পঞ্চাশ বছরেও গৃহীত হয়নি দূরদর্শী পার্বত্যনীতি
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের মানুষ নানা আঙ্গিকে নিজেদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ দিক হিসেবে
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমাকে কিছু লিখতে বলা হয়েছে। সেজন্য প্রথমেই জগতসমূহের প্রতিপালক রহমান রহীম আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজার শোকর, তিনি আমাকে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদবীতে চাকরিরত থাকাকালীন এদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, অতঃপর তিনিই আমাকে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরও জীবিত রেখেছেন এদেশের অগ্রযাত্রা স্বচক্ষে অবলোকন করার এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কিছু লিখার সুযোগ প্রদানের জন্যে। এটা আমার পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে।
আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন হঠাৎ করে দানা বেঁধে ওঠেনি, তেমনি জাতিগত সংগ্রামও একদিনে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি। নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর আত্মাহুতির বিনিময়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের চরম পরিণতিই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট। বস্তুত নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত বাসনা আর স্বপ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে একাত্তরের বাংলাদেশ, আমাদের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। বস্তুত রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি- এ দুটো উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যেই নিবেদিত ছিল আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে হলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, স্বাধীনতা সনদ তথা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং যে প্রেরণা ও স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল তার স্বরূপ বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। আর তাই আমাদেরকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
আমরা এও জানি, ১৯৫৭ সনের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হওয়ার পর ইংরেজরা পরবর্তী প্রায় দু’শ বছর এদেশ শাসন করে। বিজাতীয় শাসন, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের যাতাকলে জাতি নিষ্পেষিত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে এ দেশ মুক্ত হয় বটে, তবে সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালি জাতি ভোগ করতে পারেনি। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকচক্রের ঔপনিবেশিক মনোভাব, আচার-আচরণ ও কার্যব্যবস্থা এ জাতিকে করে তুলে শোষণ, বৈষম্য ও জুলুমের শিকার। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে এদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরে লাহোর প্রস্তাব’-এর ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছে, প্রয়াস চালিয়েছে স্বাধিকার অর্জনের। ১৯৫২ সালে রক্তস্নাত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন; ’৫৪-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়; ’৬২-এর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-এ শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা; ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন তথা আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ৬-দফার পক্ষে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে এদেশের মানুষের ম্যান্ডেট- এসব কিছু মিলিয়ে ২৩ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও ব্যথা-বেদনাই তৈরি করেছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট।
প্রকৃতপক্ষে ’৬৯-এর গণআন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে গণরায়ের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এই নির্বাচনে শেখ মুজিব ৬ দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করেন। সমগ্র পাকিস্তানেও তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। অনেকেই মনে করেন, এ সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের একটা সমঝোতা হয় যে, শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকবেন। সবই যথাযথভাবে এগোচ্ছিল। ৩ মার্চ সংসদের অধিবেশনও হওয়ার কথা ঢাকায়। কিন্তু বাঁধ সাধলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি বিরোধী দলের আসনে বসতে নারাজ। জেনারেলদের অনেককেই তিনি স্বপক্ষে টানতে সক্ষম হন। ভুট্টো হুঙ্কার ছাড়লেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তিনি কাউকে ঢাকায় আসতে দেবেন না। ভয় পেয়েই হোক, অথবা গোপন সমঝোতার ভিত্তিতেই হোক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ অকস্মাৎ জাতীয় সংসদের (৩ মার্চের) ঢাকা অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। শুরু হলো গণবিস্ফোরণ।
