Inqilab Logo

সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪, ১০ আষাঢ় ১৪৩১, ১৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আমরা কি আসলেই উন্নয়নের মহাসড়কে?

| প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ : ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে,’ শ্লোগানটি বেশ, শুনতে ভাল লাগে। মনে হতে পারে, আমরা বিশ্বের অন্যতম একটি ধনী দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছি। অবশ্য যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রত্যেকেই উন্নয়নের এই শ্লোগান দিয়েছেন। ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসার কথাও আমরা বহুবার শুনেছি। তবে দেখা যায়, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সে উন্নয়ন আর উন্নয়ন থাকে না। নতুন সরকার এসে একটা কথাই বলে, বিগত সরকার দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। সে নতুন শ্লোগান ধরে। তেমনই একটি শ্লোগান, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। আর বারবার বলা হচ্ছে, বিগত সরকার দেশকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল। আবার কখনো যদি সরকার পরিবর্তন হয়, তখন দেখা যাবে সে সরকারের কাছে উন্নয়নের মহাসড়ক ‘উন্নয়নের ফানুস’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। উন্নয়ন নিয়ে সরকারগুলোর এই যে শ্লোগান তা নিয়ে জনগণ কী ভাবছে বা তাদের উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে, সেদিকটি তারা খেয়ালই করে না। জনগণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্লোগান শোনে আর তার মতোই এগিয়ে যায়। আমরা দেখেছি, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সে সরকারের মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে তার আশপাশের একটি শ্রেণী ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হয়। ঢাকা শহরে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা বা কর্মী ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে প্রবেশ করে ক্ষমতার জাদুমন্ত্রে বছর না ঘুরতেই ধনবান হয়ে যায়। এ ধরনের উদাহরণ আমাদের চারপাশে অনেক রয়েছে। আর এখন এ ধরনের নব্য ধনবান হওয়ার লোক বেশ বেড়েছে। যাদের অর্থকড়ির অভাব নেই। ক্ষমতাসীনরা এদের দেখেই বলে, মানুষের জীবনমানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আমরা জানি, ক্ষমতায় গেলে দেশের নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের অদৃশ্য দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের চারপাশের চাটুকার শ্রেণীর মানুষের উন্নয়ন দেখেই সাধারণ মানুষের উন্নয়ন বিবেচনা করে। এ সময়ে এ প্রবণতা অনেক বেশি। তা নাহলে দেশের সাধারণ মানুষের টানাপড়েনের বিষয়টি সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত না। কেউ বলতে পারে, মানুষের টানাপড়েনের তো শেষ নেই। হ্যাঁ, সত্য। তবে টানাপড়েনের একটা সহনশীল মাত্রা থাকে। আমাদের দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তিন বেলা ঠিক মতো খেতে পারলে আর সামাজিকতা বজায় রাখতে পারলেই খুশি। এখন যে অধিকাংশ মানুষের এ অবস্থাটা নেই, তা বোধকরি সরকার ছাড়া সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘হাতে টাকা নেই’। এমনকি যারা কোটিপতি, তাদেরও অনেক সময় এ কথা বলতে শোনা যায়। ধনবান অবস্থার মধ্যেই তাদের টানাপড়েন চলছে। অর্থাৎ লাইফ স্টাইল অনুযায়ী তাদের যেরকম স্বচ্ছন্দে চলার কথা সেভাবে চলতে পারছে না। তাহলে উন্নয়নটা কীভাবে হচ্ছে? উন্নয়নটা হচ্ছে, গরীব আরও গরিবী হালতে চলে যাচ্ছে আর একটা শ্রেণী ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। সরকার হয়তো দেখাতে চাচ্ছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে, বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট হচ্ছে, চকচকে দালান-কোঠা হচ্ছে। এসবই উন্নয়নের সূচক। তবে এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য কতটা উপকারী তা ভেবে দেখে না। এগুলোর যে প্রয়োজন নেই তা নয়, তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজীকরণের মাধ্যমে হলে এ উন্নতিটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতো। এখন যদি দেখা যায়, পদ্মা সেতুর মতো অনিন্দ্য সুন্দর একটি সেতুর উপর দিয়ে দরিদ্র মানুষের মিছিল, তবে কি একে উন্নয়ন বলা যায়? বড় বড় সুরম্য অট্টালিকায় কি এসব মানুষের প্রবেশাধিকারের ক্ষমতা আছে?
দুই.
