চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
লে. কর্নেল আকম জাহিদ হোসেন (অব:)
\ এক \
আদিকাল থেকেই মাদকদ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বিদ্যমান ছিল। প্রচীনকাল থেকেই মানুষ মাদকদ্রব্য সেবন করে আসছে। কখনো কখনো এটাকে নেশা, প্রবল আসক্তি, বিলাসিতা, আনন্দ ও উৎসবের উপাদান হিসেবে পান করে থাকে। প্রাক ইসলামের যুগে মদ্যপানের ব্যবহার ব্যাপক ছিল। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার-পরিজন সবাই একত্রে মিলে মদ্যপান করত। ইসলাম আবির্ভাবের পর মাদকদ্রব্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রায় এক হাজার বছর আগে মানুষ মাদক সেবন হিসেবে পপির রস ও স্বাদ গ্রহণ করত। তখনও মরুফিন বা হিরোইন আবিষ্কার হয়নি। দক্ষিণ আমেররিকার কোকো গাছ থেকে কোকেন তৈরি করার অনেক আগে সেখানকার আদিমবাসীরা কোকো পাতা চিবিয়ে খেত। মেক্সিকোতে বসবাসকারী ভারতীয়রা (Azteo) খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালে (Hallucinogemic psilocybin mashrooms) নামে এক প্রকার উদ্ভিদের রস বা স্বাদ গ্রহণ করত। আধ্যাত্মিক সাধনা ও ধর্মীয় উৎসবে একে তারা বলত ইশ্বরের দেহ মাংস (Flesh of the Gods)। আমেরিকার গীর্জাগুলোতেও এবং ওই অঞ্চলগুলোতে peyote ক্যাকটাস ব্যবহারের নিয়ম ছিল। শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি ও দুঃখ-কষ্ট থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণের জন্য ওই অঞ্চলের লোকরা এসব উদ্ভিদ ব্যবহার করত। একেক ধর্ম, গোত্র একেক রীতিনীতিতে এটি ব্যবহার করত। তবে, এটার ব্যবহার সীমিতগন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমান্বয়ে এটার ব্যবহার পরিধি, বিস্তৃতি লাভ করে আশঙ্কাজনকরূপ ধারণ করতে লাগল। এক সময়ে এর ব্যবহারের কারণে নির্দিষ্ট এলাকায় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। বর্তমানে এর ব্যবহার ও বিস্তৃতির কারণে এখন গোটা পৃথিবীতে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামের প্রথম যুগে জাহেলিয়াতের আমলে মদ্যপান করা অত্যন্ত সাধারণ ও মামুলী ব্যাপার ছিল। অতঃপর নবীজি (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে যখন পবিত্র মদীনা নগরীতে আগমন করেন, তখনও মদীনাবাসীদের মধ্যে মদ ও জুয়া খেলার প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করলে যে অকল্যাণ ও অমঙ্গল হবে তখন তাদের এমন কোন ধারণাই ছিল না। মদ্যপান ও জুয়া খেলা তখন পারিবারিক ও সামাজিক এক সাধারণ রীতিনীতি ছিল। এটাকে তারা কোন রকম খারাপ মনে করত না। তবে, আল্লাহ তা’য়ালার নিয়ম হচ্ছে এই যে, প্রতিটি জাতি ও প্রতিটি অঞ্চলে কিছু বুুদ্ধি বিবেকমান ব্যক্তিও থাকেন, যারা বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগিয়ে রীতিনীতি ও অভ্যাসের উপরে স্থান দেন। যদি কোন রীতিনীতি ও অভ্যাস বুদ্ধি বিবেকের পরিপন্থী হয়, তবে সে আভ্যাসের ধারে কাছেও তারা যান না। এ ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)’র স্থান ছিল সকলের ঊর্ধ্বে। কেননা যেসব বস্তু অবিষ্যতে কোন কালে হয়তো হারাম হবে, সেসব বস্তু তার কাছে সর্বদাই ঘৃণার বস্তু ছিল। সাহাবীদের মধ্যে এমন অনেক সাহাবী ছিলেন ওই সময়ে এটি হালাল থাকা সত্তে¡ও তারা এসব বস্তু ব্যবহার বা স্পর্শ করা থেকেও বিরত থাকতেন। মাদকদ্রব্য তিন প্রকার। যথা- ১। খামর। এটি আরবী শব্দ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আবৃত করা বা ঢেকে দেয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় আঙ্গুরের কাঁচা রস আগুনে জ¦াল দিয়ে ফুটানোর পর তাতে ফেনা সৃষ্টি হলে তাকে খামর বলে। খামর অল্প হোক পান করা হারাম। এর বেচা-কেনা নাজায়ের বা হারাম। এমন মাদকদ্রব্য আছে যা প্রকৃত খামর (মদ) নয়। তবে, খামরের সাথে সাদৃশ্য। এগুলো আবার তিন প্রকার- ১। তিলা (আরবী শব্দ) : আঙ্গুরের রস পাকানোর পর যদি দুই তৃতীয়াংশের মত শুকিয়ে যায়, তবে একে তিলা বলে। ২। নাকীউত তামার (আরবী শব্দ) : শুকনা খেজুরের শরাব পানিতে ভিজিয়ে তৈরি করা হয়। ৩। নাকীউয যাবীব (আরবী শব্দ) : কিসমিস কয়েক দিন পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর তাতে ভাপা সৃষ্টি হয়, তখন একে নাযীউয যাবীব বলে। এসব শরাবসমূহ কম-বেশি সবই হারাম এবং তা নাপাকও বটে। এ জাতীয় শরাব বা মদ বেচা-কেনাও জায়েয নেই। কার্যকরীতা ও প্রতিক্রিয়া অনুসারে অধুনা বিশ্বে প্রচলিত মাদকদ্রব্যগুলোকে কয়েক শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন ১। চেতনানাশক বেদনা উপশমকারী মাদকদ্রব্য, ২। মনোউদ্দীপক বা উত্তেজক