Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একুশে সংস্কৃতির লালন জাতির স্বার্থে কেন অপরিহার্য

প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার মাইলফলক হচ্ছে মহান ভাষা অন্দোলনের স্মৃতি স্মারক মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। সে কারণেই একুশের আলোচনাকে জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে আলাদা করে ভাবার কোন অবকাশ নেই।এই সংস্কৃতিকে জাতির অভ্যন্তরে লালিত ভাবনা থেকে ছিন্ন করারও কোন সুযোগ নেই। শিশুকে যেমনি মা থেকে আলাদা করার অর্থ দাঁড়ায় তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া তেমনি একুশ সংস্কৃতিকে জাতির মৌলিক ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টার অর্থই হলো জাতীয় অস্তিত্বকে কার্যত অস্বীকার করা। দীর্ঘ সময়ের পথপরিক্রমায় কার্যত ভাববার রয়েছে আমরা প্রকৃত চেতনার দিক থেকে একুশকে কতটা সম্মান জানাতে পেরেছি। স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনের মূল বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনে। একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার যে লালন প্রক্রিয়া শত শত বছর ধরে চলে আসছিল সেই চেতনা প্রতিষ্ঠাই ছিল ভাষা আন্দোলনে মূল প্রতিপাদ্য। ঐতিহাসিকভাবে একথাই সত্যি যে, ’৪৭ পূর্ব থেকেই এ প্রবণতা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ’৪৭ পরবর্তী তমদ্দুন মজলিশই প্রকৃতপক্ষে ভাষা তথা জাতীয় সাংস্কৃতিক স্বতান্ত্রিকতা ধরে রাখার লড়াই শুরু করেছিল। পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এ কথা বলা যায়, সুপ্ত চেতনার বাক পরিবর্তন যাই থাকুক বাস্তব হচ্ছে, জাতির অভ্যন্তরে থাকা চেতনার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হয়েছিল ’৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি। এটি মূলত ধারাবাহিকতার অংশ মাত্র। ভাষা আন্দোলন বা প্রতিষ্ঠার মূল বিষয় ছিল একটি মেধা-মননশীল জাতি গঠন। ভাষার বিকাশের অঙ্গীকার নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি। এটাই বাস্তব যে, মেধা-মননে, চিন্তা-চেতনায়, রাজনীতি-ভাবনায় উন্নত না হতে পারলে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। সে বিবেচনায় ভৌগলিক অখ-তা রক্ষার জন্যই শক্তিশালী জাতির প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভৌগলিক অখ-তা রক্ষার জন্য যে আত্মনির্ভরশীলতা প্রয়োজন তা না থাকলে কোন লড়াই দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটি সম্ভব কেবলমাত্র জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে লালনের মাধ্যম্যেই।
যে ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, যাদের কথা আমরা গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোসায় উচ্চারণ করি তারা মূলত এই চেতনা পেয়েছিলেন তাদের পূর্বসূরিদের থেকে। এ ভাষার টিকে থাকাটা খুব সহজ ছিল না। আদৌ টিকে থাকবে কিনা সে সংশয় যে একেবারে ছিল না সেকথাও জোর দিয়ে বলার যাবে না। ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাওয়া গিয়েছিল নেপালের রাজ দরবারে। আজকের দিনে ভাষার সম্মানে সকলের একটু ভেবে দেখা দরকার পরিস্থিতি কতটা গুরুতর হলে বাংলা ছেড়ে আমাদের ভাষার পূর্ব-পুরুষরা নেপালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ৬ষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণকে ব্রাহ্মণ্যবাদের কারণে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এর মাশুল বাংলা ভাষাকেও গুণতে হয়েছে। এ অঞ্চলের সাধারণ বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিষ্পেশিত হবার কারণ ছিল তাদের ধর্ম বিশ্বাস। আর তারই বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলা ভাষার উপর। এসময়টা ছিল কার্যত এক অন্ধকার যুগ। সেই প্রতিবাদের কথাই নীরবে উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্যের প্রচীন নিদর্শন চর্যাপদে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে। ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা নির্যাতিত বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে অশ্রয় নেয়ার ফলে একদিকে যেমন শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে তেমনি নিরাপদ হয় বাংলা ভাষা। এরপর বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই বিকাশকে অধুনিককালেও গ্রহণ করেনি পশ্চিম বাংলার কলিকাতাকেন্দ্রিক দাদারা। মুসলমান শাসনামলে মধ্যযুগে বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা অর্জিত হয়েছে সেকথা তারা মানতে রাজি নয়। বরং যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে মুসলিম যুগে তাই রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এ যুগকে তারা বলছে অন্ধকার যুগ। শুধু তাই নয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী বজ্রকণ্ঠ সম্পর্কেও কলিকাতার বাবুদের ধারণা ছিল নেতিবাচক। এখানেই ভাষার সংস্কৃতি বড় হয়ে দেখা দেয়। সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করবেন যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করতে পারেন।” সংস্কৃতিই একই প্রবাহকে পানি ও জলের বিভাজন মুছতে দেয়নি। সংস্কৃতি কোন আরোপিত বিষয় নয়। আরোপিত হলে তা টিকে না। সংস্কৃতি লালনের সথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিও এখন আর নতুন কিছু নয়। বই মেলা নিয়ে সে কারণেই নানা ভাবনা কার্যকর। এবারেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন বই মেলা মানে মুদ্রিত বইয়ের মেলা। কথা ছোট তবে গভীরতা অনেক। বইমেলা প্রকাশকদের সবচেয়ে বড় বাজার। যুগযুগ ধরে মেলা চলছে। প্রকৃত বিবেচনায় কি আমরা দেশোপযোগী মেধা-মনন সৃষ্টিকারীদের লালন করতে পেরেছি? দেখা যায়, পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে প্রথমে হিন্দিতে অনূদিত হয়ে পশ্চিম বাংলায় প্রকাশিত হবার পর নাম-ঠিকানা পরিচয় পরিবর্তন করে তা নাকি আবার আমাদের দেশে বাংলায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে এরমধ্যে কতটা জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছে তা বোধকরি নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। সে বিবেচনায় সংস্কৃতির যে আলোচনা রয়েছে তাকে এড়িয়ে গিয়ে একুশের সংস্কৃতির কোন রূপ পাওয়া সম্ভব নয়। এই সংস্কৃতির আলোচনাই করেছিলেন সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ। বাংলা একাডেমির বই মেলাতেই তিনি তুলে ধরেছিলেন জাতিসত্তার পরিচয়। এই পরিচয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। প্রেসিডেন্ট জিয়া যে সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিয়েছেন বর্তমান সময়ে অনেকেই তা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। দেখা যাচ্ছে, জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে যেন বিতর্ক সৃষ্টির প্রবণতাও কোন কোন মহলে সক্রিয় থাকছে। ফলে যে বাস্ততার উদ্ভব হয় তা নিয়েই উদ্বিগ্ন অনেকেই।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমাজে এখন সহনশীলতা, অপরের মতকে শ্রদ্ধা জানাতে পারার মতো মানসিকতা নেই বললেই চলে। এবারে যখন অমর একুশের মহান শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দল-মত নির্বিশেষে জ্ঞাপন করা হচ্ছে তখন সমাজে গণতান্ত্রিক বাস্তবতা নেই। বৈষম্য নীতির গ্যারাকলে আটকা পড়ে সমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সূত্র ধরে সমাজের অধিকাংশ মানুষই অধিকারহারা। এটা কোন বিবেচনাতেই একুশের চেতনার সাথে মিলে না। মত প্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকাই যদি সমাজে না থাকে তাহলে একুশ উদযাপনের তাৎপর্য কোথায়? যে মেধা-মনন বিকাশের দাবি নিয়ে প্রতি বছর অমর একুশে আসছে তার প্রকৃত সফলতা পেতে হলে মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া অত্যন্ত জরুরি। সে বিবেচনায় রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে উঠতে গণতান্ত্রিক অধিকারে প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হওয়া জরুরি। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে এটা যেমনি গর্বের তার চেয়েও আরো বেশি গর্বের হচ্ছে, একুশের চেতনার স্বীকৃতি দেয়া। নয়তো যারা মায়ের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তাদের সাথে ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়বে। সকলেই একুশের মৌল চেতনার প্রতি সত্যিকার সম্মান প্রদর্শন করবেনÑ এটাই জাতি আশা করে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একুশে সংস্কৃতির লালন জাতির স্বার্থে কেন অপরিহার্য
আরও পড়ুন