চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
তাহসিনা নূর
॥ এক ॥
‘ভালবাসা’ এক পবিত্র জিনিস যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর পক্ষ হতে আমরা পেয়েছি। ‘ভালবাসা’ শব্দটি ইতিবাচক। আল্লাহ তা‘আলা সকল ইতিবাচক কর্ম-সম্পাদনকারীকে ভালবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘এবং স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ো না। তোমরা সৎকর্ম কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ মুহসিনদের ভালবাসেন।’’১৪ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে ভুলের পর ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পবিত্রতা অবলম্বন করা এ দুটিই ইতিবাচক কর্ম। তাই আল্লাহ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরও ভালবাসেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন।’’ ১৫ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২২২) তাকওয়া সকল কল্যাণের মূল। তাই আল্লাহ মুত্তাকীদের খুবই ভালবাসেন। তিনি বলেন, ‘‘আর নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন।’’ ১৬ (সূরা আল ইমরান, আয়াত : ৭৬) পবিত্র এ ভালবাসার সাথে অপবিত্র ও নেতিবাচক কোন কিছুর সংমিশ্রণ হলে তা আর ভালবাসা থাকে না, পবিত্রও থাকে না; বরং তা হয়ে যায় ছলনা, শঠতা ও স্বার্থপরতা। ভালবাসা, হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সুতোর টান। কোন দিন কাউকে না দেখেও যে ভালবাসা হয়; এবং ভালবাসার গভীর টানে রূহের গতির এক দিনের দূরত্ব পেরিয়েও যে দুই মুমিনের সাক্ষাৎ হতে পারে তা ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার এক বর্ণনা থেকে আমরা পাই। তিনি বলেন, ‘‘কত নি‘আমতের না-শুকরি করা হয়, কত আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হয়, কিন্তু অন্তরসমূহের ঘনিষ্ঠতার মত (শক্তিশালী) কোন কিছু আমি কখনো দেখি নি।’’ ১৭ (ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ : হাদীস নং ২৬২)
ভালবাসার মানদ- : কাউকে ভালবাসা এবং কারো সাথে শত্রুতা রাখার মানদ- হলো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসতে হবে এবং শত্রুতাও যদি কারো সাথে রাখতে হয়, তাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই। এটাই শ্রেষ্ঠ কর্মপন্থা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা রাখা।’’ ২৫ (আহমদ, মুসনাদুল আনসার, হাদিস নং ২০৩৪১) ঈমানের পরিচয় দিতে হলে, কাউকে ভালবাসবার আগে আল্লাহর জন্য হৃদয়ের গভীরে সুদৃঢ ভালবাসা রাখতে হবে। কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আল্লাহ্র সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার মত তাদের ভালবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসায় তারা সুদৃঢ়।’’ ২৬ (সূরা আল-বাকারা: ১৬৫) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসতে হবে, নতুবা কোন ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়।”
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে প্রিয় হওয়া।
২. শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসা।
৩. কুফুরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করা।’’ ২৭ (বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং: ১৫)
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালবাসার ফযীলত : আল্লাহ রাব্বুল ইয্যতের মহত্ত্বের নিমিত্তে যারা পরস্পর ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে, কিয়ামতের দিন তাদের তিনি তাঁর রহমতের ছায়ায় জায়গা দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, আমার মহত্ত্বের নিমিত্তে পরস্পর ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদের আমার বিশেষ ছায়ায় ছায়া দান করব। আজ এমন দিন, যে দিন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া নেই।’’ ২৮ (মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াস-সিলাহ, হাদিস নং ৪৬৫৫) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা নবীও নয় শহীদও নয়; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাঁদের সম্মানজনক অবস্থান দেখে নবী এবং শহীদগণও ঈর্ষান্বিত হবে। সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের বলুন, তারা কারা? তিনি বলেন, তারা ঐ সকল লোক, যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসে। অথচ তাদের মধ্যে কোন রক্ত সম্পর্কও নেই এবং কোন অর্থনৈতিক লেনদেনও নেই। আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় তাঁদের চেহারা হবে নূরানি এবং তারা নূরের মধ্যে থাকবে। যে দিন মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে, সে দিন তাঁদের কোন ভয় থাকবে না। এবং যে দিন মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে, সে দিন তাঁদের কোন চিন্তা থাকবে না...।’’ ২৯ (সুনানু আবী দাঊদ, কিতাবুল বুয়ূ‘, হাদিস নং ৩০৬০) পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি করার উপায় : ইসলাম বলে, পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য স্থাপিত না হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া যায় না, শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা যায় না, এমনকি জান্নাতও লাভ করা যাবে না। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য একটি চমৎকার পন্থা বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হবে, তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য স্থাপন করবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের কথা বলব না, যা করলে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে? সাহাবীগণ বললেন, নিশ্চয় ইয়া রাসূলাল্লাহ! (তিনি বললেন) তোমাদের মধ্যে বহুল পরিমাণে সালামের প্রচলন কর।’’ ৩০ (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং ৮১)
বিশ্ব ভালবাসা দিবস কি? বিশ্ব ভালবাসা দিবস বললে বুঝা যায় যে, ভালবাসার অভাবের কারণেই ঘনঘটা করে ভালবাসা পালন করা হয়। কারণ মানুষ যা হারায় বা পায় না তার প্রতি লালায়িত ও আকাক্সিক্ষত থাকে। তাই প্রাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পারিবারিক কাঠামো নেই। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালবাসার লেশমাত্র নেই। এ জন্য তারা ভালবাসা খুঁজে বেড়ায়। বিশ্ব ভালবাসা দিবস এখন ‘বিশ্ব বেহায়া’ দিবস হিসেবে গণ্য। বিশেষ করে মুসলিম সমাজের জন্য। কারণ মুসলমানের জন্মেই হয়েছে ‘ভালবাসা’র মধ্য দিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর দুর্বিনীত মহব্বতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘য়ালা সন্তান দান করেন। এরপর তাকে প্রতিপালনের বিধিবিধান আরোপিত করা হয়েছে। তাই সন্তান পিতা-মাতার গভীর ভালবাসা, আদর, স্নেহ ও মায়া-মমতার চাদরে বড় হয়। এ জন্য মুসলমানের নতুন করে ভালবাসা দিবস পালন অযৌক্তিক। আল্লাহ্ তা‘য়ালা বলেন- ‘আর আল্লাহ্ তা‘য়ালার নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হলো তিনি তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা, হৃদ্যতা ও মমতা স্থাপন করে দিয়েছেন।’ ৩২. (সূরা আর-রুম, আয়াত নং: ২১) আল্লাহ্ তা‘য়ালা বলেন, “তারা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক।” ৩৩ (সূরা বাকারা, আয়াত নং : ১৮৭)
নারীরা পুরুষের অর্ধাঙ্গ। রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছেন- “নারীরা পুরুষের অংশ।’ ৩৪ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৩৬) তাই মুমিনদের জন্য সতী-সাধবী নারী অমূল্য সম্পদ। রাসূল (সা.) বলেছেন- “মুমিনদের জন্য তাকওয়ার পর সবচেয়ে উত্তম জিনিস হল সতী-সাধবী নেককার স্ত্রী। এমন স্ত্রী যে স্বামীর আদেশ মেনে চলে, স্বামী তার দিকে তাকালে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার নিজের ও স্বামীর সম্পদ হেফাজত করে।” ৩৫ (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদিস নং: ১৮৫৭) এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘য়ালা আরও বলেন- “সতী-সাধবী রমণীগণ স্বামীদের অনুগত হয়ে চলে এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ যা হেফাযত করার জন্য বলেছেন তা হেফাযত করে।” ৩৬ (সূরা নিসা, আয়াত নং: ৩৪)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।