Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন অটুট

মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

| প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফুলেল অভ্যর্থনা : সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
কূটনৈতিক সংবাদদাতা : বাংলাদেশ ফিলিস্তিনীদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় সমর্থন করে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য বাংলাদেশের যে ‘চিরন্তন’ সমর্থন আছে, তাও অব্যাহত থাকবে। ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের এ প্রত্যয়ের কথা জানান। মাহমুদ আব্বাস এসময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান ও রাষ্ট্র হিসেবে দেশটিকে স্বীকৃতি না দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, দুই নেতা এসময় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত মরহুম নেতা ইয়াসির আরাফাতের সমর্থনের কথা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন।
গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘করবী’ হলে দু’দেশের মধ্যে আন্তঃসরকার যৌথ কমিটি বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সফররত ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের উপস্থিতিতে এ স্মারকে সই করেন বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও ফিলিস্তিনের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল মালিকি। এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসের একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৩টা ২৩ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে তার কার্যালয়ে আসেন ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট। তাকে টাইগার গেটে ফুলেল অভ্যর্থনা জানান শেখ হাসিনা। এরপর দুই নেতা লাল গালিচায় হেঁটে ভেতরে যান। প্রথমে মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে শেখ হাসিনার একান্ত বৈঠক হয়। এরপর তারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে ৪টা ২৫ মিনিটে করবী হলে আসেন শেখ হাসিনা ও মাহমুদ আব্বাস। ৪টা ২৬ মিনিটে তাদের উপস্থিতিতে সমঝোতা স্মারকটি সই হয়। এরপর দুই নেতা বেরিয়ে আসেন। এসময় মাহমুদ আব্বাস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাখা পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এর কিছুক্ষণ পরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছেড়ে যান ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নতুন করে বসতি স্থাপনের উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে ‘আন্তঃসরকার যৌথ কমিটি’ বিষয়ক যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার মাধ্যমে দু’পক্ষের পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্টের এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। ব্রিফিংয়ে সূচনা বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
শহীদুল হক বলেন, প্যালেস্টাইন দেশটি এখন বিশেষ ক্রিটিকাল অবস্থায় আছে। বিশেষ করে ইসরাইলের আগ্রাসনবাদী পদক্ষেপের ফলে যে টু স্টেট সলিউশনের কথা আমরা অনেক দিন ধরে শুনে আসছিলাম; তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার দুই রাষ্ট্রÑ প্যালেস্টাইন একটা রাষ্ট্র হবে, ইসরাইল একটা রাষ্ট্র হবে; এই যে বহু আগে গৃহীত যে সিদ্ধান্ত, তার প্রতি পুনরায় আমাদের সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য বাংলাদেশের যে ‘চিরন্তন’ সমর্থন আছে, তাও অব্যাহত থাকবে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।
নতুন করে সেটেলমেন্ট হওয়ার যে উদ্যোগ ইসরাইল নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তার নিন্দা করেছেন, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনীদের নেতা ইয়াসির আরাফাতের গভীর বন্ধুত্বের কথাও মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকে স্মরণ করেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইয়াসির আরাফাতের যে সমর্থন, তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াসির আরাফাতের যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, সে বিষয়টিও তিনি বৈঠকে তুলে ধরেছেন। ইসরাইলকে এখনও স্বীকৃতি না দেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন বলে শহীদুল হক জানান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্যালেস্টাইন কিন্তু ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করেছে। বাংলাদেশ স্বীকৃতি দান করেনি। বাংলাদেশ তখনই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে, যখন দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
ফিলিস্তিনী শিক্ষার্থীদের বহুদিন ধরে বাংলাদেশে বৃত্তি দেয়ায় বৈঠকে মাহমুদ আব্বাস কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন। দুই দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ের এই বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, মাহমুদ আব্বাসের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখছে ঢাকা। এই সফরের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের প্যালেস্টাইন জাতিসত্তার প্রতি যে চিরন্তন সমর্থন; সেটা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্টের শ্রদ্ধা
সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বাংলাদেশ সফররত ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। গতকাল দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে সাভারের নবীনগর জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন তিনি। এ সময় তাকে গার্ড অব অনার দেন সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশন। ১টা ৫৭ মিনিটে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তিনি। এরপর ১ টা ৫৯ মিনিটে তিনি পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করে স্মৃতিসৌধে একটি বকুল ফুলের গাছের চারা রোপণ করেন। ২টা ১০ মিনিটে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হকসহ সাভারের স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুর রহমান জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন।
উল্লেখ্য, তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত বুধবার বিকেলে ঢাকা পৌঁছান আব্বাস। বাংলাদেশে তার এটিই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। গতকাল বঙ্গবন্ধু যাদুঘর পরিদর্শন করেন মাহমুদ আব্বাস। সেখান থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান। এছাড়া গতকাল রাতে আব্বাস তার সম্মানে বঙ্গভবনে আয়োজিত এক রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নেন। আজ শুক্রবার সকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাবেন বলে কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রধান হিসাবে ইয়াসির আরাফাত একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে আছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ১৯৬৭ সালের মানচিত্র অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়ে আসছে। ঢাকা বরাবরই বলে আসছে, কোনো স্বার্থের ভিত্তিতে নয়, সংবিধানে বলা আদর্শের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে। গত ডিসেম্বরে ইসরাইলি বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবেও বাংলাদেশ সমর্থন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া নিয়ে উদ্বেগ এবং ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইসরাইলের বসতি স্থাপনের পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে পুরনো মিত্র বাংলাদেশ সফরে এলেন মাহমুদ আব্বাস।
বঙ্গভবনে নৈশভোজে মাহমুদ আব্বাস
সন্ধ্যা ৭টার দিকে বঙ্গভবনে পৌঁছালে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান আবদুল হামিদ। বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল হলে সৌজন্য সাক্ষাতের পর দরবার হলে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারপর অতিথীরা অংশ নেন ভোজে। মাহমুদ আব্বাসের সম্মানে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের দেয়া এই নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশ নেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদ, বিরোধীদলীয় নেতা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও এইচ টি ইমামও নৈশ ভোজে অংশ নেন। ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডিন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত ওয়ানজা ক্যাম্পোস দ্য নব্রেগার, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও বঙ্গভবনে এই অনুষ্ঠানে ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হোটেল সোনারগাঁওয়ের রান্না করা খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্টকে। ওই হোটেলের কর্মীরাই খাবার পরিবেশন করেন। দরবার হলের ওই নৈশভোজে ছিল আট ধরনের খাবার, যার মধ্যে ছিল স্মোকড ইলিশ। পাঁচ কোর্সের এই ভোজ শুরু হয় ‘স্মোকড হিলসা অন টোস্ট দিয়ে। এরপরে টেবিলে আসে ক্রিম অব মাশরুম স্যুপ। সঙ্গে ছিল ব্রেড অ্যান্ড বাটার।
মেইন কোর্সে প্রথমে টেবিলে আসে ফরাসি ডিশ ‘লবস্টার থারমিডরি’; যা পরিবেশন করা হয় মিক্সসড ভেজিটেবল ও বয়েলড পটেটোসহ। এর পর আসে মাটন কাচ্চি বিরিয়ানি ও রেশমি কাবাব; যা আলু বোখারার চাটনি ও মিক্সড সালাদসহ পরিবেশন করা হয়। ডেজার্টে ছিল বেকড চিজ কেক, পাটিসাপটা পিঠা আর ফ্রুট ককটেল, চা, কফি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেখ হাসিনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