চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
শফিক আহমদ শফি : আধ্যাত্মিক রাজধানী নামে খ্যাত বিভাগীয় শহর সিলেটের পুণ্যভূমিতে যে ক’জন খ্যাতিমান মনীষীর আবির্ভাব হয়েছে তাদের মধ্যে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.) অন্যতম। ইলমে ক্বিরাতের বিকাশ সাধনে তিনি এক কৃতীপুরুষ। নিজে এ ইলমের আলোকময় সুধায় সিক্ত হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে এর অনুপম আলোয় উদ্ভাসিত করতে স্থাপন করেছেন অনুকরণীয় নজির। তিনি ১৯৪০ সালে নিজ বাড়িতে ইলমে ক্বিরাতের দারস চালু করেন। ক্রমান্বযে এর শিক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় এর প্রেক্ষিতে শাখা কেন্দ্র স্থাপন ও বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যথাসময়ে ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধে তার মুহতারাম পিতা মুফতী মাওলানা আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নামানুসারে এ প্রশিক্ষণের নাম রাখা হয় ‘দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। তিনি সর্বসস্মতিক্রমে উক্ত বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় দফতর ফুলতলী ছাহেববাড়ি থেকে সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে এবং বহির্বিশ্বেও এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি তার ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর জমি) ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়ে আল-কোরআনের খেদমতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বর্তমানে এ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় হাজার খানেক শাখা কেন্দ্র দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে এবং প্রতি বছর এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাস্টের অধীনে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হলেও শেষ জামাত তার নিজ বাড়িতে প্রধান কেন্দ্রে পরিচালিত হয়। ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ কেন্দ্র থেকে সনদ লাভ করে থাকেন। উক্ত প্রধান কেন্দ্রে তার সুযোগ্য সনদপ্রাপ্ত ৭ পুত্র ও ৮ নাতিসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষক নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। মাসব্যাপী ছাত্র-শিক্ষকদের থাকা খাওয়ার খরচ তিনি তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রদান করতেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ যাবৎ লক্ষাধিক লোক বিশুদ্ধ ক্বিরাত শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্নভাবে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আল্লামা ফুলতলী ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তার দ্বীনের খেদমতের দিগন্ত শুধুমাত্র স্বদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সুদূর ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে তিনি দ্বীনের ঝা-া বুলন্দ করেছেন। ইলমুল ওহীর আলোকে জিন্দেগী যাপনের পাশাপাশি সমাজে ইসলামের শাশ্বত পয়গামের আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে তিনি জানবাজী রেখে দাঈ ইল্লাল্লাহু-র দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণেই বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীনের তালিকায় তার নাম প্রথম পঙ্ক্তিতে লিপিবদ্ধ হওয়ার দাবিদার। নিজ কর্মগুণে তিনি ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন। সিলেটবাসী তার গৌরবে গৌরবান্বিত। খেদমতে খালক বা মানবকল্যাণে নিবেদিত একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ইসলামের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ও জীবনভর ইসলামের খেদমতের স্বীকৃতিস্বরূপ জনগণ তার জীবদ্দশায় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাকে বিভিন্ন লকব ও খেতাবে বিভূষিত করেন। যুগ যুগ ধরে তার এ মহান খেদমত জগৎবাসীর সামনে চির জাগরুক হয়ে থাকবে।
আল্লামা ফুলতলী (র.) একজন যুগশ্রেষ্ঠ তাসাউফপন্থী খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন হয়েও তিনি ছিলেন আজীবন বাতিল ও খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে নির্ভীক বজ্রকণ্ঠ মর্দে মোজাহিদ। যে কোন ইসলামবিরোধী কাজকর্মের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তিনি দুর্জয় সিন্দাবাদের মতো। দ্বীনের সহীহ পথের পথ নির্দেশ দিতেই তিনি আজীবন ত্যাগ ও মেহনত করেছেন। অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী এই মনীষী নিজের সাধনা ও শ্রমে উম্মতে মুহাম্মদীর রূহানী তরক্কী বৃদ্ধিতে অনলস মেহনত করেছেন। আল্লামা ফুলতলী (র.) স্রেফ একজন ব্যক্তি ছিলেন না, অপরাপর পীর-বুজুর্গদের মতো তিনি শুধুমাত্র একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ নায়েবে নবী, আশেকে রাসূল (সা.) এবং লাখো কোটি ভক্তের ইমানি চেতনার রাহবার বা পথ প্রদর্শক। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক বুদ্ধিবৃত্তিক স্বকীয়তা অর্জন করাও একান্ত প্রয়োজন। মাসিক পরওয়ানা যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এ দায়িত্বই আঞ্জাম দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে অনেক আলেম-ওলামা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। কিন্তু ফুলতলী (র.)’র সাথে কাতারবন্দী করা যায় এমন মনীষীর সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ফুলতলী (র.)কে অগণিত মানুষ আন্তরিকভাবে মহব্বতের সাথে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। এ ভালোবাসা যে কত নিখাঁদ ও গভীর তা ভাষায় প্রকাশের ঊর্ধ্বে। কোনো মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা এমনেিতই পয়দা হয় না। মাতা-পিতার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের জন্য সন্তানের চেষ্টা প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না- এটা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে দেয়া শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তবে একথা ঐতিহাসিক সত্য যে, মানুষ যার কাছ থেকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের সহীহ দিকদর্শন লাভ করে তাকেও অধিক শ্রদ্ধা-মহব্বত করে। আল্লামা ফুলতলী (র.)কে মানুষ ভালোবাসতো দ্বীনের কারণেই। এ ভালোবাসা ছিল সবধরনের লাভ-লোভের ঊর্ধ্বে।
