ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
১.
মেয়েটির নাম হাসনা। নিটোল গড়নের বাহ্যিক প্রতিটি অঙ্গের সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে। ধারালো তলোয়ারের মতো মন কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। আবেদন আর আহবান এমনই যে, উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। হাসনার সৌন্দর্য অন্যদের কাঁপিয়ে দিলেও, হাসনা কাঁপে না। সাগরের মতো। উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। ভেতরটা শান্ত, স্থির। পাশের সারির একটি সিটের পরের সিটে বসা হাসনার মুখের একপাশের তীক্ষ্ণ রেখাটি চোখে পড়ছে। কোলের উপর বই নিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছে। ঘাড়ের উপর রেশম কোমল হাল্কা বাদামী চুল ছড়ানো। বাসের জানালা গলে বসন্ত হাওয়া বিলি কেটে যাচ্ছে। চুলগুলো কখনো মুখের উপর এসে পড়ছে। ঝিরঝির করে দুলছে। মনের অজান্তে সেই চুলে যখন তার কঠাল চাঁপা রঙের সূঁচালো আঙ্গুলগুলো চিরুনি হয়ে চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের উপর নিয়ে যায়, তখন যেন দিনের আলোতেও তার চেহারাখানি চাঁদ হয়ে উঠে। গভীর কালো চোখ দুটো যেন স্বচ্ছ দীঘির জলের মতো টলমল করে উঠে। মনে হয়, সাতার কাটি। এ জীবন সার্থক করি।
হুট্ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া। পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্তে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সাধারণ একটি বাসে চড়ে বসেছি। যাচ্ছি বান্দরবান। বন্ধু জাহিদের বাড়িতে। অনেক দিন বলেছিল, চল্, একবার ঘুরে আসি। ভাল লাগবে। চমৎকার জায়গা। নিজের বাড়ি বলে বলছি না। দেখলেই বুঝবি। পাহাড়ের পর পাহাড়। তার উপর বাসা। আজ যাবো কাল যাবো বলে যাওয়া হচ্ছিল না। আমি ঘরকুনো। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ঢাকার অভিকর্ষ এমনই যে একে অতিক্রম করে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। মনও সায় দেয় না। জীবন ও মরনের বন্ধনে এমনভাবে বেঁধে রেখেছে যে, এ বন্ধন ছেঁড়া আমার মতো ঘরকুনোর পক্ষে সম্ভব নয়। এবার জাহিদ খুব করে ধরল। যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়েই যাবে। এমন প্যাঁচ দিল ছুটার উপায় নেই। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সিদ্ধান্ত এবং যাত্রা।
ভাবছিলাম, হাসনার কথা। কীভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ওর নামটি জেনেছি, যখন বাসে উঠে সিট খুঁজছিল, তখন এক মহিলা ডাক দিল-এই হাসনা, এদিকে আয়, তখন। জাহিদকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললাম,
দোস্ত! দেখেছিস? কী সুন্দর! কিছু কি করা যায়?
জাহিদ ঝিমুচ্ছিল। গুঁতো খেয়ে আঁৎকে উঠে বলল,
-কে! কে! কি? কি?
-শ্..শ্! এত চিঁ চিঁ করিস না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মেয়েটাকে দেখ! নয়ন জুড়ানো।
ও হাঁই তুলতে তুলতে আড়মোড়া দিয়ে বলল,
-কি করতে চাস্।
-কি করা যায় জানলে কি আর তোকে জিজ্ঞেস করি।
জাহিদ ফোস্ করে ওঠে,
-আমি জানি না। তুই কি পাগল হয়েছিস? স্থান নাই, সময়-গময় বলে কিছু নেই, যাকে দেখিস, তার প্রেমে পড়িস।
-আহ্! প্রেমের কথা বলছিস কেন!
