চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ চার ॥
বরং তার কর্তব্য হলো ক্ষমা করা অথবা নিজ গাড়ি আগের অবস্থায় চলে আসা পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় করা।
ফকীহদের সর্বসম্মতিক্রমে এ মূলনীতি এমন সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেখানে শরীয়াহ ক্ষতির বদলা হিসেবে ক্ষতি করার অনুমতি দেয়নি। সুতরাং কিসাস, হদ্দ ও তাযীর ও মূলনীতির আওতাভুক্ত নয়। এগুলোতে যদিও বাহ্যিক ক্ষতি হয়েছে; কিন্তু সমাজের নিরাপত্তা বিধানে স্বার্থে ও জনমালের অধিকার রর্ক্ষাথে এগুলোকে কার্যকর করাই শরীয়াহর কাম্য। তাছাড়া উপকার সাধনের তুলনায় ক্ষতিরোধ করার বিষয়টি অগ্রগণ্য। উপরন্ত, ক্ষতিরোধ করার স্বার্থেই শরীয়াহ দ-গুলো অনুমোদন করেছে। “শায়খ আহমদ যারকা, শরহুল কাওয়াঈদিল ফিকহিয়্যাহ (বৈরুপ : দারুল গারব আল ইসলামী ১৪০৩হি.) পৃ.১১৩।” ক্ষতি দূর করা আবশ্যক : “আবদুর রহমান আসসুয়ূতী, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর ফী ফুরুয়িশ শাফিঈয়্যাহ (কায়রো : মাকতাবাতু মুস্তফা আল বাবী আল হালাবী ১৩৭৮ হি.), পৃ.৮৩. ইবনু নুজাইম, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর (বৈরুপ : আল-মাকতাবাতুল আসবিয়্যাহ ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ.১০৫।
এটি অতীব তাৎপর্যবহুল একটি মূলনীতি। কেননা ফিকহের এমন প্রতিটি অধ্যায়েই এটি প্রযোজ্য, যেখানে নিশ্চিত বা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে এমন ক্ষতি দূর করার বিষয় রয়েছে। এ মূলনীতি অনুসারে সে ক্ষতি দূর করা এবং ক্ষতি হয়ে গেলে ক্ষতির প্রভাব দূর করে বস্তুকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা আবশ্যক। যেমন সর্বসাধারণের চলার পথে যদি কেউ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে, যার কারণে চলমান গাড়ি অথবা চলাচলকারী পথিকের কষ্ট হয়, তবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা দূর করার নিমিত্তে গাড়ি দাঁড় করে রাখার অনুমতি দেয়া হবে না।
এ থেকে ফকীহগণ বলেছেন, সর্বসাধারণের চলার পথের দিকে কেউ বৃষ্টির নালা উন্মুক্ত করে রাখে অথবা পথের অন্যায় ব্যবহার করে উঁচু কোন স্থান নির্মাণ করে, যার ফলে পথচারীদের চলতে কষ্ট হয়, তাহলে বৃষ্টির নালা বা উঁচু স্থান নির্মাণের অনুমতি দেয়া হবে না। আর যদি নির্মাণ করে ফেলে তাহলে অন্যদের ক্ষতি রোধ করার স্বার্থে নির্মিত উঁচু স্থান বা নালা ভেঙে ফেলা হবে। বরং এই নির্মাণের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে। “ইবনুল আবিদীন, আদ দুররুল মুখতার, খ. ৬.পৃ.৫৯২; মুহাম্মদ বিন উরফাহ আদ দাসূকী, হাশীআহ আলা আশ শারহুল কাবীর (বৈরুপ : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ১৪১৭ হি.) খ.৫, পৃ.৩৫; রামলী, নিহায়াতুল মুহতাজ, খ.৭.পৃ, ৩৫৭ ইবন কুদামাহ, আল মুগনী, খ.১২, পৃ.৯৮।”
ব্যক্তিগত অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ মূলনীতি প্রয়োগের নমুনা হলো, যদি কেউ গাড়ি দিয়ে কোন মানুষ বা বস্তুকে আঘাত করে যার ফলে কোন প্রাণ বা সম্পদের ক্ষতি হয়, তবে সে তার ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা এ ক্ষতির প্রভাব দূর করে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। বদলা দেয়া ছাড়া ক্ষতি দূর করা সম্ভব নয়। ইসলামী ফিকহে কারো ক্ষতিসাধন সে তিন কারণের একটি, যেগুলোর কারণে ক্ষতিপূরণ দেয়া আবশ্যক হয়। “হায়দার, দুরারুল হুক্কাম, খ. ১, পৃ. ৩৭; ফায়যুল্লাহ, নাযাবিয়্যাতুয যামান, পৃৃ.১৯।”
রাস্তায় চলাচল করা বৈধ শর্ত হলো যে ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব সেগুলো সংঘটনের আশঙ্কামুক্ত থাকা। একাধিক ফকীহগ এ শব্দে এ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ক্ষতির সরাসরি সংঘটক দায় বহন করবে, যদিও সে অন্যায় না করে” কাছাকাছি শব্দে ফকীহগণ এ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তবে মূল বিষয়ে সকল ফকীহ একমত। “ইবনু আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.৬০৩; শিহাবুদ্দীন আহমাদ আল ক্বারাফী, আয যাখীরা (বৈরুত : দারুল গারব আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খ্রি.) খ.পৃ.২৫৯; যারকা, শরহুল কাওয়াঈদিল ফিকহিয়্যাহ, পৃ.৩৮৫।”
