মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
শাহ সুহেল আহমদ : সাংবাদিকতায় যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এই ঝুঁকিটা যখন একজন সাংবাদিকের জীবন বিপন্ন করে তুলে এমনকি পৃথিবী থেকে বিদায়ই দিয়ে দেয় তখন এটাকে আর নির্যাতন বলা যায় না। ঝুঁকিটা যখন সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে ভয়ের সৃষ্টি করে তখন এটা মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার চ‚ড়ান্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর বাংলাদেশে এখন এই অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অবস্থান আসলে সত্যি কোন্ পর্যায়ে তা ধারণা করে না বলে একটি পরিসংখ্যান দিলে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার প্যারিসভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ২০১৬ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক নিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান গিয়ে ঠেকেছে ১৪৪-এ। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই রেঙ্কিংয়ে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশ ১৫ ধাপ পিছিয়েছে।
শুধু এই পরিসংখ্যানই নয়, বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থার পরিসংখ্যানেও বাংলাদেশের অবস্থা সূচনীয় হিসেবেই উঠে এসেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা প্রোটেক্ট টু জার্নালিস্টের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১১’তে (ভয়াবহতার তীব্রতায় উপর থেকে নিচে)। বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে মনে করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯। ২০১৫ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঘটা সহিংস ঘটনার একটিরও বিচারের মাধ্যমে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনার মধ্যে মাত্র পাঁচটি ঘটনার তদন্ত শেষ করা হয়েছে। ২৭ শতাংশ ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। আর প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটনা আইনের আওতার বাইরে রয়েছে।
এই যদি হয় অবস্থা, তবে সমাজ আর দেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে কতটুকু সাহস পাবেন সাংবাদিকরা? বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নির্যাতনের অগ্রভাগে থাকে, তখন এসবের বিরুদ্ধে কেউ সরাসরি কথা বলতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার দিকে নজর দেয়া যাক। গত ২৬ জানুয়ারি রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের ক্যামেরা পারসন আব্দুল আলীম ও রিপোর্টার এহসান বিন দিদারকে পুলিশ শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে বেদম মারধর করে। এ ঘটনার ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। কিন্তু এ ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কী বললেন! মন্ত্রী বললেন, পুলিশ সাংবাদিকদের নির্যাতন করেনি, মাঝেমধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর ও দায়িত্বশীল একটা জায়গায় বসে এ ধরনের মন্তব্য কোনোমতেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে না। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের দুইদিন পর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে তার পূর্বের মন্তব্যের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে পরমতসহিষ্ণুতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। সেই সাথে সাংবাদিকদের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে। আগে হুমকি দেয়া হতো, এখন আক্রমণ করা হয়, হত্যা করা হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বা শত্রæ মনে করেন। এ কারণে কোনো সম্পাদককে নিষিদ্ধ আর কারো বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা হয়। সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া, কোমরে রশি দিয়ে বাঁধা হয়। এসব ভয়ভীতিমুক্ত সাংবাদিকতার জন্যে অনুক‚ল নয়।
ইদানীং বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার পরিমাণও বেড়ে গেছে। সম্প্রতি ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলের ‘সেফটি অব জার্নালিস্টস অ্যান্ড দ্য ডেনজার অব ইমপিউনিটি’ শীর্ষক এক গবেষণায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বিশ্বে মোট ৮২৭ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৪-১৫ সালেই নিহত হয়েছেন ২১৩ জন। সংঘাতপূর্ণ এলাকায়ই সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হন। এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ৮২৭টি হত্যাকাÐের মধ্যে মাত্র ৫৯টি দেশ ৪০২টি হত্যা মামলার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৩টি। তদন্ত চলছে ৩৩৯টির। আর ৪২৫টি মামলার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো কোনো তথ্যই দেয়নি। সব মিলিয়ে সাংবাদিক হত্যায় বিশ্বব্যাপী ৯২ ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয় না।
বাংলাদেশে সর্বশেষ হত্যার শিকার হন দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। এ হত্যাকাÐের পর দেশব্যাপী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা আন্দোলনে নামেন।
আর সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে হামলার শিকার হলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাংবাদিক ডেইলি অবজারভারের সিলেট প্রতিনিধি সরদার আব্বাস ও দৈনিক সকালের খবরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সৈয়দ নবীউল আলম দিপু। ক্যাম্পাসে একটি মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তারা হামলার শিকার হন।
সাগর-রুনী হত্যাকাÐের ঘটনা তো মানুষ ভুলতেই বসেছে। অথচ এই ঘটনার রহস্যই উন্মুচিত করতে পারেনি কেউ। এভাবে স্পর্শকাতর একটি হত্যাকাÐের তদন্ত যদি এতোদিনেও শেষ না হয়, তবে বাকিগুলোরে অবস্থা কোন পর্যায়ে, তা সহজেই অনুমেয়।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমানে চরম ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করছেন সংবাদকর্মীরা। অভিন্ন মত পোষণ করেছেন সাংবাদিক নেতা, অপরাধ বিশ্লেষক এমনকি মানবাধিকার কর্মীরাও। তাদের মতে, বর্তমানে গণমাধ্যমকর্মীরা আক্রমণের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দোষীদের দ্রæত শাস্তি নিশ্চিতকরণসহ জনসাধারণকে সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার আহŸান জানাচ্ছেন তারা। তবে সেই সাথে সাংবাদিকদের মধ্যে তৈরি হওয়া অনৈক্য কমিয়ে এনে এক কাতারে দাঁড়ানোও কম জরুরি নয়।
ষ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।