আল্লামা ফুলতলী (র.) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলাধীন ফুলতলী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মজিদ (র.) ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ফক্বীহ। তিনি অবিভক্ত ভারতের বাংলা আসামের একজন মশহুর আলিম ও বুজুর্গ ছিলেন এবং দেশময় ছিল তার খ্যাতি। তিনি আজীবন মাদ্রাসায় অধ্যাপনাসহ দ্বীনের খেদমত করে যান। তিনি আমলে সালেহের মাধ্যমে তাযক্বিয়ায়ে কলবের মেহনতে উচ্চাসনে আসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। আল্লামা ফুলতলী (র.) বাল্যকালে মাতা ও কৈশোর বয়সে পিতাকে হারান।
শিক্ষা জীবনের প্রারম্ভে ফুলতলী মাদ্রাসায় তিনি প্রাথমিক আরবি শিক্ষা অর্জন করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন তার বংশীয় চাচাতো ভাই মাওলানা ফাতির আলী (র.)। এ সময় তিনি কারী ফাতির আলীর নিকট ক্বিরাত শিক্ষা করেন। তখন তার পিতা গঙ্গাজল মাদ্রাসার সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারই সুযোগ্য সাগরেদ হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসার সুপার প্রখ্যাত মাওলানা আব্দুর রশীদ শ্রদ্ধেয় ওস্তাদের নিকট আব্দুল লতিফ চৌধুরীকে উক্ত মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ১৩৩৬ বাংলায় তিনি উক্ত মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৩৩৮ বাংলায় বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তদীয় উস্তাদ ও মুর্শিদ বদরপুরীর নির্দেশে উচ্চ শিক্ষার্থে ভারতে বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায়ে আলিয়া রামপুরে ভর্তি হয়ে ফনুনাত শেষ করে ইলমে হাদিসের পরিপূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে মাতলাউল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি উক্ত মাদ্রাসায় অধ্যয়নের পর চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ১৩৩৫ হিজরি সনে হাদিসের চূড়ান্ত সনদ লাভ করেন। উক্ত মাদ্রাসায় তার হাদিসের ওস্তাদ ছিলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা খলিলুল্লাহ রামপুরী (র.) ও হযরত মাওলানা ওজীহ উদ্দিন রামপুরী (র.)। হাদিস শিক্ষা ছাড়াও তিনি ইলমে তাফসীর ও ফিকহ শাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
কর্মজীবনের প্রারম্ভে তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বদরপুর আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে গাছবাড়ি জামেউল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করে ৬ বছর সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। তিনি এ সময় ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘদিন সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসা ও ইছামতি আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে ইলমে হাদিসের শিক্ষা দেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে একাধারে বোখারি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইতকান, নূরুল আনোয়ার, আক্বাইদ, তিরমীযী, আবু দাউদ, হেদায়া, জালালাইন প্রভৃতি কিতাবাদী দক্ষতার সাথে পাঠদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সপ্তাহে দুই দিন ফুলতলী মাদ্রাসায় কামিল জামাতে হাদিসের পাঠদান করতেন। তার অর্ধশতাব্দীর শিক্ষকতা জীবনে তার গভীর অনুভূতি ও বুদ্ধিদীপ্ত শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন বহু শিক্ষার্থী।
শিক্ষক হিসেবে তার আরেকটি গুরুত্ব অবদান হচ্ছে ইলমে ক্বিরাতের শিক্ষা প্রদান। ইলমে ক্বিরাতে তার সুযোগ্য শিক্ষক ছিলেন বদরপুরী (র.) তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ক্বিরাতের আরো শিক্ষা গ্রহণ করেন উপমহাদেশের বিখ্যাত কারী মাওলানা হাফিজ আব্দুর রউফ করমপুরী, শাহবাজপুরী (র.) থেকে। শাহবাজপুরী (র.) ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কারী ইরকুসুস মিশরী (র.) এর ছাত্র। ১৩৫১ সালে আল্লামা ফুলতলী মক্কা গমন করে ক্বিরাতে আরো উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন শায়খুল ক্বোরবা হযরত আহমদ হেজাজী (র.) এর কাছ থেকে। হেজাজী (র.) ছিলেন হারাম শরীফসহ তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা কারীগণের ওস্তাদ ও পরীক্ষক। যথারীতি তিনি শায়খুল ক্বোররা (র.) এর কাছ থেকে ইলমে ক্বিরাতের সনদ লাভ করেন।
আল্লামা ফুলতলী (র.) জীবন সংগ্রামে ছিলেন একজন সফল সৈনিক, ইসলামের খেদমতে ছিলেন নির্ভীক এবং খোদাভীরু। পারিবারিক জীবনে ছিলেন সফল অভিভাবক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে নিজ প্রচেষ্টা, কর্মদক্ষতা, প্রতিভা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে সমাজের প্রতিটি স্তর আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। মোমবাতির মত নিজেকে নিঃশেষ করে সমাজকে আলোকিত করে গেছেন। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে দেশ মাতৃকার জন্য তার মতো ব্যক্তিত্বের আজ বড়ই প্রয়োজন। জাতি তার এ ঋণ কখনো শেষ করতে পারবে না। তার লালচে গোলাপি রঙের দীপ্তিমান প্রশস্ত চেহারা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যার ফলে যে কোন লোক তাকে একবার দেখামাত্র তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তেন। আল্লামা ফুলতলী (র.)’র ব্যক্তিগত অভ্যাস, আচার-আচরণ, বাক-ভঙ্গি, চলাফেরার ধরন ও পোশাক-পরিচ্ছদ সব কিছুই ছিল মোহনীয়, অনুকরণীয়। পরিশেষে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন তার মায়ার ওলিকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন।-আমীন
লেখক : সাধারণ সম্পাদক
সিলেট কেন্দ্রীয় লেখক ফোরাম
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।