চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা এইচএম গোলাম কিবরিয়া (রাকিব)
\ শেষ কিস্তি \
আর তাতেও না পেয়ে আমর ব্যক্তিগত রায় দ্বারা সমাধান করবো। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর জন্য দু‘আ করে তাঁকে বিদায় দিলেন (তিরমিযী ও আবূ দাউদ)।
সাহাবায়ে কিরামের যুগে ফাতওয়া: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম (রা) ফাতওয়া দানের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। সাহাবা যুগে মাহরের উল্লেখ ছাড়া এক মহিলার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সাক্ষাতের পূর্বেই স্বামী মারা যায়। তখন ঐ মহিলার মাহর কত ধার্য হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এর সমাধানের জন্য আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা)-এর কাছে যাওয়া হলো। তিনি উপস্থিত সাহাবাগণের সামনে বললেন, এ বিষয়ে আমার দেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ দেখছি না। কারণ কুরআন ও সুন্নায় এ বিষয়ক স্পষ্ট কোন হুকুম পাওয়া যাচ্ছে না। এই রায় প্রয়োগ করায় আমি যদি সঠিক হই তবে এর প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর প্রাপ্য। আর যদি ভুল করি তবে তা আমার এবং শয়তানের ঘাড়ে পড়বে। উপস্থিত সাহাবাগণ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের এ কথায় কোন প্রতিবাদ করেননি। তিনি ‘মহরে মিসল’-এর রায় দিয়ে দিলেন। তাঁর একাজ দ্বারা সাহাবাদের ফাতওয়া দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়।
ফাতওয়া দানকারী সাহাবাদের স্তরবিন্যাস
খুলাফায়ে রাসেদীন এবং অন্যান্য যে সকল সাহাবাদের ফাতওয়া বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে সংরক্ষিত আছে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মহিলা সাহাবীও রয়েছেন। তাঁদেরকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে : ১. মুকাসসিরীন ২. মুতাওয়াসসিতীন ৩. মুকিল্লীন।
মুকাসসিরীন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) :
অধিকসংখ্যক ফাতওয়া দানকারী সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হলেন মুকাসসিরীন। তাঁদের প্রত্যেকের অধিকসংখ্যক ফাতওয়া বর্ণিত হয়েছে এবং রক্ষিত আছে যা স্বতন্ত্রভাবে সংকলন করা হলে প্রত্যেকেরই এক একটি বিরাট কিতাব হয়ে যাবে। এ সাহাবাদের সংখ্যা ৭ জন। তাঁরা হলেনÑ
১. দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা., মৃত্যু ২৩ হিজরী।
২. চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা., মৃত্যু ৪০ হিজরী।
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা., মৃত্যু ৩২ হিজরী।
৪. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা., মৃত্যু ৫৭ হিজরী।
৫. হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা.।
৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., মৃত্যু ৬৮ হিজরী।
৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা., মৃত্যু ৭৩ হিজরী।
মুতাওয়াসসিতীন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)
যে সকল সাহাবায়ে কেরাম (রা.)Ñ এর ফাতয়াসমূহ আলাদাভাবে সংকলিত হলে প্রত্যেকেরই এক একটি ছোট কিতাব হয়ে যাবে তারা হলেন মুতাওয়াসসিতীন। তাদের সংখ্যা ২০ জন (বিস্তারিত দেখুন ফাতওয়া ও মাসাইল, ১ম ও ২য় খÐ, পৃ. ২১৮-২১৯, ইফা)।
