Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভাগ্য বদলের সোপান বঙ্গোপসাগর

| প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : বঙ্গোপসাগর। দ্য বে অব বেঙ্গল। ‘বাংলা’ দেশ বা ‘বেঙ্গলে’র (অবিভক্ত বাংলা) পাদদেশজুড়ে এই উপসাগর। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ কিনারা ঘেঁষে রয়েছে উপক‚ল, চর ও দ্বীপ, ব-দ্বীপ, উপদ্বীপ। যা গোটা দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সোপান। বর্তমান বিশ্বে স্থলভাগে সম্পদের মজুদ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার ফলে মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর-বিধৌত দেশসমূহ সামুদ্রিক সম্পদের (বøু-ইকোনমি) সুষ্ঠু আহরণের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সুবিধাজনক একটি ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার বলা হয় এদেশকে। মানুষের জীবনধারণসহ অফুরন্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ধারক এই বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মিমাংসার ফলে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক পানিসীমা (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন-ইইজেড) ও মহিসোপানের বাইরে সম্মুখভাগে স¤প্রসারিত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার, কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছে। এ বিষয়টিকে দেশের সামুদ্রিক সম্পদ আর সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর পথে বাংলাদেশের জন্য মহা সুযোগ হিসেবে দেখছেন পোর্ট শিপিং মেরিটাইম বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক সমুদ্র সম্পদ গবেষকরা বঙ্গোপসাগরকে বহু অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের সম্পদের খনি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সাগর উপসাগর মহাসাগর পরিবেষ্ঠিত দেশগুলো সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করেছে। পাল্টে দিয়েছে তাদের অর্থনীতির চেহারা। কিন্তু স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) দেশগুলো এসব ক্ষেত্রে ভাগ্যবঞ্চিত। বাংলাদেশ শুধুই নয়, সারাবিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষের অর্থনীতি, জীবিকাসহ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যেটি প্রধান নিয়ামক উপাদান তা হচ্ছে উপসাগর, সাগর, মহাসাগর এবং তাদের সাথে যুক্ত হাজার হাজার নদ-নদী, হ্রদ। পৃথিবীর মোট আয়তনের চারভাগের তিনভাগই পানি, একভাগ স্থল। মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, আয়-রোজগার, ঔষধি উপাদান, প্রোটিন ও পুষ্টির উৎস, পর্যটন ও পরিভ্রমণ, পণ্য পরিবহন ছাড়াও সমগ্র অর্থনীতির বিরাট অংশ জুড়ে আছে নদী-সাগর ও তার সুবিশাল অববাহিকা। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরকে একপাশে রেখে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য নদীঘেরা বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ার মধ্যে একটু স্বতন্ত্র, ভিন্নতর। ভ‚-প্রাকৃতিক কৌশলগতভাবেও বেশ অনুক‚লে।
বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে চিটাগাং চেম্বারের সাবেক সভাপতি, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেছেন, দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের সুবিশাল সামুদ্রিক সম্পদের ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ এখন সামনে এসেছে। বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে আরও অধিক পরিমাণে মাছ আহরণ এবং তেল-গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সক্ষম হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সেই লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশও জাতি এর অবারিত সুফল ভোগ করবে।
নদীমেখলা সাগরকুন্তলা বাংলাদেশের মাঝেই আদি প্রকৃতির চিরায়ত রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখÑদুঃখ, সৌভাগ্য কিংবা ভাগ্য বিপর্যয়ের অনেককিছুই তার এই স্বতন্ত্র ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ছড়িয়ে আছে। সঙ্কটে কিংবা আনন্দে মানুষের সাথে নদী ও সাগরের গভীর মিতালী হাজার বছর ধরে। দেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল প্রকৃতির নিপূণ হাতে গড়া শুধুই তাই নয়, এটি সম্পদের বিশাল আধার। এর বহুমুখী সম্ভাবনাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি কখনোই। পৃথিবীর অনেক দেশের সফল মডেল অনুসরণ এবং উপক‚লবাসীর বাস্তব জীবন থেকে নেয়া হাজারো অভিজ্ঞতাকে যদি কাজে লাগানো হয়, তাহলে কক্সবাজারের টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ এলিফেন্ট পয়েন্ট থেকে খুলনার দুবলার চর-হিরণপয়েন্ট পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার সুদীর্ঘ সমুদ্র উপক‚লীয় তটরেখা এবং দেশের ভাটিঅঞ্চলের সমগ্র দক্ষিণভাগ জুড়ে থাকা ১৮শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী অববাহিকা মানুষের জীবিকার সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাতে প্রান্তিক জনগণের বেকারত্ব, জীবনযাত্রার বর্তমান টানাপড়েন ও পশ্চাৎপদতা ঘুঁচে যেতে পারে। যার যার অবস্থান থেকে মানুষের স্বচ্ছলতা ফিরে এলে এদেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। তাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে উপক‚লের কর্মমুখী পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সোপান হয়ে দাঁড়াতে পারে দেশের বিস্তীর্ণ সাগর উপক‚লভাগ এবং এর সন্নিহিত নদ-নদী অববাহিকা।