-প্রেম না তো কি? তুই তো কথায় কথায় প্রেমে পড়িস। বিশ্বপ্রেমিক।
-ঠিক, একদম ঠিক। প্রেমে পড়েছি।
সিট থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম,
-জায়গা দে। বলেই সামনে এগিয়ে গেলাম। হাসনার সিটের পাশে বাসের ছাদের রড ধরে দাঁড়ালাম। মনোযোগ দিয়ে কী একটা বই পড়ছে। মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। একবার তাকালও না। তারপর ঘুরেই হাসনার পাশে বসা মোটাসোটা কালো লোকটিকে বললাম,
-এই যে আংকেল সরে বসুন। দুই পা ছড়িয়ে এভাবে ছড়িয়ে বসলে কিভাবে যাব-আসব। এটা তো বাড়ির ড্রইং রুম না। যাত্রীবাহী বাস।
লোকটির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভাবলেশহীন। তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। তারপর কচ্ছপের ঘাড়ের মতো ছোট ও মোটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন আমাকে জানালা দিয়ে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে শান্তি পেতেন। তা করতে না পেরে পাহাড়সম নিতম্বখানি নাড়াচাড়া দিয়ে খাম্বার মতো পা দু’টো আরও ছড়িয়ে দিলেন। একটা পা আমার পায়ের ওপর এসে পড়ে। তার উরু হাসনার উরুর সঙ্গে ঘঁষা খাচ্ছে। শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। মনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। মনে মনে অসভ্য, ইতর বলে কিছুক্ষণ গালাগালি দিলাম। মনের দাউদাউ করা আগুন তুষের আগুনে পরিণত হয়ে যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সিটে ফিরে আসার সময় হাসনার দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকালাম। মাথা নীচু করে মুচকি হাসছে। মাথাটা তুললই না। বড়ই ইনসাল্ট ফিল করছি। আরে বাবা, একবার তাকালে কী হয়! তোমার টলটল চোখ দু’টো না হয় একবার দেখলামই! এতে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত! রূপ আছে ভাল কথা! রূপটাই দেখাও, দেমাগ দেখাও কেন! তার ওপর মিটি মিটি হাসি! আহ্, পারা যায় না। সহ্য করা যায় না।
চুপচাপ বসে আছি। জাহিদও নিঃশব্দে হেসে পাশ ফিরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি ও হাসি চেপে রাখতে পারছে না। নিজেকে সামলাতে কঠোর পরিশ্রম করছি। মন ঘোরাতে চেষ্টা করছি। বোঝাতে চেষ্টা করছি, হিটলারের মতো মানুষও প্রেমিকের বাড়ির সামনে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বিফল হয়ে ফিরে এসেছে। বিশ্বের বহু জ্ঞানী-গুণীজন রূপসীদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। আর আমি কোন ছাড়! মনের ভেতরটা আকুপাকু করছে। এমন বসন্ত দিনে হাসনার সঙ্গে যাচ্ছি। মনের ভেতর যেন হাসনা আর বসন্ত পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন মনে ধাক্কা লাগে। বাস থামে। দেখে মনে হলো এটি কোনো স্টেশন না। রাস্তার মাঝামাঝি কোনো একটি জায়গা। হাসনা নেমে যাচ্ছে। মনটা হু হু করে উঠে। আহ্, এ জায়গায় কেন নামবে! কেন চলে যাচ্ছে! মনের ভেতর ডাক উঠে, হাসনা...হাসনা। ফেরাতে পারলাম না। ফুস্ করে শ্বাস ছেড়ে মনটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম। শান্তনা দিলাম, পথের দেখা পথেই শেষ হওয়া ভালো।
২.
