Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ইহুদীবাদের ইতিকথা

| প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিযানুর রহমান জামীল

॥ এক ॥
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর এক ছেলের নাম হযরত ইসহাক (আ.)। তার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন হযরত ইয়াকুব (আ.)। নবী ইয়াকুব (আ.)-এর উপাধি ছিল ইসরাঈল। হিব্রু ভাষায় যার অর্থ আল্লাহর বান্দা। তদনুসারেই তার সন্তানদিগকে বলা হয় বনী ইসরাঈল (ইসরাঈলের সন্তানাদী)। নবী ইয়াকুব (আ.)-এর বারো জন পুত্র সন্তান। তাদের দাদা হযরত ইবরাহীম (আ.) ‘বাবেল’ শহর থেকে হিজরত করে কেনান শহরে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই তাঁর সহধর্মীণী হযরত সায়েরা (আ.)-এর উদরে জন্ম লাভ করে হযরত ইসহাক (আ.)। তিনিও কেনান শহরেই বসবাস করেন। ঘর সংসার করেন। তাঁর ঘরে যে সব সন্তান জন্ম নেন তন্মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত ইয়াকুব (আ.)।
হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর বারো সন্তানের সাথে কেনান শহরেই বসবাস করতে থাকেন। এক সময় তার সর্বাধিক আদরের সন্তান হযরত ইউসুফ (আ.) বণিক দলের হাতে কেনা-বেচা হয়ে মিশরে পৌঁছেন। সেখানে তিনি আজীজে মিশরের রাজপ্রাসাদ ও মিশরের জেলখানা মাড়িয়ে এক পর্যায়ে মিশরের সিংহাসনে আসীন হন। তারপর বাপ-মা এবং ভাইদেরও মিশরে ডেকে আনেন। এ সুবাদে মিশর রাজ্য বনী ইসরাঈলের আবাস ভূমিতে পরিণত হয়।
একটানা চারশত বছর তারা সেখানে সম্মানের সাথে বসবাস করে। অতঃপর মিশরে জাতীয়তাবাদের এক শ্লোগান উঠল মিশরের আদী বাসিন্দাগণ ছিল কিবতী নামে পরিচিত। তারা বনী ইসরাঈলদের বহিরাগত অধিবাসী মনে করে তাদের উপর নানা অত্যাচার করতো। গোলাম বানিয়ে তাদের দ্বারা নিম্নমানের কাজ-কর্ম করাতো।
বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ জালালাইন শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ হাশিয়ায়ে ছাবী গ্রন্থকার লিখেনÑ
কিবতীরা বনী ইসরাঈলের শক্তিমান ও কর্ম সক্ষম পুরুষদের পাথর ও লোহা কাটার, ইট তৈরি, দালান কোটা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করতো। নারীদের দ্বারা সূতা তৈরি ও কাপড় বুননের কাজ করাতো এবং দুর্বল ও অক্ষম ব্যক্তিদের থেকে ‘কর’ আদায় করতো।
একবার মিশরের রাজা ফেরাউন স্বপ্নে দেখলোÑ বাইতুল মোকাদ্দাস অঞ্চল থেকে আগুনের কু-লি বেরিয়ে সমগ্র মিশর রাজ্যকে ঘিরে ফেলেছে। অবাক কা-। এ আগুন কেবল মিশরের আদী অধিবাসী কিবতীদের দাহ করেছে। কিন্তু বনী ইসরাঈলকে স্পর্শ করছে না। ফেরাউন অভিজ্ঞজনদের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলো। তারা বলল- বনী ইসরাঈলের মাঝে এমন একটি ছেলে জন্মলাভ করবে যে তোমার রাজত্ব্যের যবনিকা ঘটিয়ে কিবতীদের ধ্বংস করবে। এ দুঃসংবাদ শোনা মাত্র ফেরাউন বনী ইসরাঈলের নবজাত পুত্র সন্তানদের হত্যা করতে নির্দেশ দিল। সে সময় জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুসা (আ.)। আল্লাহর কী অসীম কুদরত। সেই ফেরাউনের ঘরেই তিনি লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে উঠেন।
হযরত মুসা (আ.) তখন যুবক। একদিন তার হাতের চপেটাঘাতে একজন কিবতী মারা যায়। ফেরাউন তার হত্যার ফরমান জারি করলে তিনি মাদায়েন শহরে চলে যান। সেখানে হযরত শোয়াইব (আ.)-এর সংশ্রবে আট বছর অতিবাহিত করেন। সে সময় তিনি মাঠে ছাগল- বকরি চরাতে থাকেন। এ যেন ভবিষ্যতে বনী ইসরাঈলকে পরিচালিত করার প্রশিক্ষণ ছিল। সেখানেই তিনি বিবাহ করেন। আট বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে সস্ত্রীক মাতৃভূমি মিশরে ফিরে যান। ফেরার পথে তুয়া নামক উপত্যকায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুওয়াত  ও রিসালাত দ্বারা ধন্য করেন এবং আবার ফেরাউনকে হকের দাওয়াত প্রদান ও বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করেন। অতঃপর তার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর সহোদর হযরত হারুণ (আ.) কেও নবুওয়াত দান করে তাঁর সহযোগী বানিয়ে দেন। সাথে কিছু মুজিযাও প্রদান করেন।
