চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ পাঁচ ॥
তাদের থেকে কিসাস (জীবনের বিপরীতে জীবন) আদায় করা হবে না। বরং ভুলবশতকৃত হত্যার ন্যায় তাদের থেকে দিয়াত নেয়া হবে। তবে বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতিকে গভীরভাবে বিবেচনা ও পর্যবেক্ষণ করা উচিত যে, দুর্ঘটনা কারো সরাসরি হস্তক্ষেপ ঘটেছে না কোনো কারণবশত।
এ বিষয়ে ফকীহগণের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় : হানাফী মাযহাবের ফকীহ আলাউদ্দিন আলকাসানী [মৃ.৫৮৭হি.] (রহ.) বলেন, জন্তু যদি কোচোয়ানের হাত থেক পারিয়ে যায় বা ছুটে যায়, তাহলে সে মুহূর্তে জন্তু যা ক্ষতি করবে কোচোয়ান তায় বহন করবে না। এর দলিল হল, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “পশুর আঘাত বিনিময়শূন্য”। “এটি মুহাদ্দিসগণের নিকট অতিপ্রসিদ্ধ একটি হাদিস। সিহাহ সিত্তাসহ অধিকাংম মৌলিক হাদিস সংকলনে হাদিসটি বিধৃত হয়েছে। (ইমান বুখারী, আল জামি, আসসাহীহ, কিতাবুয যাকাত, বাবু ফীর রিকাযি আল খুসুম, খ.২,পৃ.৫৪৫ হাদিস নং ১৪২৮)।” তাছাড়া জন্তু হাতছাড়া হওয়া ও পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোচায়ানের কোন ভূমিকা নেই। জন্তুকে অন্যের ক্ষতি করা থেকে বাধা দেয়ার ক্ষমতাও কোচোয়ানের নেই। সুতরাং এ জন্তুর কারণে সংঘটিত ক্ষতির কারণে কেউ দায়বদ্ধ নয়।“ আবূ বকর ইবন মাস’উদ আল-কাসানী, বাদাইউস সানাইঈ ফী কারতীবিশ শারাঈ (বৈরুত: দারুল কিতাব, ২য় সংস্করণ, ১৪০২ হি.),খ.পৃ.২৭৩।”
মালিকী মাযহাবের ইমাম শিহাবুদ্দীন আহমাদ কারাফী [৬২৬-৬৮৪হি.] (রহ.) বলেন, জন্তু যদি আরোহীকে নিয়ে দৌড় দেয়, আরোহী যদি মনে করে এমতাবস্থায় জন্তুকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে সে উল্টে যাবে, তাহলে জন্তু যা ক্ষতি করবে আরোহী তার দায় বহন করবে। কেননা তার আরোহণের কারণেই ক্ষতি হয়েছে। “আল-কারাফী, আয যাখীরা, খ.১২.পৃ২৬৬।”
শাফিয়ী মাযহাবের ফকীহ শামসুদ্দীন মুহাম্মদ আর রামালী (রহ.) [৯১৯-১০০৪ হি.] (রহ.) বলেন, আরোহী যদি সাধারণত জন্তুকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়; কিন্তু আচমকা ঘটে যাওয়া কোন কারণে হঠাৎ জন্তু তার আওতায় বাইরে চলে যায়, যেমন মজবুত রশি ছিড়ে গেল, এরপর জন্তুর ফকীহই এ মত পোষণ করেন। “এ মতটি হানাফী ও হাম্বলী ফকীগণদের মতের অনুরূপ।” তবে নির্ভরযোগ্য মত হলো কোচোয়ান দায় বহন করবে। “রামালী, নিহায়াতুল মুহতাজ, খ.৮.পৃ.৩৯ : আব্দুল কারীম আর রাকীঈ, আল আযীয মরহুল ওয়াজীয (বৈরুত; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১৭ হি.) খ.১১.পৃ.৩৩১।” হাম্বলী ফকীহ শামসুদ্দীন ইবনু মুফলিহ [৭০৮-৭৬৩ হি.] (রহ.) বলেন, কোচোয়ানের কোন ত্রুটি ছাড়া জন্তু যদি কোচোয়ানের আওতার বাইরে চলে যায়, তাহলে কোচোয়ান দায়বদ্ধ থাকবে না। “মুহাম্মদ ইবন মুফলিহ, আল ফুরু (বৈরুত; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ,১৯৯৭ খ্রি.), খ.৬.পৃ.৬; মানসূর আল-বাহুতী, শরহু মুনতাহাল ইরাদাত (বৈরুত; মুআসসাতুর রিসালাহ, ২০০০খ্রি.) খ.৬,পৃ,৮১।”
