Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যানজটে ক্ষতি হওয়া অর্থ দিয়ে বছরে একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ : গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাড়া ঢাকা শহরে বছরের অন্যান্য ঋতু অনুভব করা যায় না বললেই চলে। শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তÑ এ ঋতুগুলো কোন দিক দিয়ে আসে আর কোন দিক দিয়ে যায়, তা রাজধানীবাসী টেরই পান না। কেউ মনে করিয়ে দিলে বুঝতে পারেন একটি ঋতুকাল চলছে। এই যে শীত মৌসুম চলছে, তা রাজধানীবাসী উপলব্ধি করতে পারলেও শীতের যে চিরায়ত বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে পৌষ ও মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীত, তা অনুভব করতে পারছে না। পৌষ মাস শেষের দিকে, মাঘ মাস আসছে, শীতের দেখা নেই। অতীতের বছরগুলোতে দেখা গেছে, পৌষ ও মাঘের শীত প্রলম্বিত না হলেও দুই-তিন দিনে যে চাপ দেয়, তাতেই রাজধানীবাসী কাবু হয়ে যায়। প্রতি ডিসেম্বরে এমন দুয়েকটি চাপ অনুভূত হতো। এবার ডিসেম্বর চলে গেল অনেকটা উষ্ণতার মধ্য দিয়ে। জানুয়ারিও প্রায় মধ্যভাগে। শীতের দেখা নেই। ছোট, মাঝারি বা বড় ধরনের শৈত্যপ্রবাহ না হলে শীতে রাজধানীর তাপমাত্রা সাধারণত গড়ে ১৭-১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। এবার দেখা যাচ্ছে, ২০ ডিগ্রির নিচে নামছে না। অর্থাৎ তাপমাত্রা সাধারণ শীতের চেয়ে দুই-তিন ডিগ্রি বেশি থাকছে। এর কারণগুলো অনেকটাই জানা। রাজধানীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়া এর মূল কারণ। বিশেষ করে গাছ-গাছালি এবং পানির যেসব আধারÑ নদ-নদী, লেক, বিল-ঝিল এগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানী হয়ে উঠেছে ইট-পাথর ও কংক্রিটের। মাটির ছোঁয়া নেই বললেই চলে। আছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও ভবন নির্মাণের ধুলোবালির উড়াউড়ি। পাশাপাশি রয়েছে যানবাহন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মনোঅক্সাইড সমৃদ্ধ ধোঁয়া। এতে রাজধানীর বাতাস যেমন দূষিত হয়ে উঠছে, তেমনি বাতাস ভারি হয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা একটা দিক। আরেকটি দিক হলো, সবকিছু রাজধানীমুখী হওয়া। উন্নয়ন থেকে শুরু করে জনসেবামূলক যত ধরনের কর্ম রয়েছে, সবই রাজধানীকেন্দ্রিক। এসব সেবা পেতে সারা দেশের মানুষের ¯্রােত বরাবরই রাজধানীমুখী। এর ফলে ধারণক্ষমতার চেয়ে দুই-তিন গুণ মানুষ রাজধানীতে বসবাস করছে। রাজধানীতে যত মানুষ আসে, দেশের অন্য কোনো শহরে এত মানুষের মিছিল হয় না। অর্থাৎ যা কিছুরই প্রয়োজন হোক না কেন, মানুষকে ঢাকায় আসতেই হবে। ফলে একটি রাজধানী যেমন পরিপাটি ও বাসযোগ্য হওয়া উচিত, ঢাকায় তার কিছুই নেই। একটি অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি ও দূষিত নগরী হিসেবে এটি পরিগণিত। ইতোমধ্যে রাজধানী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, বসবাসের অযোগ্য ও অসভ্যÑ এই তিন ধরনের খেতাবে ভূষিত হয়েছে।
দুই.
