মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
জাহাংগীর আলম : গত ২৭ মার্চ ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায় কয়েক জন রোহিঙ্গা শিশু। সবচেয়ে ছোট শিশুটি বড় বোনের কোলে। তারও মুখে হাত। ক্ষুধাতুর এবং ভয়ার্ত মুখ। হাসি খুশী থাকা বয়সের কোনো চিহ্ন নেই হতভাগ্য শিশুদের এই ছবিতে। সিরিয়ার হতভাগ্য শিশু আয়লানের সমুদ্রে ভাসা লাশ বিশ্ব বিবেককে বিচলিত করেছিল বছর দিন আগে। দূঢ়তার সাথে বলা যায় রোহিঙ্গা শিশু এবং নারীদের করুণ দৃশ্য বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। আবশ্য ইতোমধ্যে সচেতন বিশ্ব রোহিঙ্গাদের নিয়ে মুখ খুলেছে। সক্রিয় হয়েছে পশ্চিম দুনিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের উপর সম্প্রতি চালানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হয়েছে গত ২৪ মার্চ। ফলে চাপে আছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দমে যায়নি তাতে। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের প্যারেডে সেনা প্রধান মিন অং রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করে তাদের বহিরাগত বাঙ্গালী বলে বহিস্কারের ইংগিত দিয়েছন। এর আগে তিনি জাতিসংঘ তদন্ত কমিশনকে মিয়ানমার প্রবেশের চাপকে সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিজনক বলে উল্লেখ করেন। আর মিয়ানমার পররাষ্ট্র দফতরও ২৪ মার্চ রাতেই জাতিসংঘ কমিশনের সেদেশে প্রবেশের বিরোধিতা করেছে।
বর্বর রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যাকে অস্বীকার করা দিনের আলোকে অস্বীকার করার মতোই ধৃষ্টতা। অথচ মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী তাই করে আসছে। গত এপ্রিলে বিবিসির সাথে প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শান্তির নেত্রী সুচি অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেদের মাঝেই রক্তপাত ঘটাচ্ছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কেউ এধরনের অভিযোগ করেনি। আর এমনটা হলেও তারা দেশ ছাড়বে কেন? বরং সুচি সরকারের কাছে আশ্রয় চাইবে। জঘন্য অপরাধকে ঢাকার জন্য সুচির হয়তো ভিন্ন পথ খোলা নেই। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হবে কি? হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। শুধুকি তাই? চীন সীমান্তে কোচিন বিদ্রোহীদের সংঘাত বেড়েছে। নিরীহ জনগণ হাজারে হাজারে সীমান্ত অতিক্রম করে চীনে প্রবেশ করেছে। চীন সরকার ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারকে যথারীতি উপদেশও দিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কিছু বলেনি। বরং সম্প্রতি রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ কর্তৃক তদন্ত কমিশনকে মিয়ানমার প্রবেশের প্রস্তাবে ভোট দিতে যে গুটি কয়েক রাষ্ট্র বিরত থাকে তার মাঝে চীন অন্যতম। উল্লেখ্য যে, ভারতও ভোট দানে বিরত থাকে। আরো বেদনাকর হচ্ছে একমাত্র মালয়শিয়া ছাড়া মুসলিম দেশগুলোর মাঝেও কেউ কড়া ভাষায় রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ টুকুও করছে না প্রতিকারতো দূরের কথা। অথচ সৌদী আরবসহ মুসলিম দেশসমূহ কড়া প্রতিবাদ করে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। কার্যত তেমন কিছু হয়নি, যা মুসলিম উম্মার অসহায়ত্বকে প্রমাণ করে। আর এহেন দুর্বলতা বৈষয়িক দুর্বলতাসৃষ্ট নয় বরং স্বদেশে অগণতান্ত্রিক ভুল রাজনীতির পরিণাম। প্রতিটি মুসলিমদেশ নায়করা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার অবৈধ লড়াইয়ে লিপ্ত। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় যারা প্রাণপণ লড়ছে তারা বিপদেপড়া বাইরের কাউকে সাহায্য করার সুযোগ কোথায়? ইরাক ও সিরিয়া এবং লিবিয়া ৭০ দশকে চরম মুসলিম শত্রæ ইসরাইলের বিরুদ্ধে এক পায়ে দাঁড়ানো ছিল বেকা উপত্যকায় কামান পেতে। এখন এই দেশ তিনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এরমূলে যতনা বিদেশী চক্রান্তকে দায়ী করা হয় তার চেয়ে বেশি দায়ী দেশগুলোর রাষ্ট প্রধানদের একনায়কসুলভ রাজনীতি। তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট হয়তো মুখ খুলেন। কিন্তু কুর্দী বিচ্ছিন্নতা বাদীদের সাথে যুদ্ধ করে ঘর সামলাতে ব্যস্ত। ইয়েমেনে শক্তিক্ষয় করছে সৌদি আরব। আর যখন মুসলমানরা নিজেদের মাঝেই মারামারি বাঁধায় তখন আল্লাহতায়ালাও তাদের সাথে থাকেন না।
