Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তুরস্কের প্রায় প্রতিটি সংকটের পিছনেই যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে দেখা যায়

| প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি নিউইয়র্ক টাইমস : গত গ্রীষ্মে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তুর্কি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছিলেন। গত মাসে যখন তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূতকে গুলি করে হত্যা করা হয় তখন তুরস্কের সংবাদপত্র বলেছিল এ হামলার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে। তারপর নববর্ষের রাতে একজন বন্দুকধারী ইস্তাম্বুলের একটি নাইটক্লাবে কয়েক ডজন লোককে হত্যা করার পর তুরস্কের সরকারপন্থী সংবাদ মাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে। অর্থাৎ তুরস্কের প্রায় প্রতিটি সংকটের পিছনেই যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে দেখা যায়। এ হামলার পর একটি সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম ছিল ‘আমেরিকা প্রধান সন্দেহভাজন।’ টুইটারে তুরস্কের এক আইন প্রণেতা নাইটক্লাবের নাম উল্লেখ করে লেখেন, ‘ঘাতক যেই  হোক না কেন, রেইনা হামলা সিআইএ আমলের কাজ।’
তুরস্ক এমনিতেই নানা সংকট কবলিত। তার উপর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সীমান্ত পেরিয়ে দেশটির জন্য বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এসব ঘটনা তুরস্ককে তার ন্যাটো মিত্রদের  সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বরং ওয়াশিংটনের সমালোচনা ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার উদ্যোগ এবং সিরিয়ায় একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে কাজ করার ঘটনা তাদেরকে তুরস্কের কাছ থেকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
তুরস্কের মার্কিন দূতাবাস কর্তৃক নিয়মিত ভ্রমণ সতর্কতা জারির ঘটনার ভিত্তিতে তুরস্কের সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে যুক্তরাষ্ট্র ইস্তাম্বুলের নাইটক্লাবে হামলার কথা আগাম জানত। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে। আরেকটি খবরে বলা হয় যে হামলাকারী যে স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে তা মার্কিন বাহিনীর মজুদ থেকে এসেছে। আরেকটি খবরে দাবি করা হয় যে তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মপন্থীদের মধ্যে বিভক্তির বীজ রোপণ করতে এ হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ষড়যন্ত্র।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ককে এক পতাকার নিচে আনার বদলে নাইটক্লাবের হামলা পাশ্চাত্য থেকে তুরস্কের দূরত্বকে জোরদার করেছে। আর তা এমন এক সময়ে যখন তুরস্কে নাগরিক সমাজের উপর দমন ক্রমেই বাড়ছে।
বহু সমালোচকই বলছেন যে,  এ সব হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিকার ও কর্তৃত্ববাদিতার প্রতিফলন যার নেতৃত্ব সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে জাতিকে গভীরভাবে বিভক্ত করছে। প্রতিটি হামলায় তুর্কি সমাজে ফাটল ধরছে।
আইএস, কুর্দি জঙ্গি ও এরদোগান কর্তৃক জুলাই মাসের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নির্দেশনা প্রদানের জন্য অভিযুক্ত ফেতুল্লাহ গুলেনের সমর্থকরাসহ তুরস্কের শত্রুদের সমর্থন দানের  জন্য শেষদিনগুলোতে ওবামা প্রশাসনকে দায়ী করলেও তুরস্কের কর্মকর্তারা এখন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।  
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম এ সপ্তাহে বলেন, নতুন প্রশাসনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা যে তারা এ লজ্জার অবসান করবেন। তিনি সিরিয়ায় আইএসের সাথে লড়াইরত কুর্দি জঙ্গিদের অস্ত্র দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেন যারা তুরস্কের শত্রু। তিনি বলেন, আমরা সে জন্য নয়া প্রশাসনকে দায়ী করছি না, কারণ এটা ওবামা প্রশাসনের কাজ।
উল্লেখ্য, নাইটক্লাবে হামলাকারী ব্যক্তি এখনো আটক হয়নি।
তুর্কি কর্তৃপক্ষ ৪ জানুয়ারি বলেছিল যে তারা খুনিকে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু বিশদ কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানায়। নজরদারি ক্যামেরায় তোলা হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। তা হচ্ছে তাকসিম স্কোয়ারে হামলাকারীর নিজের তোলা ছবি।   
যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাকে তদন্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন,  ইস্তাম্বুলের একটি বাড়িতে হানা দিয়ে তুর্কিরা এ ভিডিওটি পেয়েছে। ঐ কর্মকর্তা বলেন, তুর্কিরা এখন মনে করছে যে হামলাকারী কিরঘিজস্তান নয়, উজবেকিস্তানের লোক যা এ সপ্তাহের প্রথম দিকে বহু খবরে বলা হয়েছিল।
মার্কিন কর্মকর্তা তুরস্কে ক্রমবর্ধমান মার্কিন বিরোধী মনোভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যা প্রতিটি সংকটের পর পুঞ্জীভূত হয়। তিনি বলেন, এটা এ দেশে আমেরিকানদের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন করছে।
তিনি বলেন, বিশৃঙ্খল তদন্তের কারণে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। যানবাহন পরীক্ষা করা হচ্ছে, রাতে বাড়িতে হানা দেয়া হচ্ছে, হেলিকপ্টারগুলো নিচু দিয়ে উড়ছে।
সংবাদপত্র দৈনিক জমহুরিয়েতের কলামিস্ট আয়দিন এনজিন বলেন, সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক ভীতি বিরাজ করছে। গত বছর সংবাদপত্রের উপর সরকারি দমন নীতির প্রেক্ষিতে তিনি আটক হন। তিনি বলেন, বিনোদন কেন্দ্র, শপিংমল, মেট্রো সব জায়গাতেই ভীতি বিরাজ করছে।
বসবাসের তীরে নাইটক্লাবে হত্যাকা-ের আগে ও পরে জাতীয়তাবাদীরা ইসলাম রক্ষার নামে সান্তাক্লজের মৃত্যুদ- দেয়ার অভিনয় করে, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক সাংবাদিককে আটক করা হয়, তাকে নগ্ন করে তল্লাশি করার পর নির্জন কারাবাসে রাখা হয় এবং ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে একজন সুপরিচিত ফ্যাশন ডিজাইনারকে তার সামাজিক মাধ্যম পোস্টগুলোর জন্য মারধর ও গ্রেফতার করা হয়।
তুর্কি কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ সলি ওজেল বলেন, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। প্রত্যেকেই যার যা খুশি তা করতে পারে।
দীর্ঘদিনের সাংবাদিক তুগরুল এরিলমাজ ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করেন ও বলেন, আজকের মতো এ রকম পরিস্থিতি কখনো দেখিনি।
তুরস্ক একদিকে যখন সন্ত্রাসী হুমকির সম্মুখীন অন্যদিকে দেশটি নিজের সাথেই লড়ছে। দেশটিতে বিভক্তি গভীরতর রূপ গ্রহণ করছেÑ ধর্ম, শ্রেণি, জাতিগোষ্ঠীভিত্তিকতা যা কিনা সকটকালে ঐক্যকে জটিল করে তুলছে। সবচেয়ে বড় বিভক্তি হচ্ছে এরদোগান সমর্থক যাদের সংখ্যা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং বিরোধীদের মধ্যে যারা মনে করে তিনি অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠছেন।  
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিতে তুরস্ক বিশেষজ্ঞ সোনার কাগাপ্তে বলেন, এরদোগানের শক্তিশালী ব্যক্তিত্বকে ঘিরে তুরস্ক এত গভীরভাবে মেরুকরণকৃত হয়ে পড়েছে যে কেন সন্ত্রাসী হামলা ঘটছে ও কীভাবে তা ঠেকানো যেতে পারে তা না ভেবে এরদোগানপন্থী ও বিরোধীরা পরস্পরকে দায়ী করে চলেছে। আমি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন যে তুরস্ক আর কোনো সন্ত্রাসী হামলা রোধ করতে সক্ষম কিনা।
১ জানুয়ারির হামলা ঘটনার পর ৪ জানুয়ারি এরদোগান প্রথম প্রকাশ্যে কথা বলেন। যিনি প্রতিদিনই প্রায় বক্তৃতা করেন তার জন্য চারদিন চুপ করে থাকা অস্বাভাবিক ঘটনাই বটে।
ইসলামপন্থী এরদোগান ইসলামী কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে চলার বিরোধীদের সমালোচনা খারিজ করে দিলেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মানুরাগীদের মধ্যকার বিভক্তি গভীর করছেন। নাইটক্লাব হামলার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই উল্লেখ করেন যে তুরস্ক সরকারের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ নববর্ষ উদযাপনকে অনৈসলামিক বলে নিন্দা করেছে।
এরদোগান বলেন, ৭ কোটি ৯০ লাখ মানুষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার, আইন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমার কর্তব্য। তিনি বলেন, আমি মনে করি এত সন্ত্রাসী হামলার সম্মুখীন তুরস্ক পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের শিকার।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোম্যান সা¤্রাজ্যের পতন ও পশ্চিমা সেনাবাহিনী ও তাদের ক্রীড়নকদের সাথে তুরস্কের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তুরস্ক আজ তার স্বাধীনতার জন্য নতুন করে লড়াই করছে। 



 

Show all comments
  • hayder ১৬ এপ্রিল, ২০১৭, ৮:৪৩ পিএম says : 0
    Ardogan is a great ledar..
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তুরস্ক

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