মোটকথা, এক বিষয়ে ফকীহদের মাঝে দুটি ভাগ রয়েছে। হানাফী ও হাম্বলী ফকীহদের মতে, সে ক্ষতিপূরণ বহন করবে না। যেহেতু কার্যত ক্ষতির সংঘটন তার পক্ষ থেকে হয়নি, যেহেতু তার ইচ্ছা এখানে অনুপস্থিতি। মালিকী ও শাফিয়ী ফকীহদের মতে, ব্যক্তি ক্ষতির দায় বহন করবে। কেননা, কার্যত সে-ই ক্ষতির সংঘটক। জন্তুর দৌড় বিষয়টি ক্ষতিপূরণ রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখে বলে তারা মনে করে না।
আধুনিক অনেক ফকীহ মনে করেন, যদি নাগালের বাইরে চলে যাওয়া বা নিয়ন্ত্রণবিহীন হওয়া জন্তুর স্বভাব ও অভ্যাস আরোহীর জানা থাকে, তাহলে অবশ্যই সে ক্ষতিপূরণ দেবে। যেহেতু আহোরণ করে সে ভুল করেছে এবং জন্তকে ক্ষতি সাধনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু যদি ক্ষতি করা জন্তুর স্বভাব না হয়; বরং তা হঠাৎ কোন কিছু থেকে ভয় পাওয়ার কারণে উদ্ভূদ হয়, তবে সে ক্ষতিপূরণ বহন করবে না। “মুহাম্মদ তাকী উসমানী বুহুসুন ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাতিন মু‘আসিরা (বৈরুত : দারুল কলম, ১৪১৯হি.), খ.১.পৃ.২৯৯।”
মোদ্দাকথা হলো, কোন অবস্থাতেই গাড়ির ব্রেক ছুটে গেলে সেটাকে জন্তুর উপর কিয়াস করা যায় না। বস্তুত বিষয়টি উল্লিখিত বিধান ও মত পার্থক্যের আওতায় আনা সমীচীন নয়। বরং বলা যায়, এক্ষেত্রে ও চালক ক্ষতিপূরণ বহন করবে। কেননা ব্রেক ছুটে যাওয়া প্রমাণ করে, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ তার ত্রুটি রয়েছে। গাড়ির এ ক্ষেত্রে কোন এখতিয়ার নেই। কেননা গাড়ির নিজস্ব কোন শক্তি নেই। বিপরীতে জন্তুর নিজস্ব শক্তি রয়েছে, যার কারণে সে কখনো কখনো আরোহীকে পরাস্ত করে ফেলে।
অন্যদিকে, যদি আরোহীর পক্ষ থেকে ক্ষতি সংঘটিত হয়ে অন্য কোন কারণে ক্ষতি হয়, তাহলে আরোহী ক্ষতিপূরণ দেবে না। বরং যে ব্যক্তি ক্ষতি সংঘঠনের কারণ হয়েছে সে ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা ক্ষতির সরাসরি সংঘটন তার পক্ষ থেকেই হয়েছে।
বিষয়টি স্পষ্ট ও বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনে নিম্নে কতিপয় ফকীহদের বক্তব্য উল্লেখ করা হলো : ইমাম মুহাম্মদ [১৩১-১৮৯হি.] (রহ.) বলেন, যদি কেউ কোন জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়, আরেকজন সেই জন্তুকে খোঁচা বা আঘাত করার কারণে জন্তু খুর বা শিং দিয়ে আঘাত করে কাউকে মেরে ফেলে, তাহলে এর দায় বহন করবে খোঁচা দেয়া ব্যক্তি; আরোহী নয়। আর যদি খুর বা শিং দিয়ে আঘাত করে খোঁচা দেওয়াকে ব্যক্তিকে মেরে ফেলে তাহলে তা হবে বিনিময় শূন্য। আর যদি খোঁচার কারণে আরোহীকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে তাহরে খোঁচা দেয়া ব্যক্তি দিয়াত বহন করবে। যদি খোঁচার কারণে লাফ দিয়ে কারো উপর পড়ে তাকে মেরে ফেলে অথবা কাউকে পিষ্ট করে মেরে ফেলে, তাহলে এর বহন করতে হবে খোঁচা দেয়া ব্যক্তি; আরোহী নয়। “ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান আশ-শায়বানী, আল আসল (আল মাবসূত) বিশ্লেষণ : আবূল ওয়াফা আল-আফগানী (বৈরুত : আলামুল কুতুব সনবিহীন), খ.৪.পৃ.৫০১; ;দ্রষ্টব্য : হাসান বিন মানসূর আল ফারগানী, আল ফাতাওয়াহ আল হিন্দিয়্যাহ (বৈরুত : দারু ইয়াহইয়াউত তুরাছিল আরাবী, ৪র্থ প্রকাশ, সনবিহীন), খ.৬,পৃ, ৫১।” অন্য তিন মাযহাবের ইমামগণ ও অনুরূপ মত দিয়েছেন। “কারাফী, আয যাখীরা, খ.১২,পৃ.২৬৫; রামলী, নিহায়াতুল মুহতাজ, খ.৮.পৃ.৩৯; ইবনু কুদামা, আল মুগনী, খ.১২.পৃ.৫৪৪।”