বাংলাদেশের বেকারত্বের হার দেখে উন্নত বিশ্বের ভিমড়ি খাওয়ার কথা! তারা বলতে পারে, আমাদের দেশের চেয়েও বাংলাদেশে বেকারত্বের হার এত কম কী করে হয়! কারণ বাংলাদেশে সবসময়ই বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে যা উন্নত বিশ্ব এর ধারেকাছেও নেই। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের মতো উন্নত নয় কেন? বেকারত্বের হার এত কম থাকলে তো অনুন্নত থাকার কথা নয়। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সরকারের একটা চিরকালের প্রবণতা হচ্ছে, উন্নয়নকে বেশি বেশি করে দেখানো। বেকারত্বের হারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এ হার যত কম দেখানো যায়, ততই উন্নয়ন দেখানো যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে কর্মজীবীর সংজ্ঞাটা খুবই সোজা। একজন মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাকে কর্মজীবী হিসেবে গণ্য করা হয়। এমনকি গৃহস্থালি কাজে কোনো আয় না থাকলেও তাকে কর্মজীবী হিসেবে ধরা হয়। বিষয়টি অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউ হাঁটলেও তাকে কর্মজীবী ধরা হয়। পদার্থ বিজ্ঞানে কাজের সূত্র অনুসারে কোনো কিছুর ‘সরণ’কে বোঝায়। আমাদের সরকার যেন আয়রোজগারের ক্ষেত্রে পদার্থ বিজ্ঞানের কাজের সংজ্ঞা ব্যবহার করে চলেছে। এ হিসেবে বেকারত্বের সংজ্ঞা খুবই কম। অথচ প্রকৃত চিত্র এর বিপরীত। আয়রোজগারের সঙ্গে সম্পর্কিত সত্যিকারের চিত্রটি গবেষকরা প্রায়ই তুলে ধরেন।  দেশে মানুষের কাজের কী পরিস্থিতি বা বেকারের হার কত, তার একটি চিত্র সম্প্রতি নবগঠিত সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তারা কর্মবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। এদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি যেমন এমন একটি হিসাব দিয়েছে, তেমনি গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তাদের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয় বা বেকার। বাংলাদেশকে বলা হয়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ। এই তরুণরাই দেশের সম্পদ। এখন দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, তরুণরা কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে নিষ্ক্রিয় এবং হতাশ হয়ে পড়ছে। এ প্রবণতা যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। কারণ চাকরি না পেতে পেতে এই তরুণরা এক সময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হবে। আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত হয়েও অনেকে চাকরি পাচ্ছে না। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এক কোটির উপরে। সার্বিকভাবে বেকারের সংখ্যা প্রায় চার কোটি। অর্থাৎ জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই বেকার। বেকারত্বের এই বিশাল বোঝা নিয়ে দেশ কীভাবে উন্নতি করছে, তা বোঝা মুশকিল। এদিকে সরকারের দৃষ্টি খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। সরকার কেবল বছরের পর বছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার একশর কাছাকাছি দেখিয়ে বাহবা নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পাস করা এসব শিক্ষার্থীর পড়ালেখার মানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। আগে ছেলেবেলায় গুরুজনরা ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় উৎসাহ দেয়ার জন্য বলতেন, পড়ালেখা করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। এ কথা শুনে ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখায় উৎসাহী হয়ে উঠত। এখন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার হার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কথাটি উল্টো হয়ে ‘পড়ালেখা করে যে বেকার হয়ে পড়ে সে’-তে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখে যে কেউ তা মনে করতেই পারে। এর মূল কারণ যে ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’ বা মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, পড়ালেখা ঠিকমতো হলো কি হলো না, তা যাচাই করার প্রয়োজন নেই, পরীক্ষা দিলেই পাস। এই যে বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার পাসের হার শতকের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান কীভাবে হবে তা ভেবে দেখেছে না। কারণ সরকার তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে না। তার চিন্তা শুধু পাসের হার উচ্চ দেখিয়ে ক্রেডিট নেয়া। পরে কী হবে, তা পরে দেখা যাবেÑ এমন একটা মনোভাব সরকারের মধ্যে কাজ করছে। সাধারণত একজন শিক্ষার্থী একটি ভাল চাকরি পাওয়ার আশায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে । তার এ আশা পূরণ এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি একজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর কাছে খুবই বেদনাদায়ক এবং হতাশার। কারণ সে পড়ালেখা করেছেই ভাল একটি চাকরি পাওয়ার জন্য। পাচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নতো সরকারকে করা যেতে পারে। কারণটি হচ্ছে, দেশের শিক্ষা খাত যুগোপযোগী করে সাজানো হয়নি। শ্রমবাজারের যে চাহিদা তা এ শিক্ষা পূরণ করতে পারছে না। তার উপর রয়েছে মানসম্মত শিক্ষার অভাব। সরকার কেন শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সাথে সাজুয্য রেখে শিক্ষা কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন বড় ধরনের অসঙ্গতি রেখে কি উন্নয়ন করা সম্ভব?