পাহাড়ী দেশ মিয়ানমার জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া দেশ নয়। নয় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কোনো দেশ। তবে ছিল শান্তির বাণী প্রচারক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী জনতার ভিড় কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা হত্যায় সক্রিয়। প্রায় চার দশক ধরে চলা সেনা শাসনের ফলে ঐ সংঘাত নিবারণের গঠনমূলক কৌশল মিয়ানমারের জন্য অসাধ্য বস্তু। একান্ত ভরসা ছিল শান্তিতে নোবেল জয়ী জননেত্রী সুচি। সেনাবাহিনীর চাপে তিনিও বিরক্ত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে। এতে প্রমাণ হয় শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি নির্ভরযোগ্য নন। লন্ডনস্থ বিলাতী স্বামী গৃহ থেকে অংসাং অসুস্থ মাকে দেখতে ইয়াংগুন এসে আটকা পড়েন পিতার দলীয় কর্মীদের হাতে। তাদের প্রবল অনুরোধে রাজনীতিতে নামেন। গৃহবন্দীর রাজনীতি করেই তিনি নোবেল জয় করেন ঝানু রাজনীতিক প্রজ্ঞায় নয়। ফলে সেনাবাহিনীর মন যুগিয়েই চলতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমারের উপর পূর্বের কঠোর অর্থনীতিক অবরোধ চাপাতে হবে। যে অবরোধ এককালের সমৃদ্ধ দেশ ইরাককে দুর্বল করেছিল তা কেনো অমুসলিমদেশে কার্যকর হয় না? লাইবেরিয়ার মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে যেখানে গণহত্যা ও সংঘাত দমনে জাতিসংঘ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে, সেখানে মিয়ানমারের সরকারকে বাগে আনা খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। জাতি সংঘের জন্য। একান্ত মুসলমানের জন্য নয় বিশ্ব শান্তির প্রয়োজনেই রোহিঙ্গা সংকট অবসান করা দরকার। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শুধু সিরিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি, শরণার্থী সমস্যা প্রকট করেছে ইউরোপে। রোহিঙ্গাদের জন্য ইউরোপ নেই- আছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গল আর সাগরে ডুবে মৃত্যু। ইতোমধ্যে অনেকে মারা গেছেন। প্রতিবেশী বাংলাদেশ এমন ক্ষুদ্র ভূখÐ যার নিজেরই মাথা গোঁজা দায়। তদুপরি নিকট অতীতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কাজেই মিয়ানমার কৃষিতে যারা যুগ যুগ ধরে অবদান রেখে এসেছিল, বার্মার পাহাড় জঙ্গল কেটে আবাদ করে আসছে ফসল, তাদের কোন অপরাধে দেশ ছাড়তে হবে? গণতন্ত্র ও সহ অবস্থানের বিশ্বে রোহিঙ্গা উচ্ছেদের নীল নকশা রুখতে হবে যেকোন মূল্যে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা নেতা আতাউল্লাহ রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করেছে বিশ্বের কাছে। যদিও জাতি সংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মিয়ানমার এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না।
এক্ষেত্রে যার বেশি এগিয়ে আসা দরকার সে হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি অনুপ্রবেশকারী বলে বাংদেশের কাঁধেই তাদের চাপাতে চাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের অন্যায় পদক্ষেপকে রুখতে হবে। না হলে রোহিঙ্গা সমস্যা পুরোটা বাংলাদেশের মাথায় চাপাবে মিয়ানমার যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার ঘরে বা বাইরে কোথাও ঘঠনমূলক তৎপরতা দেখাতে পারেনি একমাত্র অনুপ্রবেশ ঠেকানো ছাড়া। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করাতে চাই যে, ’৭১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যদি স্বউদ্যোগে তদানীন্তন পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাবলি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে না ধরতেন তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অনেক দেরী হতো এবং বাড়তো বাঙ্গালির দুর্ভোগ। তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও অনুরূপ প্রশংসনীয় ক‚টনৈতিক প্রয়াস চালিয়ে রোহিঙ্গার সংকট থেকে দেশকে বাঁচাতে তৎপর হবেন। এক্ষেত্রে দেশবাসীর সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। রোহিঙ্গা হতভাগ্য নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সাহায্য ও ভালোবাসাকে সম্মান দেখাতে হবে।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।