Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্নীতি অনিয়ম দিয়ে শুরু : নাটের গুরু তমা কন্সট্রাকশন

মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে গার্ডার ভেঙে নিহত ১ আহত ২

| প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : শুরুটা হয়েছিল ভুল দিয়ে। একটা ভুলকে আড়াল করতে গিয়ে পদে পদে অনিয়ম হয়েছে মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে। যার নাটের গুরু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন। অভিজ্ঞতা ছাড়াই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়েছিল তমা। খেসারত হিসাবে গার্ডার পড়ে ঝরে গেল একটি প্রাণ। পঙ্গু হলো আরও দু’জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাজ পাওয়ার জন্য তমার লবিংয়ের কাছে খোদ এলজিইডিও ছিল অসহায়। তমার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কয়েক দফা প্রকল্পের টাকা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। একই সাথে বেড়েছে সময়, ব্যয় ও জনভোগান্তি।
জানা গেছে, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্পটি অনুমোদন থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পটির ত্রুটি, বিচ্যুতি, অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক সুবিধাও দেয়া হয়েছে নির্মাতা সংস্থার পক্ষ থেকে। বার বার এসব অনিয়ম চাপা পড়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন গাছাড়া ভাব নিয়েই ধীরগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু ভুল আর অনভিজ্ঞতার কারণে ভবিষ্যতে এই ফ্লাইওভার একটি অকার্যকর প্রকল্প হিসেবে দৃশ্যমান হওয়ার আশঙ্কা আছে।
সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্যাহ বলেন, গার্ডার পড়ে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকান্ড। দুর্ঘটনার কিছু নমুনা থাকে। এখানে তা নেই। সুতরাং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই হত্যাকান্ডের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সেই সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকেও এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। নিহতের পরিবারের জন্য কমপক্ষে দুই কোটি ও আহতদের পরিবারকে এক কোটি টাকা দেয়ার দাবি জানিয়ে প্রবীণ এই সমাজ বিজ্ঞানী বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া ঠিক হবে না।   
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্পটিতে কনসালটেন্ট নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের শর্ত থাকলেও প্রকল্পের ৮টি ধাপের কাজের মধ্যে মাত্র একটি ধাপের ডিজাইন ও সুপারভিশনের কাজে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে সময় এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ওয়াহিদুর রহমান। তিনি সরকারের উপর মহলের নাম ভাঙ্গিয়ে এই প্রকল্পের শুরু থেকেই দুর্নীতি করেন।  প্রকল্পের কনসালটেন্ট খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৫৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে টেন্ডারে কনসাল্টেন্সি খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বাকি প্রায় ৪২ কোটি ২৭ লাখ টাকাই টেন্ডার ছাড়া কনসাল্টেন্সি খাতে হয়েছে। এই টাকার বেশিরভাগই লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থাপত্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা ছিল ভুল। নির্মাণ কাজ ৫০ ভাগ শেষ হওয়ার পর ভুল ধরা পড়ার পর তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী বেকায়দায় পড়ে যান। তিনিই কৌশলে নকশা সংশোধনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। বিদ্যমান নকশা সঠিক বলে দাবি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ অব্যাহত রাখা হয়।  
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ সালের নভেম্বরে পরিকল্পনা কমিশন থেকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের র‌্যাম্প লোকেশন (ওঠানামার পথ) প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ তোলা হয়। এছাড়া ফ্লাইওভারে নির্মাণের ফলে ওই এলাকার যানজট নিরসন করে সীমাহীন দুর্ভোগ কতটা লাঘব হবে তা নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের সেসব মূল্যায়ন আমলেই নেয়নি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলজিইডি।
এলজিইডি সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের মূল নকশা তৈরি করেন কুয়েতের স্থপতি নরমেন পপ। ২০১২ সালে মার্কিন নাগরিক রবার্ট জে এফ ফ্লাইওভারটির কনস্ট্রাকশনের ডিজাইন করতে গিয়ে খুঁটির ওপরে সুপার স্ট্রাকচারে ভুল চিহ্নিত করেন। পরে বাংলাদেশ  প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এবং রবার্ট জে এফ মিলে প্রাথমিক ভুল সংশোধন করে আগের নকশাতেই কাজ শুরু করেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০০৫ সালে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের জন্য কুয়েত ফান্ডের ৪৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প থেমে যায়। এরপর ২০১০ সালে মগবাজার-মৌচাক এলাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হলে এলজিইডি ফ্লাইওভার নির্মাণে আগ্রহ দেখায়।
সূত্র জানায়, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ঠিকাদার নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশেই ঘটেছে দরপত্র কেলেংকারি। এই প্রকল্পের মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ অংশের প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১১ সালের ২২ মার্চ। যোগসাজশের মাধ্যমে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আহূত দরপত্র বাতিলের দাবি জানায় দাতাসংস্থা। তা না হলে প্রতিশ্রুতি অর্থ না দেয়ার হুমকি দেয় সংস্থাটি। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের ৫ মার্চ একই কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু ওই সময় বড় অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে সুকৌশলে পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘তমা কন্সট্রাকশন’কে কাজ পাইয়ে দেয়া হয়। যদিও তাদের আবেদনের যোগ্যতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ছিল। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, তমা কন্সট্রাকশনের ইতিপূর্বে এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা ছিল না। অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ায় ভুল-ভ্রান্তি, সময়ক্ষেণ, ভোগান্তি সবই বেড়েছে। তাদের মতে, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ ফ্লাইওভার নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হলে শুরুতেই ভুল ধরা পড়ত; সরকারের এ বিশাল পরিমাণ অর্থের অপচয় হতো না। এরকম দুর্ঘটনাও ঘটতো না। অভিযোগ রয়েছে তমা কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান মানিক একজন প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে যোগ্যতা না থাকার পরেও কাজ বাগিয়ে নেন। এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। অথচ বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলুর হাত ধরে তার উত্থান বলে জানা গেছে। ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনা প্রসঙ্গে মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা এই হতাহতের দায় এড়াতে পারে না। তারা বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। কোনো প্রকার নিরাপত্তাবেস্টনী ছাড়াই তারা কাজ করছে, যা বিশ্বের কোথাও হয় না। তিনি তমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান মানিকের শাস্তি দাবি করে বলেন, কিছুদিন আগেও শাজাহানপুরে পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর দায়ে আদালত এক ঠিকাদারকে দন্ড দিয়েছে। আমরা চাই তমার মালিকেরও বিচার হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আমানউল্লাহ বলেন, মালিবাগের ফ্লাইওভার দেখলে বোঝা যায় উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর কাজ চললেও সেখানে কোনো মনিটরিং করা হয়নি। শুরু থেকেই এই প্রকল্পে দুর্নীতি ছিল বলেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বেপরোয়াভাবে কাজ করেছে। যার জন্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর দায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নিতেই হবে। তিনি বলেন, মগবাজার-মালিবাগসহ আশপাশের ৩০ লাখ মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তিতে রেখেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন। এজন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
উল্লেখ্য, রোববার দিবাগত রাতে রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম স্বপন (৪০)। আহত দু’জন হলেন প্রকৌশলী পলাশ ও পথচারী নূরন্নবী ও পলাশ। ইতোমধ্যে প্রকৌশলী পলাশের বাম পা কেটে ফেলা হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।