তিন.
সরকারি দলের এমপি-নেতাদের দেশের উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করে অনবরত কথা বলতে শোনা যায়। কেউ কেউ উদাহরণ দিয়ে বলেন, এখন গ্রামে-গঞ্জে একজন শ্রমিক তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। এটা কী উন্নতি নয়? তাদের এসব কথা শুনতে ভাল লাগে। তারা এ কথাটি বলেন না বা জানেন না যে, একজন শ্রমিক এ মজুরি পাচ্ছে ঠিকই, তবে তাতেও তাদের পোষায় না। কারণ এখন এক টাকার জিনিস তিন টাকা হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি তাদের এ আয় খেয়ে ফেলছে। দিন শেষে দেখা যায়, আগে তাদের যা খেতে হতো, এখনও তাই খেতে হচ্ছে। টাকায় কোনো বরকত নেই। সিডার গবেষণায়ই বলছে, কৃষি ও শিল্প খাতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। এ দুটি খাতে যে হারে মজুরি বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এতে শ্রমিকরা কিছুটা বাড়তি মজুরি পেলেও দেখা যায়, তাদের মোট আয় দিয়ে আগের চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে পারছে। তাহলে আয়টা বাড়লো কীভাবে? নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বরং তারা আরও বেশি দুর্বিপাকের মধ্যে রয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন আকাশ ছোঁয়া বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে এক টাকাও বাড়েনি। ফলে এ খাতে যেসব মানুষ চাকরি করছে, তাদের জীবনযাপন করতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তাদের আয়ে তো টান পড়ছেই উপরন্তু সংসার চালাতে গিয়ে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বাধ্য হয়ে ধারদেনায় ডুবতে হচ্ছে। এসব দিক সরকারের মোটেও বিবেচনায় নেই। সে মনে করছে, তার সরকারি চাকুরেরা খুশি থাকলে, তার ক্ষমতায় থাকতে কোনো বেগ পেতে হবে না। এই এক শতাংশেরও কম সরকারি চাকুরের বেতন বৃদ্ধি যে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে, তা মোটেও উপলব্ধি করা হচ্ছে না। কারণ আমরা দেখেছি, সরকারি চাকুরেদের বেতন বৃদ্ধির উছিলায় জিনিসপত্রের দামও ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। বেশি অর্থ দিয়ে কম দ্রব্য কিনতে হচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা থাকছে না। অনেকে তো সামাজিকতাকে এড়িয়ে চলছেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের দাওয়াত এলেই আঁতকে উঠেন। কারণ দাওয়াতে যাওয়ার জন্য সম্মানজনক উপহার নেয়া তার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। এ আয় এখন ১৪৬৫ ডলার। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ তখন আয় হবে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ডলার। এক লাফে তিন গুণ! আগামী চার বছরে সাধারণ মানুষের আয় তিন গুণ হয়ে যাবে, এটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হওয়ার কথা। কারণ এখন যে আয় ১৪৬৫ ডলার, তাই তো তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। দেশে যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি বেকার, তারা এখনও বর্তমান মাথাপিছু আয়ের টাকা হাতড়ে ফিরছে। তাদের সবার যদি একসঙ্গে এখন চাকরি হয়ে যায় (যা অসম্ভব) বা অন্য পেশায় কর্মজীবীও হয়, তারপরও কি চার বছর পর তাদের আয় সাড়ে ৪ হাজার ডলারে উন্নীত হবে? ভাবতে গেলে তো ভালই লাগে। তবে যখন ভাবনা থেকে বাস্তবে আসা হয়, তখন এসব হিসাব-নিকাষ প্রহসন বা মশকরা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। তার মানে কি এই দেশের কোনো উন্নতি হচ্ছে না? নিশ্চয়ই হচ্ছে। কোনো দেশ থেমে থাকে না, সচল থাকতে হলে চলতেই হবে। তা নাহলে ধ্বংস অনিবার্য। বিষয়টি হচ্ছে, সরকার যেভাবে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে বলছে, তা মোটেও সঠিক নয়। কেন সঠিক নয়, তার কিঞ্চিত আলোচনা ইতোমধ্যে করা হয়েছে। বর্তমান সরকার দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় এবং আগামী দুই বছরও ক্ষমতায় থাকবে। স্বৈরাচার এরশাদও ৯ বছর ক্ষমতায় ছিল। তখনও আমরা দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বলে শুনেছি। একটি সরকার যখন ৯-১০ বছর ক্ষমতায় থাকে, তখন কিছু না কিছু উন্নতি তো হয়ই। তা নাহলে তো ঐ সরকারের কৃতিত্ব বলতে কিছু থাকে না। এরশাদের সময়ও রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের উন্নতি হয়েছিল। বলা হয়, তার আমলে এসবের বেশ উন্নতি হয়। উন্নতি বলতে এসব উন্নয়নকেই সিম্বল হিসেবে ধরা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ও এ ধরনের ব্রিজ, রাস্তাঘাটের উন্নয়নকে