রাজনৈতিক সংকট নিরসনকল্পে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা আগমন করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১৬ থেকে ২১ মার্চ কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনার আলোকে প্রেসিডেন্ট হাউস হতে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ পেয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দলসহ ২১ মার্চ ঢাকা আসেন। এবং ২১ মার্চ হতে ২৪ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকের অগ্রগতি সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় গণমাধ্যমে। সাধারণ জনগণ এসব কথায় আশ্বস্ত হয়ে নির্ভয়েই ছিল স্ব-স্ব স্থানে। অতঃপর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২৪ মার্চ (২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়া শেষ হলেও) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা প্রচার করবেন এবং কবে এই ঘোষণা প্রচার করা হবে, সে সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রকাশ্যে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে আলোচনার নামে শুরু থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া সরকার ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১১টায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সংঘটিত করে বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যা। শেখ মুজিবকে বন্দি করা হয়। এর কিছু আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচী চলে যান।
২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতেই চট্টগ্রামের ষোলশহর নামক স্থানে অবস্থানরত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ বা উপ অধিনায়ক মেজর জিয়া পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অতঃপর ২৭ মার্চ বিকেলে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘোষণাটিও পাঠ করেন। দেশব্যাপী মুক্তিপাগল জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন-মরণ সংগ্রামে। জিয়ার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত ও দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের অন্যান্য সেনানিবাসসমূহে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার এবং সৈনিকগণ জীবনপণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, গড়ে তোলে সশস্ত্র প্রতিরোধ। তাদের সাথে যোগ দেয় ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। সামরিক অফিসারদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ যুদ্ধের পাশাপাশি দেশের প্রায় সকল নগর, বন্দর ও শহরে, থানা ও জেলা সদর দপ্তরে, রেলওয়ে স্টেশনে, হাটে-বাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়। ফলে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন রূপ পরিগ্রহ করে এক পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা সংগ্রামে। আর সে স্বাধীনতা সংগ্রামই ছিনিয়ে আনে মহান বিজয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ন’মাসের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের। একটি মর্যাদাবান ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর।
এ যুদ্ধ ছিল আমাদের বাঁচার সংগ্রাম, আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। এ ছিল বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির লড়াই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াই; এ ছিল যথার্থ অর্থে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লড়াই। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনতা থেকে বের হয়ে এসে আমরা শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি তা কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল এদেশের শোষিত, বঞ্চিত ও নিরন্ন মানুষের মুক্তি। তাই, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল নির্দিষ্ট কিছু প্রত্যাশাকে সামনে রেখে, যে প্রত্যাশা ব্রিটিশ উপনিবেশ-উত্তর পাকিস্তানে পূরণ হয়নি। আর পূরণ হয়নি বলেই প্রয়োজন হয় শৃঙ্খল থেকে মুক্তির। আর মুক্তির অপর নাম স্বাধীনতা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের এ স্বাধীনতা।
পূর্বেই বলা হয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধ ছিল দুটো উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত; মুক্তি এবং স্বাধীনতা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দু’য়ের কথাই বলেছিলেন। বলা প্রয়োজন যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ঘোষণাপত্র দিয়েছিল তাতে স্বাধীনতার দাবি ছিল না, ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি, স্বাধিকার অর্জনের দাবি। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, পাকিস্তান হবে একটি প্রজাতন্ত্র, যার প্রতিটি ইউনিট ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসন ভোগ করবে। অবশ্য সত্তরের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু নির্বাচনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে বদলে যায় সবকিছুই, যা ছিল অস্পষ্ট ইচ্ছা, তা রূপ নিয়েছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে। যে আশা-আকাক্সক্ষাকে নানাবিধ উৎপীড়ন-নিপীড়ন ও ভয়-ভীতির মাধ্যমে এতদিন দাবিয়ে রাখা হয়েছিল, তা সবেগে বেরিয়ে এসেছে- আর তাই ছয় দফা শেষ পর্যন্ত পরিণত হলো এক দফায়। সেই এক দফা হলো রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার যে সনদ রচিত ও গৃহীত হয়, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীনতার সনদে বলা হয়েছে: In order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice. (অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে।) এ সম্বন্ধে বলা চলে যে, সাধারণভাবে আমাদের দেশের মানুষ সমাজের সকল ক্ষেত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এবং সে লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা নিরলস সংগ্রাম করে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। স্বাধীনতা সনদে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এমন তিনটি আদর্শ, যা থেকে আমরা পাকিস্তানি শাসনামলের ২৩ বছর বঞ্চিত ছিলাম। সেই ২৩ বছরে এগুলোর জন্যই আমাদের প্রত্যাশা পুঞ্জীভূত হয়েছিল এবং এগুলো অর্জনের জন্যই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
