Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফাতওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

| প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাওলানা এইচএম গোলাম কিবরিয়া (রাকিব)

\ এক \
ফাতওয়া মুসলমানদের জীবনব্যাপী উদ্ভূত সমস্যাসমূহ সম্পর্কে সমাধান জিজ্ঞাসা ও বিধিবিধান জানার একটি নিরন্তন মাধ্যম এবং মুসলিম সমাজকে সুশৃঙ্খল ও নিয়ামনুবর্তী রাখার এক কার্যকর উপায়। জীবন ও জগতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যবহারে ফাতওয়া অনস্বীকার্য। মানব জীবনে শ্লীলতা ও শালীনতা রক্ষায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। স্রষ্টা ও অধিকার সংরক্ষণের এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তা অতীব জরুরি। সকল প্রকার অন্যায়, জুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধে এটি একটি উপযুক্ত অবলম্বন। সুতরাং ফাতওয়া মুসলিম সমাজের এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। আমাদের দেশে একটি ইসলামবিদ্বেষী চক্র ইসলামের কৃষ্টি-কালচার, পরিভাষা ও আচরের প্রতি জনমানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ঘৃণা সৃষ্টির অপচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে নির্বিচারে বিনা বাধায় অব্যাহতভাবে ফাতওয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। যারা এসব কাজ করছে তাদের অধিকাংশই মুসলিম ঘরের সন্তান। ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জীবনাদর্শ সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতা এর মূল কারণ। জিহালাত (অজ্ঞতা) চার প্রকার : ১. না জানা, ২. জানার পর না মানা, ৩. ভুল জানা বা ভুলভাবে জানা, ৪. জানার পর অস্বীকার করা। যেসব বিষয় ও পরভাষা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে ফাতওয়া তার অন্তর্ভুক্ত। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে; নিম্ন আদালাত, হাইকোর্ট হয়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকে একটি সম্মানজনক ও স্বস্তিদায়ক সুরাহা মিলেছে। কিন্তু মাঠে-ময়দানে পূর্বের অপপ্রচার বন্ধ হয়নি। পক্ষান্তরে ফাতওয়া বিষয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ও ফাতওয়ার প্রকৃতি ও মর্যাদা রক্ষায় দেশের আলেম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে। আভিধানিক অর্থে ফাতওয়া : যে কোন প্রশ্নের উত্তরদানকে আভিধানিক অর্থে ফাতওয়া বলা হয়। তা ধর্মীয় বিধান সংশ্লিষ্টও হতে পারে এবং কোনো বিষয়েও হতে পারে। যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে:
“আর লোকজন তোমার নিকট নারীদের বিষয়ে ফাতওয়া (ব্যবস্থা) জানতে চায়। বল, আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সম্পর্কে ফাতওয়া বলে দিচ্ছেন” (সূরা নিসা ৪ : ১২৭)।
হযরত ইউসুফ আলাইইিস সালাম কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁরা নিকট মিসরের তৎকালীন বাদশাহর পক্ষ থেকে একটি স্বপ্নের তা‘বীর (ব্যাখ্যা) জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ স্থলেও ফাতওয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। কুরআন মাজীদে ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে : “রাজা বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটতাজা গাভী, এদেরকে সাতটি শীর্ণকায় গাভী ভক্ষণ করছে এবং দেখলাম, সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুঙ্ক। হে প্রধানগণ! যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পার তবে আমার স্বপ্ন সম্পর্কে অভিমত (ফাতওয়া) দাও” (সূরা ইউসুফ, ১২ : ৪৩)।
অনুরূপভাবে সুলায়মান আলাইহিস্ আলাইহিস্ সালাম-এর সময় সাবা কওমের সম্রাজ্ঞী বিল্কীস তাঁর মন্ত্রী পরিষদের কাছে যখন পরমর্শ চেয়েছিলেন, তখন তিনি ‘আফতূনী’ (তোমরা আমাকে ফাতওয়া দাও) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। উল্লেখিত উভয় ে ক্ষত্রেই ফাতওয়া শব্দটি পার্থিব সমস্যার সমাধান চাওয়ার জন ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু শরীয়াতের পনিরভাষায় কেবল দ্বীনী কোন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ফাতওয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন কুরআন মাজীদের বলা হয়েছে : “লোকজন তোমার নিকট ফাতওয়া (ব্যবস্থা) জানতে চায়। বল, পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে তোমাদেরকে আল্লাহ ফাতওয়া (ব্যবস্থা) বলে দিচ্ছেন” (সূরা নিসা ৪ : ১৭৬)। উপরোক্ত আয়াত দু’টি থেকে আমরা পারি যে, ফাতওয়া স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন। প্রথম আয়াতে মহিলাদের বিষে সংক্রান্ত ব্যাপারে এবং দ্বিতীয়টিতে