মুকিল্লীন সাহাবায়ে কেরাম (রা) : যে সকল সাহাবা কেরাম (রা)Ñএর ফাতাওয়ার সংখ্যা অতি অল্প তাঁরা হলেন মুকিল্লীন। এই স্তরের কোন কোন সাহাবী থেকে মাত্র একটি ফাতওয়াও বর্ণিত হয়েছে। তথাপি তাঁদের সকলের ফাতাওয়া একত্র করা হলে একখানা ফাতওয়ার কিতাব হয়ে যাবে। এ স্তরের সাহাবাদের সংখ্যা ১২২ জন (বিস্তারিত দেখুন ফাতওয়া ও মাসাইল, ১ম ও ২য় খÐ, পৃ.২১৮-২১৯)।
তাবিঈদের যুগে ফাতওয়া : সাহাবায়ে কিরামের যুগের পর আসে তাবিঈদের যুগ। এ যুগে যথারীতি ফাতওয়ার কাজ চলতে থাকে। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এবং এর পরবর্তীকালে মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি অনেক বিস্তৃতি লাভ করে, দিগদিগন্তে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। বহু নতুন দেশ এবং জাতির মধ্যে ইসলাম প্রসার লাভ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন নতুন প্রশ্ন ও সমস্যার সৃষ্টি হয়। তখন ফাতওয়া দেওয়ার কাজ তাবিঈদের দায়িত্বে চলে আসে। কিন্তু তাবিঈগণের মধ্যে অনেকে শুধু ফাতাওয়া প্রদানের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা পসন্দ করেননি। তাঁদের কেউ কেউ হাদীসের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ মহান আল্লাহ প্রদত্ত ইজতেহাদী শক্তি ব্যবহার করে সমাজের নতুন নতুন সমস্যা সমাধান মশগুল থাকেন। এমনিভাবে তাবিঈগণের কার্যক্রম দুই ধারায় চলতে থাকে। প্রথম দলের কাজ ছিল সাধারণ হাদীস সংক্রান্ত। তবুও প্রয়োজনে তাঁরা ফাতওয়া প্রদান করতেন। আর দ্বিতীয় দলের আলেমগণ ফিকহ ও ফাতাওয়ার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তবে হাদীস সংরক্ষণ ও হাদীস সংকলেনও তাঁদের ভূমিকা কম নয়। তাবিঈ আলেমগণের কর্মধারা এরূপ ছিল যে, তাঁরা ফাতওয়ার কাজ সাধারণত হাদীসের খেদমতের পর করতেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় শ্রেণীর তাবিঈ আলেমগণ বর্তমান ও ভবিষ্যতের অবস্থার প্রতি মনোযোগ দেন। তাঁরা কুরআন-হাদীসের আলোকে মাসআলা-মাসাইল উদঘাটনে আত্মনিয়োগ করেন। মহান আল্লাহর রহমতে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফিকহ শাস্ত্রের প্রতিটি অধ্যায়ে বহুবিধ মাসআলা ও ফাতওয়া রচিত ও সংকলিত হয়। ইমাম শা‘বী (র) আবওয়াবে শা‘বী ও ইমাম মাকহূল (র)-এর সুনানে মাকহূল এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ পর্যায়ের তাবিঈগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (র) ও হযরত সালিম ইবন আবদুল্লাহ (র)।
তাবিঈ যুগে মদীনার কাযী ও মুফতী : আবু সালমা ইবনে আবদুর রাহমান ইবনে আওফ (র), উরওয়াহ ইবনুয যুবাইর (র), উবাইদুল্লাহ (র), কাসিম ইবনে মুহাম্মদ (র), সুলাইমান ইবনু ইয়াসার (র), খারিজা ইবনে যায়েদ (র), তাদেরকে একত্রে ফুকাহা সা‘আ বলা হয়। তাঁরা সকলেই মদীনার কাযী ও মুফতী ছিলেন।
তাবিঈ যুগে মক্কার মুফতী : ইমাম যুহরী (র) ইমাম ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ (র) ইমাম রাবিযাহ ইবনে আবদুর রাহমান (র) আতা ইবন আবূ রাবাহ (র) আলী ইবনে আবূ তালহা (র) ও আব্দুল মালিক ইবনে জুরাইজ (র) মক্কার ফকীহ ছিলেন।
তাবিঈ যুগে কুফার মুফতী : হযরত ইবরাহীম নাখঈ (র) আমির ইবনে শারজীল আশ-শা‘বী (র) আলকামা (র) আসওয়াদ (র) মুরারা আল-হামদানী (র) কুফার মুফতী ছিলেন।