তাই সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা যথার্থভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সনদপত্রে।
একাত্তরের রণাঙ্গনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করা হলে নিশ্চয়ই আমার জবাব হতো: ‘আমরা যুদ্ধ করছি দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় অত্যাচার থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য, দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।’ বস্তুত তখন আমরা আমাদের নিজের দেশেই পরবাসী ছিলাম, ছিলাম নানাবিধ লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার, প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে, আর তাই প্রাণের ভয়ে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। নিজের করে দেশকে ফিরে পাওয়াই ছিল আমাদের কাছে তখনকার মতো সবচেয়ে বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, তা ছিল পাকিস্তানি দখলদারবাহিনীমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাই বলে, আমাদের মাঝে কোনো স্বপ্ন একেবারে ছিল না, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এ দেশকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রত্যেকের মাঝে অনেক আশা ছিল, ভরসা ছিল, স্বপ্ন ছিল। এদেশের দুঃখী মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি ছিল প্রধান লক্ষ্য। সে মুক্তি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। আমরা ভেবেছিলাম, স্বাধীনতার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়ে তোলতে সক্ষম হব যেখানে সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনার চির অবসান ঘটবে, নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা কাজ করে যাব, আমাদের মাঝে সুপ্ত প্রতিভা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে, আমাদের সামনে খুলে যাবে এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার। এক আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সমর্থ হব।
আসলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও চেতনা তাকেই বলবো, যে উদ্দেশ্য ও চেতনার সাথে এ দেশের আপামর জনসাধারণের আশা আকাক্সক্ষা ও চিন্তা-চেতনা সম্পৃক্ত ছিল, যে প্রেরণা ও স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের জনগণ যুদ্ধ করেছিল, যে সব মহান উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল, যে গণআবেগ, গণআকাক্সক্ষা ও গণচেতনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তাই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। যে চেতনা ও আকাক্সক্ষার সাথে এ দেশের জনগণ সমষ্টিগতভাবে সংশ্লিষ্ট। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এ দেশের বৃহত্তর জনগণের চিন্তা-চেতনায় যে মনোভাব লালিত- তাই হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্ধারক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, প্রকৃতি এবং লক্ষ্য থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তি, গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষুধা-দারিদ্রের অবসান। এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল একটি মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে থাকবে রাজনৈতিক অধিকার, বিরাজ করবে একটি মুক্ত ও উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ, থাকবে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার, থাকবে অর্থনৈতিক অধিকার (সাম্য ও ন্যায়বিচার) এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা, ঘটবে সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সর্বোপরি থাকবে সামাজিক স্থিতিশীলতা, সুবিচার, নিরাপত্তা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা। আর সে কারণে আমাদের এ যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, বরং ছিল মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব কোনো দল বা গোষ্ঠীর একার নয়, সমগ্র জাতির। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, কেননা, দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ একমাত্র দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৯ মাস প্রলম্বিত এক রক্তাক্ত সশস্ত্র সমরে অংশ নিয়েছে এবং লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণের এবং লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়টি একদিকে যেমন জাতীয় আবেগের বিষয়, তেমনি জাতীয় সম্মিলনেরও বিষয়। সমগ্র জাতিকে সব ভেদাভেদ ও পার্থক্য ভুলে একদেহে লীন হয়ে যাবার চেতনা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে এক অসাধ্য সাধন করে অর্জন করেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাই আমাদের যেমন স্মরণ করিয়ে দেয় এদেশের মানুষের অভূতপূর্ব দেশপ্রেম ও গৌরবময় বীরত্ব গাথার কথা; স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, বাংলা মায়ের সেই সব দামাল সন্তানদের কথা যারা দেশমাতৃকার টানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে, বর্বরতার শিকার হয়ে অথবা রণাঙ্গনে জীবন বাজী রেখে লড়াই করে যারা তাদের অমূল্য জীবনকে অকাতরে উৎসর্গ করেছেন এ দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য। তেমনি তাগিদ দেয় স্বাধীনতাযুদ্ধের উদ্দেশ্য, চেতনা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার, তাগিদ দেয় এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ইতিহাসকে সমুন্নত রাখার।
