চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব : সুখী-সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ দাম্পত্য জীবন সকলেরই কাম্য। ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সকলকে উৎসাহ প্রদান করে। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যখন ভারসাম্যহীন, পারস্পরিক মনোমলিন্যতা ও সাংসারিক তিক্ততা দেখা দেয়, তখন একত্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য বিবাহ চুক্তির অবসান ঘটানোর সুযোগ ইসলাম রেখেছে। ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা রাখলেও তালাক প্রদানে উৎসাহিত করা হয়নি। এটা নিরুপায়ের মাঝে উপায় হিসেবে গণ্য। শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তালাকের পরিচয় এবং হুকুম পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
তালাকের পরিচয়
তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধনমুক্ত করা। শরীয়তের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা। তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষের অর্থাৎ স্বামীর। আর স্ত্রীর অধিকার খুলা করার। খুলার আভিধানিক অর্থ খসিয়ে নেওয়া, টেনে বের করে ফেলা। আর শরীয়তের পরিভাষায় স্বামীকে কিছু মাল দিয়ে নিজকে স্বামীর বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে নেয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তবে তাদের উপর কোনো গুনাহ হবে না যদি স্ত্রী স্বামীকে মাল দিয়ে নিজকে ছাড়িয়ে নেয়’। সূরা বাকারা : ২২৯তাছাড়া স্বামীর অর্পিত ক্ষমতাবলেও স্ত্রীর তালাক দেয়ার ক্ষমতা আছে।
তালাক প্রদানে ইমামদের মতভেদ
ইমাম আবূ হানিফা ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে খুলা মূলত তালাক। পক্ষান্তরে ইমাম আহম্দ ও শাফিঈ (রহ.)-র বর্ণনামতে খুলা তালাক নয়; বরং এটা বিবাহকে ফিসক করে তথা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়।
তালাক বা খুলার প্রয়োজনীয়তা
পারিবারিক জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে একজন নর ও একজন নারী। এই দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয় বা একে অপরের জীবন সাথী হিসেবে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা হয় বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে। উভয়ের সুখ-শান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক মত বিনিময় ও দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপের মধ্যে উভয়ের আচার-আচরণ ও পারস্পরিক চাহিদার ভিত্তিতে দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে। সাংসারিক জীবনের উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের উপর নির্ভরশীল স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি। কিন্তু যদি উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের অবহেলা দেখা দেয় বা একে অপরের মতের সাথে একমত না হয় একে অপরের আচরণের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে না পারে। যার কারণে উভয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তির পরিবর্তে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। পারছে না তারা সুখের নীড় রচনা করতে, এমতাবস্থায় বা অন্য কোনো কারণে যদি কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ কামনা করে, তাহলে ইসলাম সে ব্যবস্থা করেছে তালাক বা খুলার মাধ্যমে। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়, তা হলে যুক্তিসঙ্গত নিয়মে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্যে তালাক বা খুলার বিধান রাখা হয়েছে। তালাক দেবার অধিকারী হচ্ছে একমাত্র স্বামী। আর খুলা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্ত্রী নিজেকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক স্বামী তালাক দিলে সে তালাক কার্যকরী হবে। কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা পাগল স্বামী তালাক দিলে তা কার্যকরী হবে না।
ইসলামে তালাকের স্থান
যদিও ইসলামে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্যে তালাকের বিধান রয়েছে, তবুও ইসলাম তালাককে জায়েজ কাজসমূহের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই যথাসম্ভব উক্ত জায়েজ ঘৃণিত কাজ থেকে বেঁচে থাকা উচিত এবং সমাজে তালাক যাতে বেশি পরিমাণে না হয় তার চেষ্টা করা উচিত। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “হালাল বিষয়সমূহের মধ্যে আল্লাহতায়ালার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত বিষয় হচ্ছে তালাক” (আবু দাউদ)। বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রতিরোধকল্পে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আরেকটি হাদিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আলী (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “বিবাহ করো কিন্তু তালাক দিও না। কেননা তালাকের কারণে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে।” ‘হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, বিশেষ অসুবিধা ব্যতীত যে স্ত্রী তাঁর স্বামীর নিকট তালাক চায় তার জন্য বেহেশতের সুঘ্রাণও হারাম হয়ে যায়’ (তিরমিযি)। “কোনো মুুমিন (স্বামী) কোনো মুমিনাকে (স্ত্রী) যেনো অপছন্দ না করে। সে তার কোনো বৈশিষ্ট্যকে অপছন্দ করলেও তার অন্য বৈশিষ্ট্য সন্তুষ্ট হবে”। (সহীহ মুসলিম) তালাক প্রদানের বিধান শরীয়াত কর্তৃক অনুমোদিত হলেও চ‚ড়ান্ত প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মনোমালিন্য ও বিরোধ দূর করার কয়েকটি পথ বলে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
“তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহর কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অন্বেষণ করো না” (সূরা নিসা : ৩৪) ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিস্পত্তি চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত’ (সূরা নিসা : ৩৫)।
তালাকের প্রকারসমূহ
তালাক একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর নর-নারীর দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও শান্তিময় করে তোলার জন্য এবং একটি পারিবারিক জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনে তালাকের পথ গ্রহণ করা যায়। তালাককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (ক) তালাকে আহসান, (খ) তালাকে হাসান বা ভালো তালাক এবং তালাকে বিদ’আত।
এক তালাক প্রধান করে মুদ্দত অতিক্রান্ত করাকে আহসান তালাক বলে। তিন তুহূরের মধ্যে তিন তালাক প্রধান করাকে তালাকে বিদ’আত বলে। তিন তালাকে সীমাবদ্ধ থাকলে স্ত্রীকে পুনরায় বিনা আকদে গ্রহণ করা যায়। তবে ‘বায়েন’ বললে নতুন আকদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বায়েন তালাক
যদি এক বা দুই তালাক বায়েন ছাড়া বলে, তাহলে ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ না করেই গ্রহণ করা যায়। আর যদি বায়েনসহ তালাক বলে, তাহলে পুনরায় বিবাহ করে স্ত্রীকে গ্রহণ করতে হয়। বায়েনসহ তালাক দিলে পুনরায় বিবাহ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ থাকায় এই তালাককে মুখাফ্ফাফ বায়েন বা হালকা বায়েন বলে।
মুগাল্লাযা বায়েন তালাক
একসাথে তিন তালাক দেয়াকে মুগাল্লাযা বায়েন তালাক বলে। একসাথে তিন তালাকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে আর পুনরায় ঘর করা যাবে না। আর সেই তালাক সাথে সাথেই পূর্ণ হয়ে গেল। পুনরায় বিবাহ করে ঘর-সংসার করার আর কোন সুযোগ থাকলো না। তবে যদি ভবিষ্যতে উক্ত মহিলার অন্যের সাথে বিবাহের পর পুনরায় সে যদি তালাকপ্রাপ্ত হয় বা তার স্বামী মারা যায়, তাহলে সে প্রথম স্বামীর সাথে ইচ্ছা করলে বিবাহ বসতে পারবে বা উক্ত পুরুষ তাকে ইচ্ছা থাকলে বিবাহ করে ঘর করতে পারবে।
রিজয়ী তালাক
‘রিজয়ী’ শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তনযোগ্য। এটা এমনি ধরনের তালাক যা প্রয়োগ করলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা যায়। বায়েন ছাড়া এক বা দু’তালাককে রিজয়ী তালাক বলে। ইদ্দতের মধ্যে উভয়ে একমত হলে পুনরায় স্বামী-স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে ঘর-সংসার করতে পারবে, পুনরায় আর কোন বিবাহের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু ইদ্দত পুরা হয়ে গেলে এই তালাক বায়েক তালাকে পরিণ হয়ে যায়। তখন স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চাইলে বিবাহের প্রয়োজন হবে। বিনা বিবাহে গ্রহণ করা যাবে না। আর পুনরায় না আনার ইচ্ছা করলে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।
যদি এক তালাক দিয়ে স্ত্রীকে ইদ্দতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনে তারপর আবার তাকে আরেক তালাক দিল, এং ফিরিয়ে আনলো। তারপরও আবার আরেক তালাক দিল। এবার তাকে আর বিনা বিবাহে তো দূরের কথা, বিবাহ করেও আনা জায়েজ হবে না।
তালাকের শব্দ
তালাকে দু’ধরনের শব্দ ব্যবহার করা যায়। প্রথমত, অর্থবোধক প্রকাশ্য শব্দ যাতে প্রকাশ্যে তালাক বোঝা যায়। যথা : কেউ বলল, আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিলাম। দ্বিতীয়ত, এমনি শব্দ যার একাধিক অর্থ হতে পারে। উক্ত শব্দ দ্বারা তালাক নির্ভর করে তালাকদাতার নিয়্যতের উপর। যথা : কেউ বলল, “আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও বা তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও” ইত্যাদি আরো অনেক প্রকার শব্দ হতে পারে। এ সব শব্দ দ্বারা তালাক নির্ভর করে তালাকদাতার নিয়্যতের উপর।
আর প্রকাশ্য শব্দ দ্বারা তালাক দিলে এবং উক্ত শব্দগুলো যতবার বলবে, ততবার তালাক হবে। যথা : কেউ যদি তার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে, “তোমাকে তালাক দিলাম”, “তোমাকে তালাক দিলাম”, তারপর যদি বলে তোমাকে “তোমাকে তালাক দিলাম”। তাহলে সর্বমোট তিনবার তালাক বলায় তিন তালাক হয়ে যাবে। প্রকাশ্য শব্দগুলো যদি হাসতে হাসতে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে এবং মনে নিয়্যত না থাকে তবুও তালাক হয়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।