চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
লে. (অব.) আকম জাহিদ হোসেন, ই বেঙ্গল : হযরত আদম (আ.) একাধারে মানবজাতির পিতা, এ পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত খলিফা (প্রতিনিধি) এবং প্রথম নবী। হযরত আদম (আ.) যে পৃথিবীর আদি মানব এবং সমগ্র জাতির আদি পিতা তা কোরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াত ও মহানবী (সা.)-এর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, ‘আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সাদৃশ। তিনি তাহাকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে বলেছেন, হও, ফলে সে হয়ে গেল।’ (সূরা আল ইমরান : ৫৯)। অর্থাৎ আদম (আ.) পিতা-মাতা ব্যতীত আল্লাহর কুদরতে সৃষ্ট, সরাসরি মাটি হতে। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও উহা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।’ (সূরা আরাফ : ১৮৯)। অন্য আয়াতে তার স্ত্রী হাওয়াকে তারই দেহ হতে সৃষ্টির উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা হতে তার সঙ্গী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুইজন হতে সমস্ত নরনারী ছড়িয়ে দেন।’ (সূরা নিসা : ১)। পবিত্র কোরআনের ৮টি সূরার ২৫টি স্থানে হযরত আদম (আ.) সম্পর্কে বলা হয়ছে। যেমন : সূরা বাকারা : ৩১, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৭; সূরা আল ইমরান : ৩৩, ৫৯; সূরা মায়েদা : ২৭; সূরা আরাফ : ১১, ১৯, ২৬, ৩১, ৩৫ ও ১৭২; সূরা বনি ইসরাইল : ৬১ ও ৭০; সূরা কাহফ : ৫০; সূরা মরিয়ম : ৫৮; সূরা তওবা : ৫৮; সূরা তোহা : ১১৫, ১১৬, ১১৭, ১২০ ও ১২১; সূরা ইয়াসীন : ৬০। এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির বিবরণ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সৃষ্টির উপাদান, ফেরেস্তাদের নিকট আল্লাহর ঘোষণা, ফেরেস্তাদের উক্তি ও সে ব্যাপারে আল্লাহর জবাব, আদমকে জ্ঞান দান, ফেরেস্তা কর্তৃক আদমকে সেজদাহ ও ইহাতে আযাযীলের অস্বীকৃতি, কুযুক্তি উত্থাপন এবং পরিণামে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত হওয়া, আদম (আ.)-এর জান্নাতে অবস্থান ও সঙ্গীরূপে স্ত্রী হাওয়াকে লাভ, শয়তানের প্ররোচনায় জান্নাতে আদম (আ.) ও হাওয়ার নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিকট গমন ও পরিণামে জান্নাত হতে পৃথিবীতে অবতরণ, তাদের তওবা কবুল হওয়া, তাদের বংশ বিস্তার, হাবীল-কাবীলের দ্ব›দ্ব ও তাদের কুরবানী, কাবীল কর্র্তক হাবীলকে হত্যা প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, মহান আল্লাহ ফেরেস্তা আযরাইলকে পৃথিবীতে পাঠান। তিনি পৃথিবীর উপরিভাগের যে মাটি নিয়ে যান তা দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর উপর আস্তরণ বা ভ‚-ত্বককে যেহেতু আরবীতে আদীম বলা হয়, সে জন্য তার নামকরণ করা হয় আদম। হযরত আলী (রা.) বলেন, আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয় আদীম বা ভ‚-ত্বক হতে।
আদমকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য কোরানুল করীমে সূরা বাকারায় বলেন, “(স্মরণ কর সে সময়ের কথা), যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেস্তাকে বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।” (সূরা বাকারা : ৩০)। ফেরেস্তারা বলল, “আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” তখন আল্লাহ বললেন, “আমি যা জানি তোমরা তা জান না।” আদম সৃষ্টি করার জন্য পৃথিবী থেকে মাটি আনার জন্য আল্লাহ ফেরেস্তা শিরোমণি জিব্রাঈল, মীকাইল ও আযরাঈলকে প্রেরণ করলেন। আযরাঈল পৃথিবীর নানা বর্ণের মাটি নিয়ে যান। উক্ত মাটি ভিজান হলে তা এঁটেল মাটিতে পরিণত হয়। অতঃপর তা পতিত অবস্থায়ই থাকে। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ বলেন, “আমি মানুষকে ছাঁচে ঢালা কর্দমের ঠনঠনে শুষ্ক মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা হিজর : ২৬)। আল্লাহ তাঁর বরকতপূর্ণ কুদরতি হাতে আদমের অবয়ব সৃষ্টি করলেন। দীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত আদমের অবয়ব পড়ে রইল। আল্লাহ যথাসময়ে তাতে রূহের সঞ্চার করলেন এবং রূহ তাঁর মাথার মস্তকে পৌঁছল, তখন আদম হাঁচি দিলেন। রূহ যখন তার চক্ষে প্রবেশ করল তখন তিনি জান্নাতের ফলফলাদি দেখতে পেলেন। রূহ তাঁর পেটে প্রবেশ করলে তার ক্ষুধা ও আহার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। রূহ তাঁর পদদ্বয়ে পৌঁছলে আদমের দেহ জান্নাতের ফল আহরণের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে আছে, হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির অব্যবহিত পরের একটি বর্ণনা রয়েছে এভাবে যে, নবীজি (সা.) বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা আদমকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ হাত। আল্লাহ বল্লেন : যাও, ওই যে ফেরেস্তারা বসে রয়েছে উহাদের সালাম দাও। তারা