যদিও বলা চলে, স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের ইতিহাস কেবলি এক আশা-নিরাশা আর হতাশার ইতিহাস। তাই বলে রাষ্ট্রযন্ত্র থেমে থাকেনি, নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে সম্মুখপানে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে নিজেকে যথোপযুক্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। একাত্তর থেকে দু’হাজার একুশ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে বহু পরিবর্তন এসেছে। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা ১৬ কোটিতে পরিণত হয়েছে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। এ পরিবর্তনের জোয়ার আজ সর্বত্র লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে রাজনীতি, সমাজ নীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, আবহাওয়া ও পরিবেশ এমনকি পরিবর্তন এসেছে এদেশের মানুষের সার্বিক চিন্তা-চেতনায়। সমাজ-সংস্কৃতিও এক স্থানে থেমে নেই, আইন-শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ চেতনায়ও পরিবর্তন এসেছে। এ নিরন্তর পরিবর্তনের সবকিছু ইতিবাচক ধারায় ঘটেছে- এমনটি বলা যাবে না। তবে বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে বিপর্যয়ের মাঝেও ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি, নানাবিধ হতাশা ও নৈরাশ্যের মাঝেও আশায় বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখার শক্তি এবং সর্বোপরি শত বাধাবিপত্তির মাঝেও সামনে এগোবার শক্তি।
আর্থসামাজিক অগ্রগতির পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অসামান্য। ইন্টানেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসছে ২৭.৯ (২০১৯-২০ অর্থ বছরে) বিলিয়ন ডলারের এই রপ্তানি খাত থেকে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভরসা। বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির মূলে ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে গুটিকয়েক বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করতেন। এখন দেড়শতাধিক দেশে ৮০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন। রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১৮.২ বিলিয়ন ডলার (সূত্র : ইন্টারনেট)। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪১.৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে (ঝড়ঁৎপব: উযধশধ ঞৎরনঁহব,গধৎ ১৮, ২০২১)।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আকার বেড়েছে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে ব্যাপকহারে। ইউরোপ-আমেরিকার চেইন শপগুলোতে স্থান করে নেয়ার মতো মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি ও রফতানি করছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক বাণিজ্যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ফোরামে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। বাজেট তৈরিতে বিদেশ নির্ভরতা পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে কমে আসছে। সামষ্টিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অগ্রগতির এ ধারা ব্যক্তি জীবনেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে কেন্দ্র করে নানা শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে দেশের আনাচে-কানাচে। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার, স্বাক্ষরতা, স্কুলে ভর্তি, বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রাপ্তি, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার, মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার, মাথাপ্রতি ফোন বা মোবাইল- এসব বিবেচনায় গত পাঁচ দশকে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
তবে, এতসব সাফল্যের পরও অপ্রাপ্তি এবং আশা ভঙ্গের দিকও নিতান্ত কম নয়। চরম বাস্তবতা হচ্ছে যে, শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন বলতে যা বুঝায় তা এখনো সুদূরপরাহত, স্বাধীনতার অর্থনৈতিক সুফল সকলের ঘরে পৌঁছে দেয়ার যে কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, সে কাজটি এখনও বহু, বহু দূরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আমরা এখনো আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ধারায় প্রতিফলিত করতে পারিনি। এখনো আমরা এদেশের নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারিনি, পারিনি তাদের মৌলিক অধিকার ও প্রয়োজনকে মেটাতে, পারিনি বিপুল মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে, পারিনি মানবিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সর্বোপরি আমরা এখনো পারিনি একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিদেশি সাহায্য ব্যতীত নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে। যে অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম আকাক্সক্ষা, বিগত পাঁচ দশকে তার পূরণ হয়েছে যৎসামান্য। শিল্পের বিকাশ ও প্রসার ঘটেছে নগণ্য। পুঁজি বিনিয়োগ যেভাবে হওয়া প্রয়োজন ছিল সেভাবে হয়নি। উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত শ্লথ। এখনো এদেশের সিংহভাগ মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখনো এদেশের ৬৭% কর্মক্ষম মানুষ বেকার বা অর্ধবেকার। আমাদের মাথাপিছু আয় সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যেও সর্বনিম্ন।