উন্নয়নের সিম্বল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আর কাগজে-কলমে মাথাপিছু আয়, জিডিপি বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের উন্নতি দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ নিয়েই তুমুল প্রচার-প্রচারণা এবং গলা চড়িয়ে আলোচনাও চলছে। এটা কে না জানে, একটি সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে এবং তা যদি পর পর হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সামনে তার উন্নয়ন কর্মকা-ের হিসাব দিতে হয়। এ সরকারও দিচ্ছে। তবে তা তাদের দেয়া হিসাব আর বাস্তবের পরিস্থিতির সাথে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এটা অনেকটা কাগজে-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদরা এসব ফারাক বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ দেশের যে উন্নতি, তা দেশের মানুষের নিজস্ব উন্নতির আকাক্সক্ষার মাধ্যমে হয়েছে। এক্ষেত্রে ৮ বছরের সরকারের যে কৃতিত্ব থাকার কথা, সে হারে নেই। ফলে ধরে নেয়া যায়, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে নয়, এখনও সাধারণ সড়কেই রয়েছে।
চার.
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করার ক্ষেত্রে কোনো সরকারেরই চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। তবে চেষ্টার ক্ষেত্রে যদি ত্রুটি থেকে যায় এবং তা এড়িয়ে উন্নয়নের কথা বলা হয়, তখন তা প্রহসনে পরিণত হয়। তাবৎ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ নেই, নানা সমস্যায় বিনিয়োগকারীরা হাতগুটিয়ে বসে আছে। তারা ভরসা পাচ্ছে না। এ কথা কে না জানে, বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হয় না, কর্মসংস্থান হয় না। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। সরল কথায়, অর্থের যদি গতি না থাকে বা ব্যবহার করা না হয়, তবে সে অর্থের কোনো মূল্য নেই। ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ শিল্পে অর্থের প্রবাহ থাকা অপরিহার্য। অর্থের স্বাভাবিক গতি দিয়ে উন্নতি করা যায় না। উন্নতি করতে হলে ব্যাপক আর্থিক কর্মচাঞ্চল্য প্রয়োজন। তা নাহলে দেশ যে অবস্থায় থাকে, সেখানেই পড়ে থাকে। দেশে যে এখন অর্থের এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। ব্যাংকগুলোতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এ অর্থ এখন ব্যাংকগুলোর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এ পরিস্থিতি চলছে। তাহলে উন্নতিটা হচ্ছে কোথায়? অথচ অর্থনীতি সচল থাকলে এই অর্থ পড়ে থাকার কথা নয়। কী করলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, তারও কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। সরকার কেবল বড় বড় প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, এগুলো একেকটি আলাদিনের চেরাগে পরিণত হবে। আদতে যে এগুলো উন্নয়ন দেখানোর এক ধরনের রেপ্লিকা, তা সচেতন মানুষ মাত্রই বোঝেন। সাধারণ মানুষও দেখবে, তাদের পকেট খালি করে এসব চেরাগ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে তা তাদের পকেট ভর্তি করতে কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়েও দ্বিধায় থাকবে। দেশের উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সুশাসন এবং শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন, তার ঘাটতির বিষয়টি বহুদিন ধরেই স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। মূলত এখানেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাটি স্থবির হয়ে পড়েছে। কথার ফুলঝুরি বা কাগজে-কলমে উন্নয়নের বাঘে পরিণত করার প্রবণতায় না ভেসে, সরকারের উচিত মানুষের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র অনুধাবন করে ব্যবস্থা নেয়া। মানুষের দৈন্যদশার উপর ইমারত নির্মাণ করা মোটেও শোভন নয়। অর্থনীতিবিদরা যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বক্তব্য দিচ্ছে, সেগুলো আমলে নিয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই, তবুও কেন অর্থনীতি গতি পাচ্ছে না, এ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সরকারকে ভাবতে হবে কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না, কেন রেমিট্যান্স কমে গেছে, কেন বছরে দেশ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলে, দেশের প্রকৃত উন্নয়নের চিত্রটি ফুটে উঠবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২৮ অক্টোবর, ২০২২
২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