ফারাইয সম্পর্কে প্রশ্ন ও উত্তর উভয় ক্ষেত্রে ‘ফাতওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে : “লোকজন বৈধ বলে ফাতওয়া দিলেও সে বিষয়ে যদি তোমার মনে কোন খটকার সৃষ্টি হয় তবে সেটা গুনাহ।” “ফাতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি দুঃসাহসী যে জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে বেপরওয়া”। উভয় হাদীসে ফাতওয়া শব্দটি দীনী বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, সাধারণভাবে ফাতওয়া বলতে দ্বীনী যে কোন সমস্যার সমাধানকে বুঝায় ( উসূলে ইফতা, মাওলানা তাকী উসমানী)। শরীয়াতের পরিভাষায় ফাতওয়া : কুরআন, হাদীস ও নির্ভরযোগ্য ফিকহ-এর কিতাবসমূহের সাহায্যে স্থান কাল পাত্রের প্রতি লক্ষ রেখে একজন দক্ষ ফকীহ বা মুফতী যে অভিমত প্রদান করেন ইসলামী শীরয়াতে তাকেই ফাতওয়া বলে  (ফতাওয়া ও মাসাইল, ১ম খÐ, ইফা প্রকাশনা)। মুফতীর পরিচয় : যে ফিক্হবিদ মানব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের শরীয়াত মোতাবেক উত্তর দিয়ে থাকেন তাকে মুফতী বলা হয় (ফাতওয়া ও মাসাইল, ১ম খÐ; ইফা.)।
ফাতওয়ার প্রয়োজনীয়তা : ফাতওয়ার প্রয়োজনীয়তা সর্বযুগেই ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ কালের পরিক্রমায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে মানুষ নানামুখী সংকট ও জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হচ্ছে। মানুষের আচর-আচরণে নিত্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে শরীয়াত বিশেষজ্ঞদের কাছে শেষ নেই। মানুষ সমস্যা নিয়ে আসবে, মুফতীগণ শরীয়াতের আলোকে জবাব দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। মানব জীবনে সমস্যার যেমন শেষ নেই তেমনি এর সমাধানের প্রক্রিয়ারও শেষ হবে না। পৃথিবীতে মানুষের অবস্থানকালীন এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। আর মানবতার ইহ-পরকালীন কল্যাণ এর আবশ্যকীয়তা ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
মুফতীয় প্রয়োজনীয়তা : ফাতওয়ার প্রয়োজনীয়তার সাথে মুফতীর প্রয়োজনীয়তাও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রের জন্য মানুষ যেমন ডাক্তারের কাছে যায়, আইনী ব্যাখ্যা ও সহায়তার জন্য উকিল মোক্তারের কাছে যায়, বিল্ডিং-এর নকশা করার জন্য প্রকৌশলীর দ্বারস্থ হয়, তেমটি মানব জাতির জীবন সমস্যার শরয়ী সমাধানের জন্য মানুষকে মুফতীর নিকট আসতে হয়। সুতরাং সমাজে ফকীহ ও মুফতীর প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামী সমাজে মুফতী তৈরী করার বিধান হচ্ছে ফরযে কিফায়া।
মাসআলা-মাসাইল : ফাতওয়ার পাশাপাশি বহুল প্রচলিত একটি শরয়ী পরিভাষা হচ্ছে মাসআল। মাসআলা শদ্বের অর্থ প্রশ্ন ও সমাধান করার স্থান। পরিভাষায় ফাতওয়ার অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তবে শরীয়াতের মূল ফয়সারাকে মাসআলা এবং স্থান। পরিভাষায় ফাতওয়ার অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তবে শরীয়াতের মূল ফরসালাকে মাসআল এবং স্থান কাল প্রাত্রভেদে শরীয়াতের সমাধানকে ফাতওয়া বলে। সুতরাং প্রত্যেক ফাতওয়াই মাসালা কিন্তু প্রত্যেক মাসআলাহ ফাতওয়া নয়।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় ফাতওয়া :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় ফাতওয়া নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের কোন সমস্যা ছিল না। তাঁরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন। সমস্যার সমাধান জানা থাকলে তিনি তাৎক্ষণিক বলে দিতেন; আর জানা না থাকলে ওহীর অপেক্ষা ওয়াসাল্লাম নিজেও ফাতওয়া দিয়েছেন। পরবর্র্তীকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের ফাতওয়াসমূহ ইসলামী বিধি-বিধানের মূল উৎস পরিণত হয়েছে। মুসলিম সমাজে এসব হাদীস হিসাবে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরাম এসব যতœ ও গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করেছেন। কেউ কেই তা লিখেও রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় কোন সাহবী ফাতওয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করেননি। তবে ক্ষেত্রবিশেষ কোন কোন সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতওয়া দানের অনুমোদন দিয়ে বিষয়টিকে সহজতর করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মু‘আয ইব্ন জাবাল (রা.)-কে ইয়ামানের গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কিভাবে ফয়সালা করবে ? উত্তরে তিনি বলেন, আমি কুরআনের আলোকে সমাধান দেব। কুরআনে সমাধান না পেলে হাদীসে রাসূল সা. থেকে সমাধান দেব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