বিখ্যাত ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বিভিন্ন নগরীর বসবাসের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে প্রায় প্রতি বছর জরিপ করে থাকে। মূলত সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোকে সূচক ধরে সংস্থাটি নগরীর স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে। তাদের এই সূচক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য। সংস্থাটির জরিপে ২০১৪-১৫ সালে পরপর দুবার ঢাকা নগরী বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য ও অসভ্য নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়। অর্থাৎ তাদের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে নাগরিকদের যে মানের জীবনযাপন করার কথা তার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে না। এ জরিপ প্রকাশের পর পরিবেশবাদী ও নগর বিশেষজ্ঞরা বেশ নড়েচড়ে বসেন। তারা ঢাকার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। কীভাবে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা যায়, তার নানা পরামর্শ ও পরিকল্পনার কথা টেলিভিশন টকশো থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরেন। তাদের এসব পরামর্শ আমরা শুনি, নগর কর্তৃপক্ষও শোনে, তবে কোনো লাভ হয় না। শোনা পর্যন্তই সার। তারপর যেভাবে চলার সেভাবেই চলে। এই যে যানজট নিয়ে এত কথা হচ্ছে এবং তা কীভাবে সহনীয় করা যায়, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা বহু পরামর্শ শুনেছি। এসব পরামর্শ কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ভ্রুক্ষেপ করেনি। ফলে যানজট অসহনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। আগে মনে করা হতো ছুটির দিনে যানজট কিছুটা কম হয়। এখন ছুটির দিন বলে কোনো কথা নেই, সব দিনই সমান হয়ে গেছে। দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে যায় দুই ঘণ্টা। এভাবে প্রতিটি সড়কে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। এতে যে কী অপরিমেয় ক্ষতি হচ্ছে, তা হিসাব করে কূল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা কিছু দিন পর পর হিসাব দিয়ে যাচ্ছে। মোট কথা, যানজট এখন গবেষকদের জন্য গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গবেষণা করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। তারা একটি রাস্তায় যানজটে কত ক্ষতি হয় তা দেখিয়ে বলেছে, বিমানবন্দর থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে একদিনে ক্ষতি হয় ২২৭ কোটি টাকা। এটি শুধু একটি রাস্তার হিসাব। এ হিসাবে এই রাস্তায় মাসে ক্ষতি হয় ৬৮১০ কোটি টাকা। ব্র্যাকের এ হিসাবের বাইরে বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপিসহ দেশের অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনেক হিসাব দিয়েছে। কেউ বলেছে যানজটে বছরে ক্ষতি হয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা, কেউ বলেছে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যানজটে যে অর্থ ক্ষতি হয়, তা দিয়ে প্রতি বছর এক বা একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এ ক্ষতি যদি অর্ধেকেও কমিয়ে আনা যায়, তাহলেও সম্ভব। তখন পদ্মা সেতুর খরচ জোগান দেয়ার জন্য জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন ছুঁতোয় পকেট কাটতে হবে না। জনগণকেও টানাপড়েনের মধ্যে পড়তে হবে না। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাবে কিনা আমরা জানি না, তবে ভাবা উচিত। যাই হোক, যানজটের এসব হিসাব দেয়া হয়েছে মূলত মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট ও যানজটে আটকে থেকে যানবাহনের জ্বালানি পোড়ার খরচ হিসাব করে। গড় হিসাবে দেখা যায়, যানজটে প্রতিদিন মানুষের ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আর যানবাহনের জ্বালানি পোড়ে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এত বিপুল ক্ষতি নিয়ে আমাদের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমন একটি মনোভাব, ক্ষতি হচ্ছে হোক, আমাদের কিছু করার নেই। অনেকটা