চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ সাত ॥
সুতরাং অন্যায় আচরণে উপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান ও আরোপিত হবে না।
অনুরূপভাবে যদি কেউ চাকার নিচে পিন জাতীয় কিছু রেখে দেয়, আর এ কারণে চাকা নষ্ট হয়, তাহলে চাকা নষ্ট হওয়া এবং এ কারণে যে ক্ষতি হবে তার দায় ঐ ব্যক্তি বহন করবে। এভাবেই এককভাবে ক্ষতি সংঘটনের কারণে যে ক্ষতি ঘটিয়েছে সেই এর দায় বহন করবে, কেননা সেই অন্যায় আচরণ করেছে। কিন্তু যদি কোন ক্ষতি সংঘটনের ক্ষেত্রে সরাসরি সংঘটক ও কার্যকারণের সংঘটক একত্রিত হয়, তাহলে কার দায়ে ক্ষতিপূরণ বর্তাবে? এ বিষয়ে সামনের মূলনীতিতে আলোচনা করা হবে। “যদি কোন ক্ষেত্রে সরাসরি সংঘটক ও কার্যকারণের সংঘটক মিলিত হয়, তাহলে ক্ষতির সর্ম্পক হবে সরাসরি সংঘটকের সাথে।”
এ মূলনীতিটি হুবহু হানাফী ফকীহ ইবনু নুজাইম [মৃ.৯৭০হি.] (রহ.) প্রণীত আল আশবাহ থেকে গৃহীত। “ইবনু নুজাইম, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর, পৃ.১৮৭, কায়িদা নং-১৯; সুয়ূতী, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর, পৃ.১৬২, কায়িদা-৪০।” এটি মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যার ধারা (৯০)-এর মূল বক্তব্য ও। ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, মুবাশির হল যে সরাসরি ক্ষতি ঘটায় আর মুতাসাব্বির হল যে ক্ষতি সংঘটনের কারণ ঘটায়।
এর উদাহরণ হলো, কেউ রাস্তায় কুয়া খনন করল, এরপর দ্বিতীয় কেউ তৃতীয় আরেকজনের মালিকানাধীন জন্তু কুয়ায় ফেলে দিল, এ অবস্থায় জন্তুর প্রাণহানির ক্ষেত্রে দুজন একত্রিত হলো। যদি কুয়া খনন করা না হতো, তাহলে প্রাণহানি হতো না। একই ভাবে দ্বিতীয় জন যদি নিক্ষেপ না করতে তাহলে ও প্রাণহানি হতো না। এ অবস্থায় সরাসরি সংঘটক অর্থাৎ যে নিক্ষেপ করেছে তার সাথে প্রাণহানির সম্পর্ক হবে। কেননা প্রাণহানির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা জোরালো। অনুরূপভাবে যদি কেউ চোরকে আরেকজনের ঘর দেখিয়ে দেয় আর চোর চুরি করে, তাহলে হাত কাটা যাবে চোরের; যে দেখিয়ে দিয়েছে তার নয়। কেননা চুরির অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে চোরের ভূমিকা বেশি। তবে এ সবকিছুর সাথে সাথে যে কারণ ঘটিয়েছে তাকেও অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে। যদি একজন আরেকজনকে জাপটে ধরে রাখে আর তৃতীয় আরেকজন একে হত্যা করে তাহলে কিসাস আরোপিত হবে তৃতীয় ব্যক্তির উপর; যে ধরে রেখেছিল তার উপর নয়। আর যে ধরে রেখেছিল যদিও তার উপর কিসাস আরোপিত হবে না; তবু তাকে ধরে রাখার কারণে শাস্তি দেয়া হবে। “এ জাতীয় বিভিন্ন দৃষ্টান্তের জন্য দ্রষ্টব্য : দুরারুল হুক্কাম, খ.১,পৃ.৯১; যারকা, শরহুল কাওয়াঈদিল ফিকহিয়্যাহ, পৃ.৩৭৯।”