কি জবাব দেয় তা শুনবে। কেননা উহাই হবে তোমার ও তোমাদের সন্তানদের অভিবাদন। তিনি গিয়ে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। জবাবে তারা বললেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুলিল্লাহ। তারা রাহমাতুলিল্লাহ শব্দটি যোগ করলেন। আদম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহতায়ালা নূরের তৈরি ফেরেস্তা ও আগুনের তৈরি জ্বিন জাতির ওপর কেন আদমকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন, কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন, কেনই বা মানব জাতির মধ্যে অশান্তি সৃষ্টিকারী রক্তপাতকারী থাকা সত্তে¡ও এ কাঁদামাটির সৃষ্টি মানুষকেই খলিফা (প্রতিনিধি) বানিয়ে দুনিয়ায় পাঠাবার জন্য বেছে নিলেন, তার কারণও বর্ণিত হয়েছে আল কোরআনে-আল্লাহ বলেন, “আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন অতঃপর সে সমুদয় ফেরেস্তাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সূরা বাকারা : ৩১)। “ফেরেস্তাগণের জ্ঞান ভাÐারে সে জ্ঞান ছিল না। তাই তাদের পক্ষে তা বলা সম্ভব হয়নি। তারা লাজবাব হয়ে গেল। তাদের তখনকার অবস্থা এভাবে বিবৃত হলো, তারা বলল, আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই।” (সূরা বাকারা : ৩১)। মাও আশরাফ আলী থানবী (র.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুত বাহ্যিক পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যাবলী তাঁকে ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিয়েছেন।” ইবলিস শুরু থেকেই আদম সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিল। তাই ফেরেস্তাগণ আল্লাহর আদেশ পাওয়ার পরই সেজদারত হলো আর অন্যদিকে ইবলিশ অন্য পথ ধরল। তার জন্য অন্য পরিণতি অপেক্ষা করছিল। পবিত্র কোরানুল করীমে আল্লাহ বলেন, “যখন আমি ফেরেস্তাদেরকে বললাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।” (সূরা বাকারা : ৩৪)। ইবলিস আদেশ পালন না করার কারণ আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেন এবং তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক‚টতর্ক ও ইহার পরিণতিতে করুণ পরিণতির কথাও কোরআনে বর্ণনা করেন। “তিনি বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে নিবৃত্ত করল যে, তুমি সিজদা করলে না? সে বলল, আমি তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তিনি বললেন, এ স্থান হতে নেমে যাও, বের হয়ে যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আরাফ : ১২-১৩)। অন্য আয়াতে আছে, “তখন ফেরেস্তাগণ সকলে একত্রে সিজদা করল, ইবলিস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলিস! তোমার কি হল যে, তুমি সিজাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না? সে বলল, আপনি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠনঠনে মৃত্তিকা হতে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সিজদাহ করব না। তিনি বললেন, তবে তুমি এখান হতে বের হয়ে যাও; কারণ তুমি অভিশপ্ত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত অবশ্যই তোমার উপর লানত।” (সূরা হিজর : ৩০-৩৪)। এভাবে মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় আসমানে ও জমীনে আযাযীলের দীর্ঘকালের ইবাদত-বন্দেগী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। সে (ইবলিস) বলল, পুণরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে তুমি অবশ্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে। সে বলল, আপনি আমাকে শাস্তি দান করলেন, এ জন্য আমিও আপনার সরলপথে মানুষের জন্য নিশ্চয়ই ওঁৎপেতে থাকব। অতঃপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক হতে এবং আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। তিনি বললেন, এ স্থান হতে ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও।
মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব।” (সূরা আরাফ : ১৪-১৮)। আল্লাহ ইবলিসকে জান্নাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দিলে সে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে বিপথগামী করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করে। তিনি তা মঞ্জুর করেন। শয়তান মহাপ্রলয়ের দিন পর্যন্ত সুযোগ পেয়েছে। কারণ সেদিনের পর পৃথিবীতে কোনো মানুষ জীবিত থাকবে না। শয়তানের অনুসারী, দোসর, তাঁবেদার সবাই জাহান্নামী হবে। শয়তানের দম্ভোক্তি সম্পর্কে অন্য আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে। “সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! বিপথগামী হওয়ায় আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মটি অবশ্যই শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার নির্বাচিত বান্দাগণ ব্যতীত।” (সূরা হিজর : ৩৯-৪০)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।