চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মো. আব্দুল হামীদ নোহারী
\ এক \
যাবতীয় প্রশংসা ও গুণগান সেই মহীয়ান-আল্লাহতায়ালার জন্য। যিনি তার সৃষ্টির সেরা মানবমন্ডলীকে উত্তম অবয়বে সুসামঞ্জস্যশীল গঠনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান নিমিত্ত কতিপয় উত্তম নীতি-নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অতএব দেখা যায়, পবিত্র কোরআনে বিশ্বপ্রভূ স্বয়ং এরশাদ করেছেন, ‘ইন্নাচ্ছালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ে ওয়াল মুনকার’। ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানবমন্ডলীকে গর্হিত ও ন্যক্কারজনক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখে’। এ কথাটি কতদূর সত্য, এ সম্পর্কে বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলাম ধর্মে ৫টি স্তম্ভ। তন্মধ্যে নামাজকে প্রধান ও প্রথম স্তম্ভরূপে বলা হয়। প্রত্যহ ইসলামের আদেশ ও নির্দেশানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের আকুতি ও অঙ্গীকার করা হয় এহেন নামাজের মাধ্যমে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করা হয় যে, প্রত্যেক বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই যখন দৈনন্দিন কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকবেন, তখন তিনি আল্লাহকে ভয় করে চলবেন এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু সম্প্রতি আমরা বাস্তবে দেখতে পাই, আমাদের মধ্যে অনেকেই নামাজ পড়েন সত্য কিন্তু সুদ, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, মুনাফেকি, চাটুকারিতা, অশ্লীলতা ইত্যাকার গর্হিত কাজ থেকে আমরা মুক্ত নই। ব্যক্তি জীবনে সাধারণ মুসলিম চরিত্রের এই বৈপরিত্যের ফলে ব্যক্তি চরিত্রের কাক্সিক্ষত মান মোটেই অর্জিত হয় না। ফলে আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে ঈমানী দুর্বলতার শিকারে পরিণত হয়েছি। তাই আমাদের সামাজিক জীবনে একদিকে ঈদ ও জুমার নামাজে যেমন স্থান সংকুলান হয় না বলে আমরা দেখতে পাই, কিন্তু অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, হত্যা, রাহাজানি, নারী ধর্ষণ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্দেশ্যের সাথে ফলাফলের এই ধরনের বিপরীতমুখী প্রবণতার প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, আমাদের যাবতীয় এবাদত নেহায়েৎ আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। যন্ত্রের মতন অঙ্গ পরিচালন ও মন্ত্রের মতন উচ্চারণের দ্বারা বাস্তবে কোন ফলোদয় হয় না। এর প্রকৃত রহস্য কোথায়?
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যহ ভোর বেলা যখন পূর্বাকাশে সূর্য উদয় হয়, তখন রাত্রির অন্ধকার যেন কোথায় পালিয়ে যায়। তদ্রুপ প্রাক-ইসলামী যুগে পৃথিবীর বুকে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে মানুষ তাদের কার্যকারিতায় পশুত্ব জীবনকে হার মানিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় মাত্র ২৩ বছরে জাবালে নূরে প্রবর্তিত আল-কোরআনের আলোকে জগতের সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত করে দিয়েছিল। সেই গারে হেরার উজ্জ্বল আলোকে জগতময় মুর্খ জাতিকে জগৎ গুরুরূপে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল। দুর্দান্ত জালেম সম্প্রদায়কে সত্যিকার ন্যায়পরায়ণ, বর্বর শ্রেণীকে সসভ্য, চরিত্রহীনকে আদর্শ চরিত্রবান, ভবঘুরে ভ্রাম্যমাণ মানবগোষ্ঠীকে বাদশাহীর আসনে আসীন করে দিয়েছিল, একদল উচ্ছৃঙ্খল ডাকাত শ্রেণীর লোককে দেশ সেবক ও দেশের সম্পদ রক্ষাকারী, সুযোগ্য পাহারাদার সৈনিকরূপে মনোনীত করেছিল শুধু এটুকু নয় বরং সার্বিক ক্ষেত্রে দেশের কুসংস্কারকে দূরীভূত করে শ্রেষ্ঠতম জাতিরূপে পরিণত করে দিয়েছিল।
এহেন আমূল পরিবর্তনের মূলে কারণ ছিল একটি। এটা ছিল একমাত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। সেই আল-কোরআনের আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করে সেই সত্যিকার যুগে মুসলমান হয়েছে সর্বত্র সম্মানিত ও প্রশংসিত, আর বর্তমান যুগে সেই মুসলিম জাতি মহাগ্রন্থ আল-কোরআনকে ত্যাগ করে হয়েছে সর্বত্র লাঞ্চিত, গর্হিত ও অপমানিত। উক্ত মহাগ্রন্থের অনুসরণে অনুন্নত বর্বর জাতিকে অবনতির চরম গহŸর থেকে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের শীর্ষস্থানে উন্নীত করে দিয়েছিল, এমনকি বিশ্বের মানবমন্ডলীর মনে-মুখে প্রশান্তির রং ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং শৌর্যে-বীর্যে সর্বত্র এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে তাদের সামরিক কল-কৌশল, আনুগত্যতা, সহানুভুতি, ত্যাগ-তিতাক্ষা, আদল ও ইনছাফের অপূর্ব আদর্শ দেখিয়ে শত্রুপক্ষকে আবাক করে দিয়েছে। এছাড়া এসব খোদাপুরস্ত বুযুর্গ দিবা ভাগে দ্বীনে এলাহী প্রচারে ও প্রসারে যদিও ঘোড়সওয়ার এবং নিশীথ রজনীতে মহান প্রভূর স্মরণে সেজদারত অবস্থায় সময় কাটাতো। অতি অল্প সময়ে সেই মুসলিম জাতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে পদানত করে সগৌরবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলো, এমনকি মরু, কান্তার, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী বা সাগর-মহাসাগরের উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে তাওহীদের বাণী শুনিয়েছেন। এসব অজেয় শক্তির মূলে ছিল আল-কোরআনের বহু আকীমুচ্ছালাত অর্থাৎ নামাজকে প্রতিষ্ঠিত কর।
আল্লাহপাক আমাদেরকে নামাজ কায়েম করতে বলেছেন। কিন্তু কোরআন শরীফের কোথায়ও বলেননি, ‘নামাজ পড়’। পড়া ও কায়েম করার ভাবার্থ এক নয়। কায়েম কর কথাটিকে ইংরেজি ভাষায় বলে, ঊংঃধনষরংয, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত করা। আর প্রতিষ্ঠিত কর কথাটির মূল ভাবার্থ হচ্ছে, স্থাপন কর। মহান প্রভু আমাদেরকে নামাজ কায়েম কর না বলে সোজাসুজিভাবে তা বলে দিতে পারতেন, ‘নামাজ পড়’। কিন্তু তা না বলে তিনি আদেশ করেছেন নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর। এর প্রকৃত রহস্য অনেক সূ² ও সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এর নিগূঢ় তথ্য বুঝতে পারি না বলে নামাজ পড় বলে চালিয়ে দেই। মহান আল্লাহ কখনো নিরর্থক কথা বলেন না। তার কথার অর্থ বা তাৎপর্য যদি আমরা বুঝতে নাও পারি তবুও তার কথাই আমরা সঠিক বলে মেনে নিতে বাধ্য এবং এক্ষেত্রে কোনপ্রকার তর্কের অবকাশ নেই। আসলে মৌলিক গলদটা হচ্ছে এই যে, নামাজ কায়েম করা বা নামাজ প্রতিষ্ঠিত করা কাকে বলে সে কথাটা আমরা সঠিকভাবে বুঝি না। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ নামাজ কায়েম করা সম্পর্কে আমাদেরকে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা আলোচনার আগে কিছুকিছু বলে নেয়া উচিত।
নামাজে দন্ডায়মান হওয়াকে মনে করতে হবে সশরীর মহান আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া। একমাত্র তার খেয়াল-ধ্যানে ব্যতীত অন্য কোনদিকে খেয়াল দেয়া চলবে না। অন্যদিকে খেয়াল-ধ্যান না করার অর্থ হবে মহান আল্লাহর সাথে বেয়াদবী করা। এ সম্পর্কে সূরা মাউনে ৪-৫নং আয়াতে তিনি এরশাদ করেছেন, অতঃপর ঐ নামাজীদের জন্য ধ্বংস, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে অবহেলা করে। নামাজে অবহেলা করা মানে নামাজকে গুরুত্ব না দেয়া, কখনো পড়ে, কখনো পড়ে না, পড়লেও সময় মতো পড়ে না। নামাজে এমনভাবে যায়, যেন এতে কোন আগ্রহ নেই, দায়ে ঠেকে যেন যায়। নামাজ পড়া অবস্থায় কাপড় নিয়ে খেলে, বার বার হাই তোলে, নামাজ আদায় করছে অথচ মন সেদিকে নেই, এত তাড়াহুড়াভাবে আদায় করে যে, রুকু ও সেজদা ঠিকমতো হয় না ইত্যাদি।
অতঃপর সূরা কেরামতের এবং রুকু-সেজদার তাসবীহের অর্থসমূহ কিছুই না বুঝে এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা না রেখে শুধু নিছক কর্তব্য হিসেবে লোকলজ্জার ভয়ে রুকু-সেজদা দিয়ে নামাজ আদায় করা খেলার মাঠে শরীরচর্চা করার নামান্তর। সুতরাং আমাদের সমাজে কেউ নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহতায়ালাকে লাভ করার জন্যে। আবার কেউ নামাজ আদায় করে নিজেকে একজন ঈমানদার হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে সমাজের চোখে ধূলি দিয়ে ইচ্ছামতো অপকর্ম চালিয়ে যাবার জন্যে। ঈমানদারীর লেবাসে এবং কপালে নামাজের চিহ্ন করে লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেয়া গেলেও মহান আল্লাহকে ফাঁকি দেয়ার কোন উপায় নেই। তাই আমাদের সমাজে নামাজী কয়েক প্রকার বিদ্যমান। আৎকা নামাযী, সাতকা নামাযী, ৩৬০ কা নামাযী, শ্বশুরবাড়ি কা নামাযী। এহেন লোক দেখানো এবাদত মহান আল্লাহ কখনো পছন্দ করেন না।
মহান প্রভু ‘নামাজ কায়েম কর’ এ দ্বারা এ কথা বুঝাতে চেয়েছেন, যারা এরূপ করে, তাদের জন্যই হয় নামাজ কায়েম করা বা প্রতিষ্ঠিত করা, আর যারা এরূপ করে না শুধু তাদেরই জন্য হয় কেবল নামাজ পড়া বা পাঠ করা।
অতএব দেখা যায়, সত্যিকার যুগে মুসলমানরা ভয়ংকর যুদ্ধেও নামাজ কাজা করেননি বরং প্রচন্ড লড়াইয়ের সময় আযান দিয়ে শেণীবদ্ধ হয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায়ে রত থাকতেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।