Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গ্যাস সঙ্কটে দিশেহারা গ্রাহক

| প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অফিসে ধর্না দিলে সেখান থেকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে- তাদের কিছুই করার নেই
সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গ্যাস সঙ্কটে দিশেহারা গ্রাহক। এই সমস্যা নিরসনে সরকারের কোন উদ্যোগই নেই। এতে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেমন বেড়েছে; তেমনি চুলা না জ্বলায় নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষকে হোটেল থেকে খাবার ক্রয় করতে যেয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অযাচিত এই ব্যয় বৃদ্ধি অনেক পরিবারকে ঋণগ্রস্ত করে তুলছে।
এই পরিস্থিতি নিরসনে গ্রাহকরা তিতাস গ্যাস অফিসে ধর্না দিলে সেখান থেকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে- তাদের কিছুই করার নেই। কারণ, সরকার বাসাবাড়ীতে পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহারকে এখন নিরুৎসাহিত করছে। এক্ষেত্রে তারা ভোগান্তি এড়াতে রান্নার কাজে সিলিন্ডারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের পরামর্শ দেন।
এমন পরিস্থিতিতে শীতে গ্যাস নিয়ে ঢাকা ও তার আশপাশের জেলাগুলোতে গ্যাস নিয়ে গ্রাহকদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। অপরদিকে, এলপিজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা না থাকায় এ সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো খেয়াল খুশিমত সিলিন্ডারের দাম হাঁকাচ্ছেন।
এদিকে, গ্যাসের সঙ্কট তীব্র হওয়ায় রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় চুলা জ্বলছে না। গ্যাস নিয়ে গ্রাহকরা এমন বিড়ম্বনা পোহালেও প্রতি মাসেই সরকার নির্ধারিত হারে ঠিকই বিল আদায় করছে।  গ্রাহক ভোগান্তি নিয়ে পেট্রোবাংলার বক্তব্য হচ্ছে- শিল্প ও আবাসিক খাতে নেয়া অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা সম্ভব হলে এমন দুরাবস্থার মধ্যে পড়তে হতোনা। আর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সম্প্রতি ইনকিলাবকে বলছেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তিনি গৃহস্থালীতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলপিজি ব্যবহারের উপরও গুরুত্বারোপ করেন।  
গ্যাস সঙ্কটের ব্যাপারে পেট্রোবাংলার সাথে কথা বলে জানা যায়, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে গেছে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড সংস্কারের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া সার উৎপাদন কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়াও শীতকালে পাইপ লাইনে গ্যাস জমে যাওয়ার বিষয়টিতো রয়েছেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ থেকে ৪ বছর পর পর গ্যাস পাইপ লাইনের ময়লা এবং জমাট বাঁধা গ্যাস পরিষ্কার করার নিয়ম থাকলেও গত এক যুগেও তা পরিষ্কার করা হয়নি।
উল্টো ষাটের দশকে ঢাকায় যেসব পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে; তার অধিকাংশই এখন ওভারলোডেড। ক্যাপাসিটি অনুযায়ী পাইপ লাইন সম্প্রসারণ করা হয়নি। এতে করে ঢাকার অধিকাংশ পকেট এলাকায় বছর জুড়েই গ্যাসের সঙ্কট চলে। তদুপরি, ঢাকায় যে দু’টি গেট দিয়ে পাইপ লাইনে গ্যাস আসে সেই ডেমরা সিজিএস এবং জয়দেবপুর সিজিএস-এ গ্যাসের প্রেসার কমে প্রতি ঘনফুটে ১১০ থেকে ১৫০ পিএসআইএ উঠানামা করছে। অথচ এই প্রেসার থাকার কথা ২৫০ পিএসআই। এমন পরিস্থিতিতে শুধু গৃহস্থালীতেই নয়; শিল্প ও সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের আকাল চলছে। এতে করে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে শ্রম ঘণ্টার। আর গ্যাসের জন্য পরিবহনগুলোর লম্বা লাইন পড়ে গেছে নগরীর বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের উপরে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৩শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে উৎপাদিত হচ্ছে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। উৎপাদিত এই গ্যাসের মাত্র ১২ শতাংশ ব্যবহার হয় গৃহস্থালীতে রান্নার কাজে। এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, গ্যাস সঙ্কট নিরসনে সরকার নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বাসা-বাড়িতে গ্যাস ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে গৃহস্থালিতে নতুন করে আর গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না বললেই চলে। বাসা বাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার পাশাপাশি সিলিন্ডারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির বিষয়টিও উৎসাহিত করছে সরকার।
এদিকে, গ্যাস সঙ্কট সমাধানে সরকারের ভাবনার সাথে গ্রাহকদের ভাবনার একেবারেই বিপরীত। গ্যাস সঙ্কটে ভুক্তভোগী লালবাগের বাসিন্দা মুতাহার হোসেন একবারেই ক্ষুব্ধ। তিনি ডাবল বার্নারের একটি চুলা ব্যবহার করেন। ক্ষোভের সাথে জানান, বিলতো পুরোটাই পরিশোধ করি; অথচ গ্যাস থাকেনা দিনের অর্ধেক সময় জুড়ে। বিলের ক্ষেত্রে কেন এমন হয়না যে, যতটুকু গ্যাস; সেই পরিমাণ বিল।
মিরপুর পল্লবীর এক গৃহিণীর ক্ষোভ হচ্ছে, আগে শীত মৌসুমে গ্যাস থাকত না। এখন সময়-অসময় বলে কিছু নেই। গ্যাস না থাকাটাই রেওয়াজেই পরিণত হয়েছে। এর পেছনে তিতাসের অন্য কোন কারণ রয়েছে কীনা তাই বা কে জানে?
গ্যাস নিয়ে এই হাহাকার শুধু রাজধানীবাসীরই নয়; ঢাকা ও এর আশপাশে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, ধামরাই, কালিয়াকৈরে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের অনেকেই হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। গ্যাসের এই দুরাবস্থা এসব এলাকার শিল্পাঞ্চলেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ঢাকায় এলাকাভেদে সকাল থেকে দুপুর এমনকি বিকাল পর্যন্ত গ্যাসের দেখা মেলে না। সন্ধ্যার পর গ্যাস আসে এবং রাত গভীর হলে গ্যাসের প্রেসার বাড়ে।   