লাগাম ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। লাগাম যে একটু টেনে ধরা বা কিছুটা ক্ষতির পরিমাণ কমানো দরকারÑ এ তাগিদ অনুভব করছে না। করলে নিশ্চয়ই দুই-তিন বা চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ কমানো যেত। এ খরচ কমলেও তো কম কথা নয়! দুঃখের বিষয়, আমরা সরকারের কাছ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। এটা সত্য, একটি আদর্শ নগরীতে আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকলেও ঢাকা নগরীতে তা নেই। আছে মাত্র ৭ শতাংশ। তিন ভাগের এক ভাগেরও কম রাস্তা নিয়ে ঢাকা নগরী চলছে। তবে আমাদের নগরবিদরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, একটু সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করা গেলে এই কম সড়ক দিয়েও সহনীয় যানজট নিয়ে চলাফেরা করা যায়। এসব ব্যবস্থা নেয়া খুবই সহজ। এ মুহূর্তে উদ্যোগ নিলে তার ফলাফল চোখের সামনে দেখা যাবে। যেমন অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া রাস্তা উদ্ধার করা, রাস্তার ওপর অবৈধ পার্কিং নিষিদ্ধ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ইত্যাদি। একটু দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থাপনা হিসেবে প্রধান প্রধান সড়কের মোড়ে ইউলুপ, আন্ডারপাস নির্মাণ করা। ঢাকা উত্তরের মেয়র সাতরাস্তা থেকে গাজীপুরের রাস্তায় এ ধরনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। বাস্তবায়িত হলে বোঝা যাবে, তা কত উপকারী কাজ হয়েছে। যানজটের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, রাস্তার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি হওয়া। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচল করার কথা সর্বোচ্চ ২ লাখ ১৬ হাজার। সে জায়গায় বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী চলছে ১০ লাখ ৫০ হাজার ১২৪টি। এর মধ্যে আবার ছোট গাড়ি বা প্রাইভেট কারের আধিক্য দিন দিন বাড়ছে। ঢাকায় চলে দেশের প্রাইভেট কারের শতকরা ৭৮ ভাগ। আর প্রতিদিন ঢাকায় নামছে গড়ে ৩০৩টি যানবাহন। এর মধ্যে প্রাইভেট কার সবচেয়ে বেশি। বেশি যাত্রী পরিবহনের বাস ও মিনিবাস বা মাইক্রোবাস খুব কম নামছে। এত অল্প রাস্তায় যদি কম যাত্রী পরিবহনকারী প্রাইভেট কার অধিক সংখ্যায় চলাচল করে, তবে যানজট কমার কোনো কারণ নেই। তার ওপর কোনো কোনো পরিবারে রয়েছে একাধিক প্রাইভেট কার। হিসাব করে দেখা হয়েছে একটি বাসে ৫২ জন, মিনিবাসে প্রায় ২৮ জন, মাইক্রোবাসে আকারভেদে ১০ থেকে ১২ জন চলাচল করতে পারে। অন্যদিকে একটি প্রাইভেট কারে চালকসহ ৩ থেকে ৪ জন চলাচল করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রাইভেট কারের সংখ্যা যদি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়, তবে যানজট যে সুতীব্র হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিন.
যানজট নিরসন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে, তাদের চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। যারা ভিভিআইপি তাদের যাতায়াতের রাস্তা তো একেবারে ফাঁকা থাকে। আধা ঘণ্টা আগে থেকে তাদের চলাচলের রাস্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একেবারে ফাঁকা করে দেয়। যাতায়াতের সময় তারা শুধু ফকফকা রাস্তা দেখেন। আর দেখেন রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তারা কী আনন্দে দাঁড়িয়ে আছেন নাকি বিরস বদনে দাঁড়িয়ে আছেন, গাড়ির কালো গ্লাস ভেদ করে তা দেখার সুযোগ তাদের হয় না। কারণ তাদের গাড়ি মুহূর্তে চলে যায়। যানজটে পড়তে হয় না। তারা একটু যদি উপলব্ধি করতেন বা থেমে দেখার চেষ্টা করতেন, তবে দেখতেন তাদের রাস্তার দুই পাশের সড়কগুলোর কী অবস্থা। মানুষ কীভাবে হাপিত্যেশ করছে। তাদের এক চলার পথ কীভাবে পুরো ঢাকা শহরকে অচল করে দিয়েছে। পাঁচ-দশ মিনিটে তারা চলে গেলেও জটে আটকে পড়া মানুষগুলো কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে। আর যারা ভিআইপি তাদেরও খুব একটা যানজটে পড়তে হয় না। কারণ তাদের জন্য উল্টো পাশের রাস্তা ফাঁকাই থাকে। তাদের গাড়ির