জাহিদের বোন ঐশী। এইচএসসি পরীক্ষার্থী। খুব সুন্দরী না হলেও একটা চাপা সৌন্দর্য আকর্ষণ করে, যা চট করে চোখে পড়ে না। একটু একটু করে আবিষ্কার করতে হয়। সাদা রংয়ের উপর ঘঁষে যাওয়া গায়ের রং। চোখ দু’টো গরুর চোখের মতো কাজল রেখায়িত। ছবিতে দেখেছিলাম। জাহিদের বাবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মা গৃহিনী। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ওদের বাসায় যেতে হয়। বাসার সামনের বাগানে ফুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক মহিলা। বেশ মায়াবী। দেখলেই মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। বুঝলাম জাহিদের মা। জাহিদ পরিচয় করিয়ে দিতেই হাঁটু ভেঙ্গে সালাম করলাম। তিনি জড়িয়ে ধরলেন। এমনভাবে ধরলেন, কেন যেন চোখ ভিজে উঠল। মায়ের কথা মনে পড়ে। এমন করে মা কবে জড়িয়ে ধরেছিলেন মনে নেই। নিজেকে সংযত করলাম। এসো ঘরে এসো বলে খালাম্মা ডাক দিলেন। যে রুমটি আমার জন্য বরাদ্ধ হলো, সেটি ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে। জানালা দিয়ে পশ্চিমের অনেক দূর দেখা যায়। গাঢ়ো সবুজ পাহাড়ের উপর ঢেউ খেলে দৃষ্টি দিগন্তে মিলিয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে সূর্য। হালকা কুয়াশা পাহাড়ের গায়ে আদরের চাদর বুনে যাচ্ছে। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। দিনটির কথা মনে পড়ল। মনের পর্দায় সিনেমার দৃশ্যের মতো একের পর এক ঘটনা ভেসে ওঠে। একটির পর একটি ঘটনা দ্রুত চলে যাচ্ছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কোথায় যেন একটা মুখ উঁকি দিয়ে হারিয়ে গেল। রিউইন্ড করে এক জায়গায় থামলাম। হাসনার মুখ। কী সুন্দরই না মেয়েটি! তাকিয়ে আছি। এই প্রথম ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। পাতলা সিল্কি ঠোঁটে মিটিমিটি হাসিটি লেগেই আছে। তাকানোতে সংকোচ নেই। কী স্বচ্ছ দৃষ্টি! মনে মনে বললাম, মেয়ে! তুমি এ-ত সুন্দর কেন? একটু কম হলে কী হতো! জানো কি, কত সুন্দর তুমি?
-উঠ্, উঠ্। ভর সন্ধ্যায় কিসের ঘুম? উঠ!
জাহিদের খোঁচায় ভাবনায় ছেদ পড়ে।
-ঘুমাইনি। ভাবছি।
-কী এতো ভাবছিস!
-তুই বুঝবি না দোস্ত। তোর পক্ষে বোঝা সম্ভব না। বললে খ্যাক খ্যাক করে হাসবি। ওটা আমার সহ্য হবে না।
-বুঝিয়ে বললে হাসব কেন?
-ঐ যে...কোন সে হরিনী হরণ করেছে আমার মন....
-ব্যাস্ ব্যাস্। বুঝেছি। আর বলতে হবে না। তুই পাগল হয়ে গেছিস আবীর। কোথাকার কোন মেয়ে, যার ঠিক ঠিকানা নেই, তাকে নিয়ে তুই ধ্যান করছিস। তোর মাথায় ঘিলু-টিলু আছে বলে তো মনে হয় না।
- দোস্ত! আমার সিক্সথ সেন্স প্রখর। কেন জানি মনে হচ্ছে, একদিন না একদিন তার সাথে, তাহার সাথে আমার দেখা হইবেই হইবে...
-দেখা হলে তো কী হবে! কি করবি?
-সে তখন দেখা যাবে। এখন কিছু খেতে দে।
৩.
দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তিতে বেশ জমানো ঘুম হলো। বেহুশের মতো ঘুমিয়েছিলাম। শরীর ঝরঝরে। মন ফুরফুরে। বাগানে হাঁটছি। বসন্তের সকাল। শীত শীত ভাব। জাহিদ ঘুম থেকে উঠেনি। পাহাড়ী ঝিরঝির বাতাসে মন মেঘের মতো ভেসে যাচ্ছে। ঐশী সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্যামল মেয়েটির সৌন্দর্যে টান আছে। হালকা গোলাপী রংয়ের শাড়ি পরেছে। কেমন আপন মনে হচ্ছে।
-আপনারা ঢাকার মানুষ। এই নির্জনতা কি ভাল লাগবে?