বর্তমানে দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সমুদ্র (শিপিং) পথেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। হাজার বছর আগেও এ বঙ্গোপসাগরীয় উপক‚ল অঞ্চলের বাসিন্দারা অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যদিয়ে কর্মব্যস্ত ছিল। তখন সাগর ও নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় মানুষ কেউই গরিব ছিল না। ঘরে ঘরে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল পরিপূর্ণ। বঙ্গোপসাগর উপক‚ল ও নদী অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল হরেক কৃষি-খামার, শিল্প, নির্মাণ ও মেরামতি কাজের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, আমদানি-রফতানি, ‘সওদাগরী’ বাণিজ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ কাগজ শিল্প, চিংড়ি, লবণ, পান, জাহাজ ও নৌযান নির্মাণ, মেরামত শিল্প, সামুদ্রিক মৎস্য ও শুঁটকি মহাল, পর্যটন ইত্যাদি। তাছাড়া আজও অনুদঘাটিত খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছেÑ জ্বালানি তেল, গ্যাস, তেজস্ক্রিয়তার ধারক ও বিকিরণকারী খনিজ ভারী বালি প্রভৃতি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক জোনের (ইইজেড) কিনারে বিস্তীর্ণ ভ‚মি কোটি কোটি মানুষের আয়-রোজগার, ব্যাপক কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা।
কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে সুবিশাল এই বঙ্গোপসাগরের অফুরান প্রাকৃতিক, খনিজ সম্পদ ও সম্ভাবনাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না। বরং অধিকাংশই রয়েছে অবহেলিত। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলের আবহাওয়া-জলবায়ুর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। সামগ্রিকভাবে ইপ্সিত উপকারভোগী না হয়েও প্রাকৃতিক কারণে বঙ্গোপসাগরীয় জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন এবং সেখান থেকে ঘন ঘন সৃষ্ট দুর্যোগের প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের উপরই। উপক‚লের সাধারণ মানুষের জানমাল হচ্ছে বিপন্ন।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক সীমায় (ইইজেড) সম্পদ আহরণের সঙ্গে জনগণের ভাগ্য, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত। মেরিন রিসোর্সেস বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা যায়, সারাবিশ্বে স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য অপরিহার্য খাদ্যসহ হরেক সম্পদরাশি সমুদ্রভাগে ও এর উপক‚লে ছড়িয়ে আছে সেই তুলনায় অনেক বেশি হারে। অনুরূপভাবে বঙ্গোপসাগরেও রয়েছে সম্পদের বিরাট সম্ভার। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ মহিসোপান ও তার কিনারায় বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম এক সুসমৃদ্ধ ব-দ্বীপ অঞ্চল ও ভাটির দেশ। অথচ প্রকৃত অর্থে সামুদ্রিক সম্পদের দ্বারা বাংলাদেশ তেমন উপকারভোগী হতে পারছে না মূলত তার প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণেই। বরং বঙ্গোপসাগরের বেশির ভাগ দুর্যোগ বা প্রতিক‚লতাকেই বরণ করে নিতে হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও উত্তর আন্দামান সাগরের অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং কক্সবাজার থেকে খুলনা পর্যন্ত বাংলাদেশের দিকে বঙ্গোপসাগরের মহিসোপান বা খাদ (কন্টিনেন্টাল শেল্ফ) অনেকটা ফানেলের (চোঙ্গা) আকারে চেপে থাকার কারণে এদেশ সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ। বাংলাদেশকেই একতরফা দুর্যোগের ধকল বয়ে যেতে হচ্ছে। সর্বোপরি অনাদরে-অবহেলায় দেশ ও জাতি সমুদ্র উপক‚লের সুবিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল সম্পদ এবং তার অবকাঠামোগত প্রকৃতির অপার দান এসব সম্পদ আর সম্ভাবনাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। বøু-ইকোনমি তথা সামুদ্রিক সম্পদরাজি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য।



 

Show all comments
  • রেজওয়ান ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:১২ পিএম says : 0
    এই সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আব্বাস ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:২১ পিএম says : 0
    অনেক সুন্দর ও দিক নির্দেশনামুলক একটি লেখা। রিপোর্টারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mahamudur Rahaman hassan ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:৪৯ পিএম says : 0
    In your country we have land But some people they don`t want to do good thinks, they are thinking bed, And government sector employer taking money under the table,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাগ্য

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