তাবিঈ যুগে বসরা, ইয়ামান, শাম ও সিরিয়ার মুফতী : হযরত হাসান বসরী (র) বসরায়, তাঊস ইবনে কাউসান (র) ইয়ামানে ও মাকহুল (র) শাম-সিরিয়ার মুফতি ছিলেন (ফতাওয়া ও মাসাইল, ১ম খন্ড, পৃ: ২২৮-২২৯)।
মুফকি/ফাতওয়া প্রদানকারির যোগ্যতা: আল্লামা খতীব বাগদাদী (র) ‘আল্-ফিকহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ্’ কিতাব বলেন, “সরকারীভাবে প্রত্যেক আলেম ও মুফতির যোগ্যতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। যারা ফাকওয়া দেওয়ার যোগ্য শুধুমাত্র তাদের দ্বারা একাজ করানো উচিত। অন্য সবলকে এহেন সূ² কাজ থেকে বিরত রাখার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।” তিনি যখন একথা বলেন বা লিখেন তখন ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামি না হলেও মুসলিমদের শাসন চলছে। এ অবস্থায় ও মুফতিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা বিবেচনায় নিয়ে ফকীহ ও মুফতিদের অনুমোদনকারী একটি বিশেষজ্ঞ কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। ফাতওয়া প্রদানকারীদের যেসব যোগ্যতা ও গুণবৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা নিম্নরূপ : ১. মুসলিম ২. কুরআন-সুন্নাহর ইলম ৩. উসূলে ফিকহ-এ নাসিখ মানসূখ-এর ইলম ৪. ফিকহ এর পরিভাষা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল ৫. ইনসাফ ৬. বাস্তব জ্ঞান ৭. হালনাগাদ তথ্য জানতে হবে। “যে ব্যক্তি তার যুগের হাল-অবস্থা জানে না সে জাহিল বা মুর্খ”, ৮. ইফতার কাজের নিয়ম-নীতি জানতে হবে, ৯. আমলদার, চরিত্রবান, মুত্তাকী, সচেতন, দৃঢ়চিত্ত ও দক্ষ হতে হবে, ১০. মনের প্রশস্ততা ও উদারতা, ১১. কোন যোগ্য অভিজ্ঞ মুফতীর অধীনে কাজের অভিজ্ঞতা।
আমাদের দায়বদ্ধতা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামী আইন ও ফাতওয়ার সৌন্দর্য-সুষমা, মানব জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা গ্রহণযোগ্য উপায়ে উপস্থাপন করা আলেম সমাজের দায়িত্ব। এ বিষয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং ফাতওয়া প্রদানের জন্য বিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। যে যখন যেমন মনে চায় তেমন ফাতওয়া দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফাতওয়ার মানও যায়। অযোগ্য, মূর্খ, অর্ধশিক্ষিত লোকেরা ফাতওয়া দিলে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ইসলাম ও ইসলামী জীবনধারার। যে ফাতওয়া যোগ্য লোকের চেয়ে অযোগ্য লোকেরা বেশি দিচ্ছে, ফলে সমাজ জীবনে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। কোথাও সালিশের নামে আইন হাতে তুলে নেয়া হচ্ছে। দুররা মারা হচ্ছে। যদিও তা ফাতওয়া নয় কিন্তু গণমাধ্যমে এটাকে ঢালওভাবে ফাতওয়া বলা হচ্ছে। অথচ আইন হাতে তুলে নেয়া, সালিশে কাউকে শাস্তি দেয়া, বেত্রাঘাত করা, গ্রামের কোন পরিবারকে একঘরে করে দেয়া এর কোনটাই ফাতওয়া নয়। এর সাথে এ দেশের যোগ্য আলেমদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কাউকে শাস্তি দেয়ার নাম ফাতওয়া নয়। ফাতওয়া হচ্ছে কোন বিষয়ে শরীয়াতের সিদ্ধান্ত বা সমাধানের নাম, যা বলে দেন যোগ্য মুফতী। ফাতওয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব মুফতীর নয়। আদালতের রায় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়া কেউ আইন প্রয়োগ করতে পারে না।
লেখক: খতিব, শিক্ষক, প্রবন্ধিক ও উপস্থাপক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।