চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ এক ॥
কিশোর অপরাধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। সকল সমাজেই রয়েছে এর অনিবার্য উপস্থিতি। তবে প্রকৃতি ও মাত্রাগত দিক থেকে তা বিচিত্র। প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা স্বভাব-ধর্ম ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা-মাতা ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তাকে ইসলাম থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়। ফলে শিশু-কিশোররা মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাধ প্রবণতার দিকে ধাবিত হয়। সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামে কিশোর অপরাধের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে।
শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের একটি অংশ কোন কারণে অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চরম হুমকি ও সুস্থ সমাজ জীবনের প্রতিবন্ধক হোক তা কারো কাম্য নয়। এজন্যই ইসলাম শিশু-কিশোরদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে এবং অপরাধমুক্ত জীবনযাপনের উপস্থাপন করেছে সর্বজনীন ও কল্যাণকর নীতিমালা। যা বাস্তবে কার্যকর করতে পারলে পরিবার পেতে পারে কাক্সিক্ষত প্রশান্তি এবং দেশ ও জাতি লাভ করতে পারে অমূল্য সম্পদ।
কিশোর অপরাধ পরিচিতি : কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির ইংরেজি হলো ঔাঁবহরষব উবষরহয়ঁবহপ। আর উবষরহয়ঁবহপু ল্যাটিন শব্দ উবষরহয়ঁবৎ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ঃড় ড়সরঃ বাদ দেয়া, বর্জন করা, উপেক্ষা করা ইত্যাদি। রোমানরা কোন ব্যক্তির ওপর আরোপিত কর্ম অথবা কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বুঝাতে উবষরহয়ঁবহপু শব্দটি ব্যবহার করত। ১৪৮৪ সালে উইলিয়াম কক্সসন সর্বপ্রথম উবষরহয়ঁবহঃ পরিভাষাটিকে দোষী ব্যক্তির প্রচলিত অপরাধ বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়াও ১৬০৫ সালে ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক “গধপনবঃয” এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
কিশোর অপরাধ পরিভাষা আলোচনার পূর্বে শব্দ দু’টিকে পৃথকভাবে বিশেষণ করলে এর প্রতিপাদ্য বিষয় সহজেই অনুমেয় হবে। সাধারণত কিশোর বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তথা বাল্য ও যৌবনের মধ্যবর্তী বয়সের ছেলেমেয়েদের বুঝায়।
তবে কৈশোর কালের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও ইসলামী আইনে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত আইনে দেশ ও সমাজভেদে নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েরা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত। যেমন বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীর বয়স সীমা হলো ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত কিশোর অপরাধীর বয়সসীমা নিচের সারণিতে তুলে ধরা হলো :
মিয়ানমার ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, শ্রীলংকা ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, ভারত ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পাকিস্তান ৭ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত, ফিলিপাইন ৯ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, থাইল্যান্ড ৭ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জাপান ১৪ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত, ইংল্যান্ড ৮ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত, ফ্রান্স ১৩ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পোল্যান্ড ১৩ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, অস্ট্রিয়া ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জার্মানি ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত।
মহান আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অসীম রহমতে মানব সন্তান শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়কাল পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা বলেন, “আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপি থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর তোমরা যেন যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছানো হয়, সে যেন জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে স্বজ্ঞান থাকে না।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোর বয়সে অবাঞ্ছিত ও সমাজবিরোধী আচরণ সম্পাদন করাকেই বলা হয় কিশোর অপরাধ। মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানী ঈধাধহ বলেন, সমাজ কর্তৃক আকাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শনে কিশোরদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। আইনগত দিক থেকে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক আইন বিরুদ্ধ দ-নীয় কর্ম সম্পাদন করাকেই বুঝায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে কিশোর অপরাধের নির্ধারিত সংজ্ঞাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। কিশোর অপরাধ বলতে কমিশন সে কাজকে বুঝায়, যে কাজ একজন বয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে কিশোর অপরাধের পরিচয়ে বলা যায় যে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক সংঘটিত দেশীয় আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কর্মকা-কেই কিশোর অপরাধ বলে।
কৈশোরকাল মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ স্তর শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক মানব সন্তানের ওপর বিভিন্ন শর’ঈ বিধি-বিধান ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়। এর আগ পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীরা গায়রু মুকালাফ বা বিধি-বিধান পালনের বাধ্যবাধকতামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। কেননা হাদিসে তিন ব্যক্তিকে শরী’আতের বিধান পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বলা হয়েছে, “তিন ব্যক্তি যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছে; ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হয়, অপ্রাপ্ত বয়স্ক যতক্ষণ না বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়।
কিশোর অপরাধের কারণ : কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন বিষয়। তথাপিও অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন। যা অপরাধের নানাবিধ সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ধারণা লাভে সহায়ক। কিশোর অপরাধের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বর্তমানের ধর্মহীনতাই অন্যান্য অপরাধের ন্যায় কিশোর অপরাধের কারণ। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের জনক কার্লমার্কস এর মতে, কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রভাব। আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের জনক সিজার লোমব্রোসো কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে জৈবিক প্রভাবকে দায়ী করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী হিলি এবং ব্রোনার (ঐবধষু ধহফ ইৎড়হহবৎ) কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে সামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানে বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তে মানুষের মনোজগতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
পারিবারিক কারণ : কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবসময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবারের সূচনা হয় স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে। আর পারিবারিক পরিম-লে সন্তানের জন্ম হয় এবং বিকাশ লাভ করে। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য পিতামাতার মধ্যে সম্প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহ বিবাদ থাকলে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
অর্থনৈতিক কারণ : অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দারিদ্র্য ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দরিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) কুফরির পাশাপাশি দারিদ্র্য থেকেও আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে বলেন, “হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট কুফরি ও দরিদ্রতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।