যেন কথা বলার জন্যই বলল ঐশী। তারপর বলল, আপনার কথা ভাইয়ার কাছে এত শুনেছি...
ওকে শেষ করতে না দিয়ে বললাম,
-চমৎকার জায়গা! চমৎকার সকাল! এমন সকালের মুখোমুখি প্রথম হলাম। এমন সুন্দর জায়গায় কখনো আসিনি। মনে হচ্ছে, সারাজীবন সকালটি ধরে রাখতে পারলে ভাল হতো।
-সারাজীবন! বলেন কি!
-হ্যাঁ, সমস্যা কি?
-সমস্যা হচ্ছে, শহুরে মানুষের জন্য এ জায়গা নয়। অভ্যস্থতার ব্যাপার আছে। শহুরেদের জন্য এ জায়গা বেড়ানোর জন্য। থাকার জন্য নয়। আমি নিশ্চিত, পনের দিনের মাথায় আপনি হাঁপিয়ে উঠবেন।
বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে নিচের দিকে ধাবিত ছোট ছোট সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাশেই একটি টিলার কাছে চলে এলাম। খুব প্রিয় ফুলের সুবাস নাকে এসে লাগছে। পাশে তাকিয়ে দেখি হাসনাহেনার ঝোপ। থোকা থোকা সরু ফুলগুলো মুখ বুঁজে ঝুলে আছে। যেন সারারাত জেগে দিনে ঘুমোচ্ছে। ঐশী বলল,
-এ গাছটি আমি লাগিয়েছি। আমার প্রিয় ফুল। আপনার প্রিয় ফুল কি?
-হাসনাহেনা।
-তাই! খুব মিলে গেলো তো! বলেই যেন লজ্জা পেল। মাথা নীচু করে ফেলে।
স্বাভাবিক করার জন্য বললাম,
-চাঁদনী রাতে যখন হাসনাহেনার সুবাস ধাক্কা দেয়, তখন আর ঠিক থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। সুবাসিত হয়ে পড়ে মন। ভেতরটা কেমন কেমন করে। বলতে চাই, পারি না। ফুলের গন্ধের কত শক্তি, তাই না?
ঐশী অপলক তাকিয়ে আছে।
-ঐ তোরা ওখানে কি করিস? বাসায় আয়, নাস্তা খাবি না!
জাহিদের রুক্ষ কণ্ঠে চমক ভাঙ্গে।
৪.
নাস্তা খাচ্ছি। জাহিদের বাবা, মা, ঐশীও বসেছেন। জাহিদ বলল,
-তোকে আজ পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাব। এখানে যা দেখছিস, এগুলো পাহাড় নয়। টিলা। আসল পাহাড় আরো দূরে।
ওর বাবা বললেন,
-গাড়িটা নিয়ে যাস্। ড্রাইভারকে বলে দেব। নামিয়ে দিয়ে আসবে।
ঐশী মহা আগ্রহ নিয়ে বলল,
-আমিও যাব!
-তোর যাওয়া লাগবে না। অন্য সময় যেতে পারবি। পাহাড় তো আর উড়ে যাচ্ছে না।
জাহিদের কথার তোড়ে হাওয়াই মিঠাইর মতো চুপসে যায় ঐশী।
খারাপ লাগল। বললাম,
-আমরা সবাই মিলেই তো যেতে পারি। একটা পিকনিকের মতো হয়ে যাবে।
খালাম্মা বললেন,
-তোমরা যাও বাবা! আমরা তো এখানেই থাকি।
আমরা গেলাম। ঐশীর যাওয়া হয়নি। অভিমানে ফুলে ফুলে উঠে বলল,
-তোমরাই যাও।
জাহিদ ভ্রুক্ষেপ করেনি। আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। পাহাড়ের কোল বেয়ে এঁকেবেঁকে গাড়ি ছুটে চলেছে। নিচের দিকে তাকালে বুক ফড়ফড় করে। মনে হয় এই বুঝি পড়লাম! পাহাড়ের নিচে যেখানে গাছ ঘন হয়ে উঠেছে, দেখলে মনে হয় সবুজ ঘাসের গালিচা, ঝাপিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিই। ঘন্টা খানেক এভাবে চললাম। জাহিদকে তাড়া দিলাম,
-আর কত দূর! কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
-স্বপ্নের রাজ্যে! যেখানে গেলে মন স্বপ্নে ভেসে যায়। আ পারফেক্ট ড্রিমল্যান্ড!