হযরত মুসা (আ.) আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে মিশর পৌঁছলেন। ফেরাউনের কাছে হকের দাওয়াত তুলে ধরলেন। ফেরাউন প্রত্যাখ্যান করলো তার দাওয়াত। তাঁর মুজেযাসমূহকে যাদু মনে করে মিশরের সকল যাদুগরকে তাঁর মোকাবেলায় পেশ করলো। যাদুগরগণ মুসা (আ.)-এর মুজেযা প্রত্যক্ষ করে সঙ্গে সঙ্গে ঈমান নিয়ে আসে। এতে তারাও ফেরাউনের নিপীড়নের শিকার হলো। হযরত মুসা (আ.) বনী ইসরাইলকেও হকের দাওয়াত প্রদান করেন। প্রথমে তারা তা প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীতে সকলেই মূসা (আ.)-এর ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যান। অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ফেরাউন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মুসা (আ.) বনী ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে মিশর থেকে হিজরত করে চলে যেতে চাইলেন। ফেরাউন তা মানতে নারাজ। পশ্চাৎধাবন করল। ইতোমধ্যে মুসা (আ.) এবং বনী ইসরাঈল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যান। আর ফেরাউন দলবলসহ সমুদ্রে ডুবে মরল।
বনী ইসরাঈল মুক্তি পেল স্বাধীন হলো। এ স্বাধীন জীবনে তারা মূসা (আ.)-এর কাছে আরয করল- আমরা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ নিশ্চিন্ত। যদি আমাদের জীবন বিধানস্বরূপ কোনো শরীয়ত নির্ধারণ হয় তাহলে আমরা তা পালন করতে পারব। মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন- প্রাপ্ত হলেন তাওরাত কিতাব।
এর থেকে বুঝা যায়, যে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কাছে হযরত মুসা (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন এবং যাদেরকে তাওরাত দান করা হয়েছিল তাদেরকেই ইহুদী বলা হয়। পবিত্র কোরআনে তাদের বনী ইসরাঈল এবং ইহুদী এ দুটি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ হলো বনী ইসরাঈলের নামের তাৎপর্য। এবার ইহুদী নামের তাৎপর্য জানা যাক-
এ সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা কাযী বায়যাবী (রহ.) লিখেন- ‘ইয়াহুদ শব্দটি হয়তো আরবী। যা  হাদ (অর্থ-তওবা করা) শব্দ থেকে নির্গত। ইহুদীরা যেহেতু গো-বৎস পূজা থেকে তওবা করেছে- তাই তাদেরকে এই নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ হিসেবে ইহুদী অর্থ তওবাকারী। অথবা ইয়াহুদ শব্দটি ইয়াকুব (আ.)-এর বড় ছেলে ইয়াহুযা নামের আরবী রূপ। এখানে জাল-কে দাল দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। [তাফসীরে বায়যাবী]        
ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের জন্ম যেভাবে
মধ্যপ্রাচ্যের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরাইল ভূমধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। ইসরাইলের রাজধানীর নাম জেরুজালেম। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিব্রু ও আরবি। ২০ বর্গ কিলোমিটারের এই রাষ্ট্রটির অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই ইহুদী ধর্মাবলম্বী। ইসরাইল রাষ্ট্রটির জন্ম ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কৌশলে ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে ইসরাইল একটি জ্বলন্ত সমস্যার নাম।
মুসলমানরা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে থাকে। এই ঘৃণার পেছনের কারণও অযথা নয়। যেমন এই ইসরাইলের হামলায় গত ৪০ বছরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনের রক্তধারা প্রবাহিত হয়েছে। বিনা দোষে কোন প্রকার কারণ ছাড়াই ইসরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের হত্যা করে এবং রক্তে রঞ্জিত করে মুসলিম এলাকাগুলো। মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে ইসরাইল বাহিনী। ফলে ইসরাইল সকল মুসলিমদের চোখে প্রধান শত্রু।
১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙে যায়। বৃটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। বৃটিশরা প্রথম ফিলিস্তিনে পদার্পণ করে ফিলিস্তিন জয়কারী মুসলিম বীর সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর মাযার শরীফ এগিয়ে তার মাযারে পদাঘাত করে উচ্চস্বরে বলতে থাকে ‘হে সালাহ উদ্দিন উঠে দেখ! আমরা তোমার সিরিয়া জয় করে এসেছি।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে।



 

Show all comments
  • Arafat ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ২:৪৩ এএম says : 0
    nice article
    Total Reply(0) Reply
  • হাসান ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৫০ এএম says : 0
    বাকি লেখা দিবেন
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed masad ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ৬:৩১ পিএম says : 0
    অনেক ভালো পোষ্ট
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