অগ্রভাগে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে নিয়ে যায়। তারা জ্যাম দেখেন ঠিকই, এই জ্যাম সারানোর ব্যবস্থার কথা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা করেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যদি আলোচনা হতো যে, এক যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় তা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। প্রতিবছরের যানজটের ক্ষতি দিয়ে দেশে পদ্মা সেতুর মতো অসংখ্য সেতু নির্মাণ করা কোনো ব্যাপারই নয়। এমনকি রাজধানীকে বাসযোগ্য করার জন্য যে খরচপাতি হওয়ার কথা তা-ও করা সম্ভব। আমরা বলছি না, একদিনে যানজটের সমাধান করে ফেলতে। অন্তত এটুকু তো করা যায় যে, যানজট নিরসনে একটি কার্যকর পরিকল্পনা নেয়া। আমরা তো তা দেখছি না। বরং দেখছি ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ও সুব্যবস্থাপনার লেশমাত্র নেই। তা না হলে ধীরগতির রিকশার রাজত্ব সব রাস্তায় দেখা যেত না। বিশ্বে এমন কোনো শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে রিকশার মতো ধীরগতির বাহন ও দ্রুতগতির বাহন মিলেমিশে একাকার হয়। এ এক অদ্ভুত নগরী! এ নগরী বসবাসের অনুপযোগী হবে না তো অন্য নগরী হবে? বসবাসের অনুপযোগিতার কারণ শুধু যানজটই নয়। এ নগরীতে যেসব নাগরিক বসবাস করেন, তারা হাড়ে হাড়ে টের পান ঢাকায় বসবাস করা কত কঠিন। এখানে অর্থ খরচ হয়ে যায়, সেবা পাওয়া যায় না। সরকারও নগরবাসীর সাথে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা খেলে। যেমন পানির দাম গোপনে বাড়িয়ে দেয়া, গ্যাস না দিয়ে দাম বাড়ানো, বিদ্যুতের লোডশেডিং তো পুরনো ব্যাপার। ঢাকা শহরে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি কেউ ট্যাপ থেকে সরাসরি পান করেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এ পানি পানের অনুপযুক্ত। এতে দুর্গন্ধ থাকে, ঘোলা এবং পোকামাকড় ঘুরে বেড়ায়। অথচ এই পানিই বেশি দামে মানুষকে কিনতে হচ্ছে। আবার চুলায়ও গ্যাস থাকে না। গ্যাস না পেয়েও মানুষকে বিল দিতে হচ্ছে। একটি দেশের রাজধানীতে এত সমস্যা থাকে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। অথচ আমরা বলছি, ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব। এ যেন ছোট ছোট চোখে বড় বড় স্বপ্ন দেখা! রাজধানীর নাগরিকদের যে অবিরাম সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, এ সমস্যা বিরাজমান রেখে কীভাবে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব, তা ভেবে দেখা হচ্ছে না। সরকার হয়তো বলতে পারে, আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে রাজধানীর মানুষ মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের মতোই বসবাস করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে সমস্যা দশকের পর দশক চলে গেলেও সমাধান হয়নি, আগামী অর্ধ দশকে কি তার সমাধান সম্ভব? যানজট, পানি সমস্যা, গ্যাস সমস্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানুষের টানাপড়েনের জীবনÑ এসব কি আগামী পাঁচ-ছয় বছরে সমাধান হয়ে যাবে? আমরা জানি, সরকারের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। থাকলে হয়তো পাঁচ-ছয় বছর নয়, এক নিমেষে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আর যেভাবে ঢাকামুখী মানুষের মিছিল বাড়ছে, এর ফলে সমস্যা যে আরও জটিল আকার ধারণ করবে তাতে সন্দেহ নেই। ঢাকার বর্তমান লোকসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। ১৫ বছর পর তা হবে ২ কোটি ৭০ লাখের মতো। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ লাখ লোক বাড়ছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই অতিরিক্ত লোকগুলো বিদ্যমান যেসব সমস্যা রয়েছে, তা আরও প্রকট করে তুলবে। অর্থাৎ যেটুকু সুবিধা এখন নগরবাসী ভোগ করছে, তাতেই ভাগ বসাবে। তাহলে সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি দূরে থাক, সরকার তো সমস্যারই সমাধান করতে পারছে না। সহসা পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই তো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
চার.