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে জানা যায়, ক্ষতি সংঘটনের কারণে যে ঘটিয়েছে ফকীহদের ঐক্যমতে তার উপরই ক্ষতিপূরণের দায় বর্তাবে। এ বিষয়ে ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সূত্রে একটি আছার বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি কাদিসিয়া থেকে একটি বালিকাকে নিয়ে আসছিল। পথে সে আরোহী এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে অতিক্রম করল। লোকটি জন্তুকে খোঁচা দিল। ফলে জন্তু পা তুলে বালিকাটির চোকে আঘাত করল। এ মোকাদ্দমা সালমান বিন রাবী‘আ আল বাহিলীর আদালতে গেলে তিনি বললেন, আরোহী ক্ষতিপূরণ দেবে। ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে এ ফয়সালার সংবাদ গেলে তিনি বললেন এ দায়ভার খোঁচা দানকারী ব্যক্তিটির ওপর বর্তাবে। সেই ক্ষতির দায় বহন করবে “ইবনু আবী শায়বা, আল-মুসান্নাফ, খ.৫,পৃ,৪৬৫, (২৭৯৪৯); ইবনু আবদির রাযযাক, আল-মুসান্নাফ, খ.৯,পৃ,৪২২(১৭৮৭১১)।”
ফকীহগণ এটাও বলেছেন যে, জন্তু মারা যাওয়ার কারণে যদি আরোহী পড়ে যায় এবং অন্যের কোন ক্ষতি হয়, তাহলে আরোহী সে দায় বহন করবে না। একই ভাবে মৃত্যু বা অন্য কোন রোগবশত আরোহী যদি জন্তুর পিঠ থেকে পড়ে যেয়ে কোন কিছু নষ্ট করে, তাহলে আরোহী তার দায় বহন করবে না। যেহেতু অন্যের ক্ষতি বা সম্পদ নষ্টের বিষয়টি তার পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়েছে- একথা বলার সুযোগ আমাদের নেই।
শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম আবুল কাসিম আররাফিয়ী [৫৫৭-৬২৩হি.] (রহ.) বলেন, “কেউ যদি জন্তুতে আহোরণ করে এরপর জন্তু মরে পড়ে যায় ও কোন ক্ষতি ঘটায় “অনুরূপ বিধান প্রচ- বাতাস বা অসুস্থতা বা এজাতীয় এমন যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য প্রযোজ্য হবে, যার করণে আরোহী বা জন্তু নিজ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।” অথবা আরোহী মারা যায় এবং পড়ে গিয়ে কোন ক্ষতি ঘটায় তাহলে সে ক্ষতির দায় বহন করবে না। “রাফিয়ী, আল আযীয শরহুল ওয়াজীব, খ.১১,পৃ.৩৩৬।”
ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলেন, যদি দুই আরোহীর মাঝে সংঘর্ষ এভাবে হয় যে, কেউ আরেকজনের আগে আঘাত করতে পারেনি, অর্থাৎ প্রত্যেকেই অপরের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের শিকার হয়েছে, এরপর উভয়েই ঘোড়াসহ মারা গিয়েছে, তাহলে প্রত্যেকের আকিলা “আকিলা শব্দটি উহ্য মাওসূফ (বিশেষণযুক্ত) এর গুণ, এর পূর্ণাঙ্গ রূপ : (দিয়াত দানকারী দল) পরিভাষায় আকিলা বলা হয় যৌথ দায়ভার বহনকারী কোন সংঘ বা প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষকে, যা তার অধীনস্থ সদস্যগণের মাধ্যমে হওয়া অনিচ্ছাকৃত হত্যার রক্তপণ প্রদান করে।” অপরের আকিলাকে অর্ধেক দিয়্যাত দেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।