Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

জান-মাল ও ইজ্জত সংরক্ষণে রাসূল সা.-এর শিক্ষা

| প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

॥ দুই ॥
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কেবল মুসলমানদের নয়, অমুসলিমদের জান ও সম্পদেরও নিরাপত্তা দান করেছেন। কোন মুসলিম প্রধান দেশে সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিকদের জান, সম্পদ ও ‘ইজ্জত সংরক্ষণ করা শুধু রাষ্ট্রেরই নয়, সকল মুসলমানের দায়িত্ব। অথচ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, হঠকারী গোষ্ঠী, বিদ্বেষী দল অথবা হীনস্বার্থান্বেষী লোকেরা সুযোগ পেলে সংখ্যালঘুদের জান-মাল ও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে। কোনো মুসলিম যাতে তাদের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে না পারে এজন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঘোষণা দিয়েছিলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তবে সে ঘাতক জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়” (সহীহুল বুখারী, কিতাবুল জিয্য়া ওয়াল মাওয়াদি‘আহ্, বাবু ইসমি মান কাতালা মু‘আহাদান বিগায়রি জুরমি, হাদীস নং ২৯৩০, বাবু ইসমি মান কাতালা যিম্মিয়া বিগায়রি জুরমি, হাদীস নং ৬৪০৩; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, মান কাতালা মু‘আহিদান, হাদীস নং ২৬৭৬)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইসলাম পূর্ব যুগের পারস্পরিক হানাহানি ও রক্তের হোলিখেলা বন্ধ করে এমন একটি সুশীল ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন, যাতে সকল মানুষই জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছিল। কেউ কারো জান নিয়ে খেলা করতে পারত না, কেউ কাউকে আক্রমণ করতে পারত না। প্রত্যেকেই নিজের জীবনের ব্যাপারে শংকামুক্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অত্যন্ত কঠোরভাবে কিসাসের বিধি-বিধান কার্যকর করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা (আনাস ইব্ন মালিকের ফুফু) রুবাঈ (রা.) একজন আনসারী মহিলার সামনের একটি দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তখন আনসাররা এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে অভিযোগ পেশ করেন। তিনি কিসাস অর্থাৎ যথার্থ বদলা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় আনাস ইব্ন মালিক (রা.)-এর চাচা আনাস ইব্ন নাদার (রা.) রাসূলল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তাঁর বোনের দাঁত না ভাঙ্গার আবেদন জানান। তখন রাসূলুলাহ্ (সা.) বললেন, আনাস! আল্লাহ্র নির্ধারিত বিধান হলো কিসাস। পরে অবশ্যই আনসারগণ সন্তুষ্ট চিত্তে কিসাসের পরিবর্তে দিয়াত রক্তপণ গ্রহণ করেন” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।
মানব জীবনের নিরাপত্তা মানুষের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে রাসূলল্লাহ্ (সা.) নিজের জীবনেও কিসাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ রেখে গেছেন।
উপর্যুক্ত কোরআন ও হাদীসের বাণী দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম প্রতিটি মানুষের প্রাণ ও জীবনের নিরাপত্তার বিধান সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
মাল-সম্পদ সংরক্ষণ
মাল-সম্পদ রক্ষা করা মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে জীবিকার অন্বেষণ ও মাল-সম্পদ অর্জন করে থাকে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকলের বাঁচার সামগ্রী পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সমাজ উন্নয়নে মাল-সম্পদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আল্লাহ্ তা‘আলা সকলকে মাল-সম্পদ প্রদান করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, “যারা কাফের (অবিশ্বাসী) তাদেরকেও আমি জীবন-উপকরণ দিই”।
আল্লাহ্ তা‘আলা যখন কারো রিযিক কেড়ে নেন না, তখন কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কর্তৃক মানুষকে রিযিক থেকে বঞ্চিত রাখার অধিকার নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “পুরুষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে” (সূরা নিসা’ : ৪ : ৩২)।
