Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নগরীতে ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে

ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশনা মানছে না পুলিশ : যাতায়াতে চরম ভোগান্তি

| প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : মহাসড়ক থেকে এবার রাজধানীর রাজপথ দখল করতে বসেছে নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা। ডিএমপি সদর দফতরের ট্রাফিক বিভাগ থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা যাতে না চলে সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। সেই নির্দেশনা মানছে না পুলিশ। বরং অবৈধ এসব যান চলাচল করছে ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করেই।
নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরাÑ যাদের অধিকাংশই সরকারি দল বা অঙ্গ-সংগঠনের নেতা। নগরীর পাড়া মহল্লার অলি-গলিতে দুর্ঘটনার প্রধান উৎস এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এসব অবৈধ যানের ব্যাটারি চার্জ করা হয় অবৈধ বিদ্যুত সংযোগের মাধ্যমে। এতে করে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে। তাতে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সারা দেশের ২১টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, চাঁদের গাড়িসহ সিএনজি অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এক বছর আগে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হলেও মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চলাচল বন্ধ নিশ্চিত করা যায়নি।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের দাপটে মহাসড়কেও এসব অবৈধ যান চলাচল করছে। গত ২৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি আদেশ জারি করে। ওই আদেশে দেশের ১০টি জেলার মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়। মহাসড়কে ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করার আগে থেকেই এগুলো রাজধানীতে সমানে চলছে। এখন মৌমাছির মতো চেয়ে গেছে পুরো রাজধানী। নগরীর যে কোনো এলাকায় বের হলে ব্যাটারিচালিত এসব যানের ভিড়ে হাঁটাই যায় না। সাথে যোগ হয়েছে মোটরচালিত রিকশা। এই দুইয়ে মিলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছরও দুর্ঘটনায় এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকার অলি-গলিতে এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশার ছড়াছড়ি। এগুলো চলাচলে বাধা না দেয়ায় দিন দিন সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এগুলো ভিড়ে রাস্তায় পাশে হাঁটাও দুস্কর হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে নগরীর মিরপুর-১, ১০, বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখান, বনশ্রী, আজিমপুর, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড ও বাসাবো-মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, জুরাইন, শ্যামপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, রামপুরা, খিলগাঁও, সিপাহীবাগ, বনশ্রী, বাড্ডা, মেরুল বাড্ডা, মেরাদিয়াসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। আলাপকালে এসব যানের চালক ও মালিকরা জানান, গোপন টোলের মাধ্যমে চলে এসব যানবাহন। এ টোলের পরিমাণ স্থানভেদে ভিন্ন। প্রতিদিন ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে দেড়শ’ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা আছে এলাকাভেদে। নগরীর মিরপুর ১০ নং গোলচক্কর থেকে ইজিবাইক, প্রাইভেট সিএনজি ও চ্যাম্পিয়ন নামের কিছু বাস চলাচল করে। ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা হারে চাঁদা দিয়ে চলছে এসব অবৈধ যানবাহন। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় প্রায় ২০০টি চলাচল করে। এর মধ্যে কিছু চলে ১০ নং গোলচক্কর থেকে মিরপুর ১৪ হয়ে ভাষানটেক এবং কিছু মিরপুর ১৪ হয়ে কচুক্ষেত পর্যন্ত চলাচল করে। এ ছাড়া শতাধিক প্রাইভেট সিএনজি ও চ্যাম্পিয়ন বাস রুট পারমিট ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই চলাচল করে। মিরপুর ১১ নং সেকশনের পল্লবী মিডটাউন শপিং মলের সামনে থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা পর্যন্ত চলাচল করে প্রায় একশ’ ইজিবাইক। এ এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা। মিরপুর ১ নম্বর থেকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় চলে ১০০-১৫০টি ইজিবাইক। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন। তার নিয়োগকৃত লাইনম্যানরা প্রত্যেক ইজিবাইক থেকে টাকা আদায় করে।
রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে সিপাহীবাগ চলাচল করে ৭০টির মতো ইজিবাইক। এ ছাড়া বেশ কিছু লেগুনা চলাচল করে। যেগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এবং সেগুলোর ফিটনেসও নেই। লেগুনাগুলো রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে মাদারটেক প্রজেক্টের মুখ পর্যন্ত যায়। একজন ইজিবাইক চালক জানান, বাইক চলাচলের জন্য তারা প্রতিদিন ৫০ টাকা করে দেন। এ টাকা সিপাহীবাগের এক নেতা তাদের কাছ থেকে নেয়। এ ছাড়া তারা মাসে ২০০ টাকা করে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয়। সবুজবাগ থানার খিলগাঁও বিশ্বরোড থেকে বাসাবো হয়ে মাদারটেক, নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ ইজিবাইক চলাচল করে। প্রত্যেকটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে আশকোনা এলাকায় কয়েকশ’ ইজিবাইক চলাচল করছে। স্থানীয়দের মতে, এখানে ইজিবাইকের সংখ্যা ৫ শতাধিক। বিমানবন্দর রেলক্রসিং থেকে আশকোনা হয়ে বউড়া ও হলান পর্যন্ত চলাচল করে ২০০টির মতো ইজিবাইক। বিমানবন্দর রেল ক্রসিং থেকে দক্ষিণখান ও কাঁচকুড়া পর্যন্ত চলাচল করে ৩শ’ ইজিবাইক। এই এলাকায় ইজিবাইক চালানোর জন্য প্রতিদিন ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চালকরা জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইমরানের লোকজন এই টাকা তোলে। ইমরান হলেন দক্ষিণখান ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের ভাতিজা। শুধু তাই নয়, এই এলাকায় ইজিবাইক নামানোর সময় ১৬শ’ টাকা করে দিতে হয়।
নগরীর শ্যামপুর, কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার ইজিবাইক ও মোটরচালিক রিকশা চলাচল করে। কদমতলী থানা এলাকায় ইজিবাইকের বেশ কয়েকটি রুট চালু আছে। এর মধ্যে রায়েরবাগ ও মোহাম্মদবাগ রুটে চলাচল করে কমপক্ষে আড়াই হাজার ইজিবাইক ও রিকশা। রায়েরবাগের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে ডিউক ও সেলিম এবং মোহাম্মদবাগে নিয়ন্ত্রণ করে লিটন ও তার দুই ভাই। প্রতিদিন এখানে ইজিবাইক প্রতি ৩০ টাকা রিকশা প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এলাকাবাসীর হিসাব মতে, শুধু এই দুই রুট থেকেই মাসে তিন লাখ টাকার বেশি চাঁদা ওঠে। এছাড়া বড়ইতলা থেকে বিক্রমপুর প্লাজা, পোস্তগোলা থেকে পাগলা, ধোলাইরপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেইন রাস্তা থেকে মুরাদপুর হয়ে কোদারবাজার পর্যন্ত আছে একটি করে রুট। জানা গেছে, মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বডিগার্ড মাসুম। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে মাসুম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন হাজারেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারির চার্জ দেয়ার জন্য মুরাদপুর এলাকাতেই আছে কয়েকটি গ্যারেজ। যেগুলোতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া আছে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় বিদ্যুৎ চুরির নেপথ্যে নাসির ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্যারেজেই ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা আছে।
অন্যদিকে, ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করা হয় পাটেরবাগ, দনিয়া, রায়েরবাগ, ডেমরা, কাজলা, ভাঙ্গাপ্রেসসহ বিভিন্ন এলাকায়। দনিয়া এলাকায় হু হু করে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা। ভুক্তভোগীদের মতে, দনিয়া এলাকার অবস্থা দেখে মনে হয় না এটা রাজধানী শহর। মনে হয় কোনো মফস্বল শহরে বাস করছি আমরা। এসব যানবাহনের কারণে মানুষ চলাচলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। সকালে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় একই সাথে মানুষ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নগরী

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২২ এপ্রিল, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