-স্বপ্নের রাজ্য! বাংলাদেশে! অ্যাবসার্ড!
-অ্যাবসার্ড নয়, দেখলেই বুঝবি।
আরও আধা ঘন্টা চলার পর জাহিদ যেখানে নিয়ে গেল, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কেবল মনে হচ্ছে, কল্পনা নয় তো!
জাহিদ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-দেখেছিস, কোথায় নিয়ে এলাম!
প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে, ধারণা দূরে থাক, কল্পনায়ও আসেনি। সবুজ পাহাড়গুলোর মাথা আকাশে ঠেকেছে। দূর থেকে মনে হয় আকাশে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। একটু পরেই আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠবে। দু’পাশের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছোট্ট নদী, হাঁটু পানি নিয়ে পাথরের উপর দিয়ে কলকল করে ছুটে চলেছে দূরে...ঐ দূরে। কী স্বচ্ছ! ছোট্ট শিশুরা পাথর কুড়াচ্ছে। অনেকে পানিতে নেমেছে। যারা সাঁতার জানে না, তাদের ডুবে মরার ভয় নেই। পুরুষরা প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পানিতে নেমেছে। মেয়েরা কেউ সালোয়ার, কেউ শাড়ি টেনে হাঁটু পর্যন্ত তুলে হাঁটাহাঁটি করছে। তাদের শুভ্র, হলদেটে পায়ে শীতল পানি পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পানি হতে পারলে এ জীবন সার্থক হতো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে চুমিয়ে চুমিয়ে দিতে পারতাম! পাশে ঝাউ বন। গাছের পাতা বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। পাখির কিচিরমিচিরের মধ্যে কোকিলের ডাকও ভেসে আসছে। অপূর্ব সুরলহরী। ঝাউ বনের মধ্য দিয়ে লাল মাটির সরু পথ চলে গেছে বনের গভীরে। এখানে আকাশ অনেক নীল! এমন নিখাদ নির্মল নীল কখনো দেখিনি। ঝকঝক করছে। মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, এখানে আমি একা কেন! একা আসা ঠিক হয়নি। পাপ করেছি! অপরাধ করেছি! হাহাকার করে ওঠে মন। মনের মধ্যে কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে, হে সুন্দর আমার-কোথায় তুমি, ক-ত দূরে!
অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে চলেছি। ফেসবুকে আপলোড করা হচ্ছে। কত লাইক আর কমেন্টস! ক্লান্ত লাগছে। ঝাউ বনের ভেতর নরম ঘাসের উপর বসে পড়লাম। ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে চুমুক দিচ্ছি। চোখের সামনে প্রকৃতি স্থির হয়ে আছে, যেন বিশাল ক্যানভাসে শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি। এখানে না এলে প্রকৃতি কি, বুঝতে পারতাম না। জাহিদকে বললাম,
-দোস্ত! থ্যাঙ্কস! আ পারফেক্ট ড্রিমল্যান্ড!