 

Show all comments
  • Mohammed faridul alam ১৪ মার্চ, ২০১৭, ৮:১৪ এএম says : 0
    It's very bad for country. Government needs find corruption people and fear justice. Remember no excuse them. Thanks.
    Total Reply(1) Reply
    • MUSTAFIZ ১৫ মার্চ, ২০১৭, ৮:২৯ এএম says : 4
      Engineer Polas dadar obostha vabtei parsi na..parsi na mante aj k tar ay injured obosthar jonno..parben ki kono Engineer ...pray for him..Pls all of us pray for our polas dada.
  • আজিজ ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:১২ এএম says : 0
    এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠিন পদক্ষেপ আশা করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamrul Hasan ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৪৯ এএম says : 3
    এখন হাচান মাহমুদ কি বলবেন তিনি এখন নিশ্চয় বলবেন বি এন পির ব্রিফিং নিউজের ধাক্কায় ফ্লাইওভারটা ধ্বসে পরে গেছে
    Total Reply(0) Reply
  • Nuri Al Noufel ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৪৯ এএম says : 0
    আওয়ামী নেতা মির্জা আজম এর প্রতিষ্টান এখন কেন তাকে গ্রেফতার কেন করা হচ্ছে না ?
    Total Reply(0) Reply
  • Jashim Uddin ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫০ এএম says : 0
    তমা কন্সট্রাকশন এর মালিককে আশির্বাদ করা হয়েছে তাই তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, নেই কোন পুর্ব অবিজ্ঞতাও, তবুও তাকে দেয়া হলো ওয়ার্ক অডার,,
    Total Reply(0) Reply
  • Nurul Haque ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫১ এএম says : 0
    AE shorkarer hate jamon desh O jati nirapod na kaj kam O nira pod na One noaner name hosse lot pat
    Total Reply(0) Reply
  • Shiddik Abu ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫২ এএম says : 0
    জনগণ উন্নয়ন এর জোয়ারে ভাসছে....
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Saleh Bablu ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫৩ এএম says : 0
    এটাই হলো ..............র উন্নয়নের নমুনা ? চুরি আর লুটপাট হচ্ছে হিসাব ছাড়া ???
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Towahar Rajib ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫৩ এএম says : 0
    Fully corrupted Toma Construction..we want justice..
    Total Reply(0) Reply
  • Sheikh Mostofa Nazrul ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫৪ এএম says : 0
    Safety first. Sloogan dile cholbena, kaje proman dite hobe
    Total Reply(0) Reply
  • Shah Jalal ১৪ মার্চ, ২০১৭, ১১:৫৪ এএম says : 0
    toma construction ekta baje construction
    Total Reply(0) Reply
  • Md.Faruque Ahmed ৪ জুন, ২০১৭, ৬:০৯ পিএম says : 0
    Even than this people wants get nomination from present rolling party.and it will be happen in Noakhali Awami league.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