মানুষ যেমন বাঁচার প্রয়োজনে মাল-সম্পদ অর্জন করতে চায়, তেমনি শান্তির আবাস রচনা ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তার কর্তৃত্বে কিছু সম্পদ রেখে দিতে চায়। মানুষের এ সাধ একদিকে যেমন প্রয়োজনগত, তেমনি স্বভাবজাতও। কেউ তাকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে পারে না। বাঁচার জন্য অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষা এ পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন পূরণ মানুষের জন্য অপরিহার্য। আজকের যে কোনো মানুষ এ কথা জানে। অতীতেও লোকেরা তা জানত এবং তা পূরণের জন্যে অন্যের মাল-সম্পদ ছলে, বলে, কৌশলে করায়ত্ত করতো।
প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার, জালিয়াতি, চৌর্যবৃত্তি ও লুণ্ঠন- এসবের মাধ্যমে যে কোনো মানুষ বা মানুষের দল তাদের অভাব পূরণ করে নিত। সম্পদে শক্তিমানের অধিকার সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল। আধুনিক বিশ্বেও মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাল-সম্পদ রক্ষা করা এক কঠিন কাজ। এমনকি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে কোনো কোনো ব্যক্তিকে প্রাণও হারাতে হয়। ইসলামে অপর কোনো মানুষের মাল-সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “তোমরা অবৈধ পন্থায় একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না” (সূরা আল-বাকারা : ২ : ১৮৮)। অপর আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যে লেনদেন করা হয় তা বৈধ” (সূরা আন্-নিসা’ : ৪ : ২৯)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “সাবধান! যুল্ম করো না। মনে রেখ, কারো পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা বৈধ হবে না” (সহীহুল বুখারী)।
কারো মাল-সম্পদ বা জমিজমা জোরপূর্বক দখল অথবা ভোগ করা নিষিদ্ধ। হাদীসে মাল-সম্পদের অধিকার সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। “সা‘ঈদ ইব্ন যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জবর-দস্তি করে কারো এক বিগত পরিমাণ জমিও অন্যায়ভাবে দলখ করবে, সাত তবক জমি তার গলায় বেড়ি আকারে ঝুলিয়ে দেয়া হবে” (সহীহুল বুখারী, বাবু ইসমি মান যালামা শাইয়্যান মিনাল আরযি, হাদীস নং ২২৭২, ২৯৫৬; সহীহ মুসলিম, বাবু তাহ্রীমিয্-যুলমি ওয়া গাসবিল আরযি ওয়া গায়রিহা, হাদীস নং ৩০২৫; মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ১৫৪২)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের সময়ে জনগণের মাল-সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা ছিল। কেউ কারো মাল-সম্পদে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করতো না। বর্তমান সমাজে প্রত্যেক দিন শত শত, হাজার হাজার চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মানব পাচারসহ বিভিন্নভাবে মানুষের মাল-সম্পদ হরণ করা হচ্ছে। মানুষের এ অধিকারটি যাতে কোনোভাবেই লংঘিত না হয় সে জন্য নবী করীম (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে বিষয়টি মু’মিনগণকে আবারো স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “মনে রেখ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের ‘ইজ্জত আল্লাহ্ তা‘আলা এমন পবিত্র ঘোষণা করেছেন যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, এই শহর এবং এই মাস” (সহীহুল বুখারী)।
‘আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ‘আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি নিজের মাল-সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ” (সহীহুল বুখারী, বাবু মান কাতিলা দূনা মালিহি, হাদীস নং ২৩০০; সহীহ মুসলিম, বাবুদ্-দালীলি ‘আলা আন্না মান কাসাদা ..., হাদীস নং ২০২; সুনানু আবী দাউদ, বাবু ফী কিতালিল-লূসূস, হাদীস নং ৪১৪২; জামি‘উত্-তিরমিযী, বাবু মাজাআ ফীমান কুতিলা দূনা মালিহি ফাহুয়া শাহীদুন, হাদীস নং ১৩৩৯; সুনানুন্-নাসা’ঈ, মান কুতিলা দূনা মালিহি, হাদীস নং ৪০১৯; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, বাবু মান কুতিলা দূনা মালিহি ফাহুয়া শাহীদুন, হাদীস নং ২৫৭০; মুসনাদু আহ্মাদ, হাদীস নং ৬২৩৬)।
কারো মাল-সম্পদ চুরি করলে তাঁর শাস্তি নির্ধারণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “যে চোর রশি চুরি করে এবং চুরির দায়ে তার হাত কাটা হয় আল্লাহ্ সে চোরের উপর অভিশাপ বর্ষণ করেন” (সহীহুল বুখারী, বাবু লা‘আনিস্-সারিকি ইযা লাম ইসাম্মা, হাদীস নং ৬২৮৫)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