৎপরতা শুরু করে। এ সময় জঙ্গিরা বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত হন। আর আহত হন দুই পুলিশ সদস্য। এ ঘটনার পর দুই নারীসহ পাঁচ জঙ্গি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতি হয়। তবে পুলিশের আহŸানে সাড়া দিয়ে সুমাইয়া নামে এক নারী আত্মসমর্পণ করেন। এর আগে জঙ্গি আস্তানার পাশ থেকে সুমাইয়ার দুই শিশু সস্তানকে উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে সুমাইয়ার বাবা, মা, ছোট ভাই ও বোন রয়েছে। নিহত অপর এক জঙ্গি এই বাড়িতে অবস্থান করছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের লাশ বাড়ির পাশের জমিতে পড়ে আছে। বৃহস্পতিবার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও এক ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হওয়ার পর বাড়ির ভেতরে অভিযান চালানোর জন্য এই বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের জন্যই অপেক্ষা করা হচ্ছিল। তবে তারা আসতে দেরি করায় ওই রাতে অভিযান স্থগিত করা হয়। পরে শুক্রবার সকাল থেকে ‘অপারেশন সান ডেভিল’ শুরু হয়। এ অপারেশনের মধ্যে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমবারের মতো একতলা টিনের ওই বাড়িটিতে ঢোকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