ঢাকাকে বলা হয় মেগাসিটি। আশা ও আশঙ্কা করা যায়, আগামী এক দশকে তা মেগা থেকে ‘গিগা’ সিটিতে পরিণত হবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে তা যদি হয়, তবে নিশ্চয়ই এটা গর্বের বিষয় হবে। তবে, তা যে হবে না, তা এক প্রকার নিশ্চিত। বরং সমস্যার পাহাড় দিন দিন বড় হয়ে উঠবে। এর মধ্যে ভূমিকম্প যেভাবে সুরম্য অট্টালিকা থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে; আল্লাহ না করুন, যদি সত্যিকারের আঘাত করে বসে, তবে কী পরিণতি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। শুধু চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপই দেখা যাবে। আমরা মনে করি, ঢাকা যেসব সমস্যায় জর্জরিত সেগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যা হচ্ছে বা যা হওয়ার হবেÑ এমন মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যে কাজগুলো সহজে করা যায়, সে কাজগুলো আগে করতে হবে। যানজট সহনীয় করতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রাথমিক কাজ হিসেবে, সড়ক দখলমুক্ত করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করা, বাস থামানো, সড়কের মোড়গুলো পরিষ্কার রাখা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, সব রাস্তায় অবাধে রিকশা চলাচল বন্ধ করাÑ এ পদক্ষেপগুলো নেয়া। প্রাইভেট কারের নিবন্ধন কমিয়ে দেয়া দরকার। এমনকি ছয় মাস বা এক বছর বন্ধ রাখলে দেখা যাবে, যানজট অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এর পরিবর্তে অধিক সংখ্যক যাত্রী বহনকারী গাড়ি বৃদ্ধি করা। গণপরিবহন কোন রুটে কতটি চলবে তা পরিকল্পিতভাবে নির্ধারণ করা। কোম্পানিভিত্তিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে থানা বা এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া অপরিহার্য। যেমনÑ গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা প্রভৃতি এলাকা যেমন অনেকটা পরিকল্পনা করে করা হয়েছে, তেমনি রাজধানীর অন্যান্য এলাকাও অনুরূপ পরিকল্পনা অনুযায়ী শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সেই সাথে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তত পক্ষে মানুষ যাতে ট্যাপকল খুলে নিশ্চিন্তে পানি পান করতে পারে, ঠিকমতো গ্যাস পায়, সড়কগুলো আবর্জনামুক্ত থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকামুখী মানুষের ঢল কমাতে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সেবামূলক খাতগুলোকে বড় বড় জেলা শহর নিদেনপক্ষে বিভাগীয় শহরগুলোতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানীর ওপর এত চাপ রাখতে হবে কেন? ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো অন্যান্য বিভাগীয় শহরে যদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায়, তবে রাজধানীর ওপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কিছুটা হলেও কমবে। এ ছাড়া গার্মেন্ট শিল্পের মতো ব্যাপক কর্মসংস্থানমূলক শিল্প কারখানা রাজধানী থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত। এ কথা মনে রাখা উচিত, রাজধানীতে কেবল দুয়েকটি নান্দনিক স্পট ও স্থাপনা তৈরি করলেই তা উন্নতির সূচক হয়ে ওঠে না। উন্নতি করতে হলে নাগরিক সেবামূলক প্রতিটি সূচকে উন্নতি করতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে এখনই সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষকে সম্মিলিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যানজট

১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
৯ জানুয়ারি, ২০২৩
১৯ ডিসেম্বর, ২০২২
২৭ নভেম্বর, ২০২২
২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