গ্যাস সঙ্কটের কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় অকস্মাৎ বেড়ে গেছে। এসব পরিবারকে প্রতিদিন অন্তত এক বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে চড়া দামে। এতে করে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে গৃহিণীরা।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানায়, গ্যাসের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেকেই কেরোসিন, কাঠের চুলা, রাইস কুকার ও ইনডাকশন ওভেনে রান্না করছেন। পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকাই এখন গ্যাস সঙ্কটের কবলে। এসব এলাকায় গ্যাস সঙ্কট চলছে বেশ কিছু দিন যাবত।
আবাসিক খাতে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ গৃহিণীরা। রান্নার গ্যাস না পাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা ঝরনা বেগম। তার বাসায় সকাল থেকে বিকাল ২টা এবং সন্ধ্যা রাত ৮ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এতে করে তার পরিবারের সদস্যদের দুই বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। এমন দুর্ভোগের কারণে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।
পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা আকলিমা হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সকাল ৭টার মধ্যে তাকে বের হতে হয় কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে তার পরিবারের সদস্যরা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার বৈদ্যুতিক চুল্লিতে রান্না করছে। রাতে গ্যাস আসে ৯টার পর। তখন রাতের খাবার গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শিখা রানী বলেন, আমাদের এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাসের চুলা জ্বলে না। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, গভীর রাতে পরদিনের রান্না করে রাখতে হয়। এটা অসহনীয়। দুর্ভোগ কমাতে তিনি কখনো  বৈদ্যুতিক চুলায় আবার কখনো কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামপুরা, বনশ্রী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও পুরানো ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস সংকট ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার অনেক স্থানে সকালেই গ্যাস উধাও। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়।
এছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব দোলাইরপাড় মতিঝিলের কিছু অংশসহ পূর্বাঞ্চলীয় অনেক এলাকায় চলছে গ্যাসের টানা সংকট। এতে করে কয়েক হাজার পরিবার দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে সকাল ৭টার পর গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। বিকালেও অনেক এলাকায় চুলা জ্বলে না। এসব এলাকার সমস্যার জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ী করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালক (উৎপাদন) মশিউর রহমান সমস্যার বিষয় স্বীকার করে বলেন, তাদের কোম্পানি ১৮শ’ থেকে প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এই ঘাটতির কারণে আবাসিকখাতে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
তার মতে, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনগুলো যখন বন্ধ থাকে, তখন স্থানীয় আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের সমস্যা হয় না। কিন্তু সিএনজি স্টেশন চালু হলেই আবাসিক খাতে গ্যাসের প্রেসার কমে যায়। তখন এই সমস্যা দেখা দেয়।
মশিউর রহমান বলেন, শীত এসেছে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে গ্যাসের সঙ্কট আরও প্রকট হয়। তিনি গ্যাস সঙ্কটের জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ী করে বলেন, আমাদের পাইপ লাইনগুলো ষাটের দশকের। এসব লাইনের অধিকাংশই আর সম্প্রসারিত করা হয়নি। অনেকক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ পাইপলাইন বসানোর সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার হিসাব অনুযায়ী বসানো হলেও যত্রতত্র অবৈধ সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়েই গ্যাসের এই সঙ্কট।
গ্যাসের অবৈধ সঙ্কট প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলা জানায়, বর্তমানে অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এসব গ্রাহকরা অবৈধভাবে শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ নিয়েছে এবং ব্যবহারও করছে।
অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিমত হচ্ছে, গ্যাস অ্যাক্ট থাকলেও তা কাজে আসছে না। স্থায়ীভাবে তাদের সংস্থায় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় এ সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের কাছে বার বার চিঠি লেখার পরেও সাড়া মিলছে না। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনেক সময় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে পাওয়া যায় না। হুমকির মুখে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই কোনো কোনো সময় টাস্কফোর্সকে অভিযান গুটিয়ে ফিরে আসতে হয়।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাসিক সংযোগ রয়েছে- তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির। সেখানে মোট বৈধ আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এরপর কর্ণফুলী এবং বাখরাবাদ কোম্পানির অবস্থান। স্বাভাবিকভাবে তিতাস, কর্ণফুলী ও বাখরাবাদেই অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে কোন কোন এলাকায় কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ সেটা চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।    



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্যাস

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৪ নভেম্বর, ২০২২
২৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