শোয়া থেকে উঠে বসে জাহিদ বলল,
-এখন এ কথা বলছিস! অথচ আমার কথা তো উড়িয়েই দিয়েছিলি।
-আসলে প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে, ভাবতে পারিনি। ঢাকার ইট, পাথর আর চার দেয়ালের মাঝে থাকতে থাকতে মনের সীমাও ছোট হয়ে গেছে। এখানে এসে মনে হলো পৃথিবী কত সুন্দর! তোকে ধন্যবাদ।
-এতো ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশে এর চেয়েও অনেক সুন্দর জায়গা আছে। আমরা জানি না। জানি না বলেই কেবল বিদেশ দৌড়াই।
-থাক্, এতো গভীরে গিয়ে কাজ নেই। আমরা তো এসেছি। কথা বলতে বলতে দূরে একটি মেয়ের উপর দৃষ্টি থেমে যায়। পরনে আকাশী রংয়ের শাড়ি, পিঠের উপর ছড়ানো চুল। হলদেটে গায়ের রং। খালি পায়ে পানিতে হাঁটছে। পাথর কুড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, মুহুর্তে প্রকৃতির সব সৌন্দর্য শুষে নিয়ে মেয়েটি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সৌন্দর্য মানুষের আকৃতি ধারণ করেছে।
জাহিদকে বললাম,
-দ্যাখ, দ্যাখ, মেয়েটি সুন্দর না!
জাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
-আবার! নাহ্ তোকে নিয়ে কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। যেখানে-সেখানে কাত হয়ে পড়িস। এখানেও...
-আ-হা! এত বিরক্ত হচ্ছিস কেন। সুন্দর মানুষ দেখতে ক্ষতি কি!
-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হচ্ছে, দেখামাত্র তোর প্রেমে পড়ার রোগ। কখনো ক্যাম্পাসে, কখনো বাসে, কখনো মার্কেটে আর এখন এখানে। তোর এই ফাইসকামী আমার অসহ্য লাগে।
-এভাবে বলছিস কেন? এখানে প্রেমে পড়ার কি আছে? মেয়েটি সুন্দর, তাই তোকে বললাম। আর সুন্দরকে সুন্দর বলব না! এটা কেমন কথা!
তর্কযুদ্ধ চলাকালীন দেখলাম মেয়েটি আমাদের দিকে আসছে। যতই আসছে, চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মুখের আকৃতি ফুটে উঠছে। জাহিদ লাফিয়ে উঠে বলল,
-এই দ্যাখ তো, ঐ মেয়েটি না! যাকে বাসে দেখেছিলাম! নামটা যেন কি! হাস..হাস, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। হাসিনা, হাসিনা!
ততক্ষণে আমার মুখ হাঁ হয়ে ঝুলে আছে। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
-হাসনা! দোস্ত! হাসনা!
আমাদের পাশ দিয়েই হেঁটে গেল। একবারও তাকায়নি। একটু দূরে চাদর বিছিয়ে বসে। ব্যাগ থেকে বই বের করে। কোলে নিয়ে পড়া শুরু করে। মুখে সেই মিটিমিটি হাসি। জাহিদকে বললাম,
-দ্যাখেছিস, বলেছিলাম না! আবার দেখা হবে!
-তাই তো দেখছি! দোস্ত! কোইনসিডেন্স! কাকতাল!
-কাকতাল মানে! এটা মনের টান! আমার সিক্সথ সেন্সের কথা তুই জানিস না? যা বলি তাই হয়!
-দ্যাখ, এসব সিক্স-সেভেন-এইট, হাবিজাবি, ননসেন্স কথা বলবি না। এটা কাকতাল ছাড়া কিছুই নয়।
আমরা যখন তর্ক করছিলাম, তখন দেখলাম হাসনার পাশে আড়াই মনের বস্তার মতো থপ্ করে বাসের সেই লোকটি এসে বসে। সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁট গোল করে ফোঁ ফোঁ করে ধোঁয়ার রিং বানানোর চেষ্টা করছে। হচ্ছে না। বাতাসে ধোঁয়া ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমার মনটাও নদীর তীরের মতো একটু একটু করে ভাঙ্গছে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একেবারে ধসেই গেল। হাসনার মুখখানিও লোকটির এলোমেলো সিগারেটের ধোঁয়া আড়াল করে চলেছে। যেন চন্দ্রডুবি হচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।