সামাজিক বৈষম্যও আগের তুলনায় বহুলাংশে বেড়েছে। বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর যে সম্পদ উৎপন্ন হচ্ছে তা কুক্ষিগত হচ্ছে গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে। পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের তুলনায় এখন এদেশে অতি বিত্তশালী লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে লক্ষাধিক। এ সময়ের মাঝে ধনী আরো ধনী হয়েছে, পাশাপাশি মানুষের দারিদ্র্য আরো বেড়েছে এবং সর্বোপরি ভূমিহীন ও গৃহহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। জীবন এবং জীবিকার সন্ধানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ সহায় সম্বলহীন মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানীর বস্তি ও ফুটপাথে এসে ভিড় জমাচ্ছে। এজন্যই শহরগুলোতে বস্তির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এজন্য রাষ্ট্রীয় দুবৃত্তায়নকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই বলা চলে, যে আমূল পরিবর্তনের আশা নিয়ে, যে মুক্তির লক্ষ্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আজকের বাংলাদেশ তার প্রতিফলন খুবই কম। যে চেতনা ও সাহস নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কর্মকান্ডে সেই মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ও পর্যাপ্ত প্রতিফলন ও প্রতিভাস পড়েনি। কথা ছিল, আমাদের নানাবিধ রাজনৈতিক দল এবং তাদের মধ্যকার মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্তে¡ও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আমাদের মাঝে যে অভেদ্য জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, যে কোনো মূল্যে তাকে ধরে রাখতে হবে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে; কথা ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রকে একটি সুখী, নির্ভেদ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি পরিপূর্ণ, স্বনির্ভর এবং প্রগতিশীল সমাজে রূপ দেয়া হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কোনোটাই অর্জন সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও আমাদের সে কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র এখনো আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়নি। বাকস্বাধীনতা অনেকাংশে খর্ব এবং সাধারণ মানুষ বৃহৎ অর্থে অধিকার বঞ্চিত। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও তাহজিব-তমদ্দুনের বিরুদ্ধে চলছে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ বিরাজ করছে মিথ্যার বেশাতি। অন্যায়, অসত্য, অনাচার ও অবিচার সমাজে আজ দোর্দন্ড প্রতাপে দেদীপ্যমান। মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় নিঃশেষিত ও বিপন্ন। বিবেক ও মনুষ্যত্ব আজ লাঞ্ছিত ও অপমানিত। দুর্নীতি, দুঃশাসন, দলীয়করণ, লুটপাট, দখল বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, মানব পাচার প্রভৃতি অপকর্ম চলছে অবাধে। ঘরে বাইরে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রতিদিন খাল-বিল-নদী নালায় মানুষের লাশ ভেসে উঠছে। গুম, খুন, অপহরণ, মামলা, হামলা, নির্যাতন, নিপীড়নে বিরোধী দল দিশেহারা। আইনের শাসনের প্রচন্ড অভাব। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, উদারতা, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নির্বাসিত। ফলে সব গৌরবই যেন আজ ঢাকা পড়ে যেতে বসেছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের পরাধীনতার গ্লানি মুছে দিয়েছে, নিজেদের দেশকে মনের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। পাঁচ দশকের স্মৃতি জড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই পদার্পণ করেছে আশা ও আনন্দের একটি নতুন শতাব্দীতে। বাংলাদেশ এখন পূর্ণ যুবক-নয় কোনো শিশু রাষ্ট্র, নয় কোনো যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ। প্রাপ্তির আলোয় আজ প্রত্যাশাকে দেখার সময়, সামনে এগিয়ে যাবার পরম ক্ষণ, ভবিষ্যত স্বপ্নের মুহূর্ত। তাই, বিগত পঞ্চাশ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে শিক্ষা নিতে হবে, শপথ নিতে হবে সুখী, সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের। ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎ সাফল্যের মিনার। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে আমাদের। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা সংরক্ষণের লড়াই আরো অনেক কঠিন। তবে আশার কথা, যে জাতির জীবনে আত্মত্যাগ ও গৌরবের মহিমায় সমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিহাস আছে, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের এমন সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও নজির যাদের আছে তাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধের এ সমৃদ্ধ চেতনা তাকে ভবিষ্যতেও পথ দেখাবে।
লেখক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।