উপরিউক্ত ফিকহী মূলনীতিসমূহের আলোকে সমসাময়িক আলিমগণ ড্রাইভিং সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনাসমূহের বিভিন্ন ধরনের শরয়ী বিধান নিরূপণের প্রয়াস নিয়েছেন। নিম্নে সংক্ষেপে প্রকৃতি ও তার বিধান আলোচনা করা হলো। “বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : আল খাতীব, মাসউলিয়্যাতু সাইকিস সাইয়্যারাহ. পৃ. ১৭১-১৭৮।” এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, যানবাহনের মাধ্যমে যা ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হবে সে বিষয়ে চালক দায়ী থাকবে। কেননা তিনিই যানবাহনের সঞ্চালক এবং বাহন হলো তার কর্তৃত্বে থাকা একটি যন্ত্রমাত্র। তার ইচ্ছায় গাড়ি চলে এবং থামে। সুতরাং এ গাড়ির মাধ্যমে যা কিছু ঘটবে সে ক্ষেত্রে চালক শরীয়ত ও আইনের দৃষ্টিতে দায়ী হবে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এ প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী যুগের মাসআলা ও মূলনীতির আলোচ্য বিষয় তথা জন্তুর সাথে বর্তমান যুগের যান্ত্রিক বাহনের তুলনা করে বিধান নিরূপণের প্রয়াস নেয় হচ্ছে; কিন্তু জন্তুর ক্ষয়ক্ষতির ও বর্তমানে গাড়ির ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। তা হলো জন্তু কখনো কখনো নিজ ইচ্ছা ও গতিতে চলাফেরা করতে পারে বরং ক্ষেত্রবিশেষ কোচোয়ান জন্তুর কর্তৃক হারিয়ে ফেলে, তখন তো ফকীহগণ জন্তুর আরোহীর কর্তৃত্ব থাকা অবস্থায় জন্তু পা দিয়ে যা ক্ষতি করে তার দায় আরোহীর উপর চাপান না, যেহেতু এ জাতীয় ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
পক্ষান্তরে গাড়ি হলো চালকের কর্তৃত্বে থাকা একটি যন্ত্রমান। সে যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা গাড়ি চালাতে পারে। অনুরূপভাবে থামাতে পারে। এ পার্থক্য থাকার কারণে আমরা বললো, গাড়ি সামনে পেছনে যে কোন দৃশ্য যা ক্ষয়ক্ষতি ঘটাবে তা দায় বহন করবে চালক। কেননা যে কোন বিচারে ক্ষয়ক্ষতি চালকের উপর বর্তাবে। “উসমানী, বুহূসূন ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাতিন মু‘আসিরা,পৃ.৩১১।”
সুতরাং ক্ষতি যদি অন্যায় ব্যবহারের কারণে হয়, যেমন লাল দাঁড় ক্রস করে চলে গেল অথবা একমুখী রাস্তায় বিপরীত দিকে চলল, অথবা এমন ভিড়ের মাঝে দ্রুতগতিতে চালাল যেখানে ধীরে চালানোটাই কাম্য, অথবা অননুমোদিত জায়গায় গাড়ি থামিয়ে রাখল, এরপর গাড়ি সামনে বা পেছনে নিয়ে গেল, অথবা ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ল। এ সকল অবস্থায় গাড়ির কারণে যা ক্ষতি হবে, কোন সন্দেহের অবকাশ ছাড়া চালক ক্ষতির দায় বহন করবে। যেহেতু সে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করেছে। আর সরাসরি সংঘটক সর্বাবস্থায় ক্ষতিপূরণ বহন করে। সুতরাং অন্যায় ব্যবহার করলে ক্ষতিপূরণ বহনের বিষয়টি আরো স্বাভাবিক, যেমনটা উল্লিখিত মূলনীতির আলোকে তা স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং অন্য কারো কষ্ট বা ক্ষতি না করার বিষয়টি লক্ষ্য রাখা সত্ত্বেও যদি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে কী বিধান হবে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।