মাদকদ্রব্য, ৩। অবসাদ সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য, ৪। স্নায়ুবিক উত্তেজক প্রশমনকারী মাদকদ্রব্য, ৫। বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য। ৬। নাসিকা রন্দ্রে গ্রহণযোগ্য মাদকদ্রব্য এগুলো প্রত্যেকটি আবার বিভিন্ন ধরনের রয়েছে : ১। চেতনানাশক, বেদনা উপশমকারী মাদকদ্রব্য আফিম,,মরুফিন, হিরোইন এবং ফেনসিডিল ইত্যাদি। ২। মনোউদ্দীপক বা উত্তেজক মাদকদ্রব্য- এম ফেটামিনস ও কোকেন ইত্যাদি। ৩। অবসাদ সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য= বার বিচ্যুরেটস ও মেথাকোয়ালোন ইত্যাদি। ৪। স্নায়ুবিক উত্তেজক প্রশমনকারী মাদকদ্রব্য- জায়া জিপাম, নাইট্রাজিপাম ও ক্লোর ডায়াজিপোক্সাইড ইত্যাদি। ৫। বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য- ক্যানবিস গাঁজা, হাশিশ, মারিজুয়ানা, ভাং ও এলএসডি। ৬। নাসিকা রন্দ্রে গ্রহণযোগ্য মাদকদ্রব্য- এরোসোলস, লাইটার ফ্লুইড, বার্ণিল রিমোভার, নেল পালিশ রিমোভার, পেইন্ট, থিনার, স্পোট রিমোভার, ক্লিনিং সল্যুশন্স, গুল ইত্যাদি। এ জাতীয় দ্রব্যসমূহ ইনহেলন্টরূপে ব্যবহৃত হয়। এগুলো শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি হওয়া নিশ্চিত। তাই হানাফী মাযহাবে জনৈক ফকীহ বলেছেন : যে ব্যক্তি বলবে, হাশিশ হালাল সে ধর্মদ্রোহী ও বিদাতী। এসব নেশাকর দ্রব্য সেবন করা প্রকারান্তে নিজেকে হত্যা করার শামিল। নিজেকে হত্যা বা ধ্বংস করা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনুল করীমে আল্লাহপাক বলেন এবং তোমরা নিজের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না। (সূরা বাকারা : ১৯৫)। উল্লেখ্য যে, শারীরিক ও মানসিক রোগীকে চিকিৎসক যদি অপরিহার্য ওষুধ হিসেবে ব্যবস্থাপত্র দান করেন এসব দ্রব্য গ্রহণ করতে বললে তা গ্রহণ করা বৈধ হবে।
মদ সম্পর্কে কোরআনুল করীমে চার খানা আয়াত নাযিল হয়েছে। মদ সম্পর্কে প্রথমে যে আয়াত নাযিল হয়, তাতে মদের বৈধতার আভাস ছিল। আয়াতটি মক্কা মোকাররমায় অবতীর্ণ হয়। ইরশাদ হয়েছে- এবং খেজুর বৃক্ষের ফল ও আঙ্গুর থেকে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য সংগ্রহ করে থাক, তবে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (সূরা নাহল : ৬৭)। তখন মদ অবৈধ ছিল না বিধায় মুসলমানদের অনেকেই সে সময়ে মদপান করতেন। পরবর্তী সময়ে হযরত ওমর, মুয়ায ইবন জাবাল (রা.) এবং আরো কতিপয় সাহাবী (আ.) বলছেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদের ব্যাপারে আমাদেরকে ফতোয়া দিন। এতে আকল নষ্ট হয় এবং মাল ধ্বংস হয়। তখন নাযিল হয়, লোকে আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকার আছে। কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। (সূরা বাকারা : ২১৯)। এ আয়াতে নাযিল হওয়ার পর কেউ মদপান করা ছেড়ে দেন আবার কেউ পূর্ববৎ মদপানে অভ্যস্ত থাকেন। এ সময়ে হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) কতিপয় সাহাবীকে দাওয়াত করেন। তারা খাওয়া দাওয়ার পর মদপান করেন। এবং উম্মাদ হয়ে পড়েন। এ সময় তাদের কোন একজন নামায পড়তে গিয়ে পাঠ করে ফেলেন কুল ইয়া আইওহাল কাফেরুনা আয়বুদু মা তায়বুদুনা। অর্থাৎ লা অক্ষরটি বাদ দিয়ে পাঠ করেন। তখন আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনুল করীমে এ আয়াত নাযিল করেন- হে মুমিনগণ! মদপানোত্তর মাতাল অবস্থায় তোমরা নামাযের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার। (সূরা নিসা : ৪৩)। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদ্যপায়ী লোকদের সংখ্যা প্রচুর হ্রাস পায়। পরবর্তীতে ওসমান ইবনে মালিক (রা.) একজন আনসারী সাহাবীকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। তারা খানা খাওয়ার পর মদপান করে উন্মাদ হয়ে পড়েন। এ সময় হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। এতে তিনি আনসারদের দোষারূপ করে নিজেদের গুণগান করেন। এ কবিতা শুনে এক আনসারী যুবক রাগ করে উটের গন্ডাদেশের একটি হাড় হযরত সা’দ (রা.)’র মাথায় ছুড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে হযরত সা’দ (রা.) নবীজি (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করেন। তখন নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বিধান বলে দিন। তখনই আল্লাহ তা’য়ালা এ আয়াত নাযিল করেন- হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক সব ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর তা হলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।