এ মূলনীতি সমর্থনে মাজাল্লাতুল আহকামিল ‘আদলিয়্যা-র ৯২ নং ধারায় বলা হয়েছে; ক্ষতিকারক ক্ষতিপূরণ দেবে, যদি ও সে অন্যায় না করে। এখানে শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য অন্যায় ব্যবহার। এ ব্যাখ্যা করার কারণ হলো, সম্পদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছা অনিচ্ছা সমান। পার্থক্য এই যে, অনিচ্ছায় ক্ষতি করলে এর কারণে গোনাহ হবে না। কিন্তু ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে উভয় অবস্থা সমান। বর্ণিত আছে এক ব্যক্তি তিনজনকে বাগান খনন করার জন্যে মজদুর নিয়োগ করল। তখন তারা একসাথে দেয়ালের মূলভিত্তিতে আঘাত করল। এরপর দেয়াল ধসে তাদের একজন মারা গেল। তারা কাযী শুরাইহ “নাম আবু উমাইয়্যা, শুরাইহ বিন হারিস বিন কায়স আল কিন্দী। পূর্বপুরুষ ইয়ামেনী বংশোদ্ভূত। ইসলামের প্রসিদ্ধ কাযীদের অন্যতম। ওমর ওসমান আলী ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে পঁচাত্তর বছর মেয়াদে কুফার বিচারক ছিলেন। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। বিচারক হিসেবে দোষমুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ জীবন লাভ করেন এবং আটাশি হিজরিতে কুফায় মৃত্যুবরণ করেন। (আবূ নু’আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া, খ.৪. পৃ.১৩২; ইবনুল ইমাদ, শাযারাতুয যাহাব (বৈরুত : দারু ইয়াহইয়াউত তুরাছিল আরাবী, সনবিহীন), খ.১,পৃ,৮৫।”-এর দরবারে মোকাদ্দমা নিয়ে গেল। তিনি অবশিষ্ট দুজনের দায়ে এক-তৃতীয়াংশ করে দিয়াত ধার্য করলেন। “ইবনু আবী শায়বা, আল মুসান্নাফ ফীল আহাদিস ওয়াল আছার (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬ খ্রি;),খ.৫, পৃ.৪৪৭ হাঃনং : ২৭৮৬৬।”
সুতরাং জন্তু বা বাহনের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি সাধনকারী নিঃশর্তভাবে ক্ষতিপূরণ বহন করবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করুক বা অনিচ্ছায়, অন্যায়ভাবে চালাক বা যথাযথভাবে চালনা করুক- বিধান অভিন্ন। সুতরাং কেউ যদি কোন জন্তু বা বাহনের পিঠে বিভিন্ন জিনিস বোঝাই করে সর্বসাধারণের বাজার অতিক্রম করে, সে সময় পিঠ থেকে কোন কিছু পড়ে কারো প্রাণহানি ঘটে বা কারো কোন সম্পদ নষ্ট হয়, তাহলে সে ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা সে ক্ষতির সংঘটক আর ক্ষতির দায়ভার বহন করে। যদি রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় বাহনের চাকা খুলে যায়, এরপর কাউকে বা কোন বস্তুতে আঘাত করে তাহলে সে ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা চাকা খুলে যাওয়া প্রমাণ করে, চালক মজবুতভাবে চাকা লাগায়নি। তাছাড়া সে ক্ষতির সংঘটক। আর সংঘটক নিঃশর্তভাবে ক্ষতিপূরণ বহন করে “ইবন আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.পৃ.৬০৩;ফায়যুল্লাহ, নাযারিয়্যাতুয যামান, পৃ.১৮৪।
সরাসরি ক্ষতি সংঘটন ও সংঘটনের কারণ : ফকীহগণ সরাসরি সংঘটনের অর্থ এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, যে কাজ ও ক্ষতির মধ্যে অন্য কারো ইচ্ছাকৃত কোন কাজ সংঘটিত হয় না। “আল-হামুভী, গামযু উয়ূনিল বাছাইর [ইবনু নুজাইম কৃত আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর এর ভাষ্যগ্রন্থ], (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯৮৫ খ্রি.) খ.১,পৃ,৪৬৬; ক্বালয়ূবী ও আমীরা, আলা শরহুল মিনহাজ, খ.২,পৃ.২৮ ও খ.৪.পৃ.৯৮; শায়খ মুস্তাফা আহমদ যারকা, আল মাদখালুল ফিকহিয়্যুল আম, (দামিশক; দারুল ফিকর, ১৯৬৯ খ্রি.) খ.২,পৃ,১০৪৪।” যদি ব্যক্তির কাজ ও ক্ষতি সংঘটনের মাঝে অন্য কারো কাজ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে বলা যাবে না। সুতরাং প্রথম ব্যক্তি তখন ক্ষতির দায় বহন করবে না। এর উদাহরণ হলো, একজন গাড়ি চালিয়ে কারো গায়ে ঘষা দিলে লোক একপাশে পড়ে গেল। আরেকটি গাড়ি এসে তাকে পিষ্ট করলে লোকটি মারা গেল, এমতাবস্থায় প্রথম ব্যক্তির উপর হত্যার দায় বর্তাবে না বরং দ্বিতীয় জনের উপর হত্যার দায়ভার বর্তাবে। অথচ প্রথমজন এখানে হত্যার কার্যকারণ ঘটিয়েছে। কিন্তু ফকীহগণ বলেন, যখন কোন দুর্ঘটনায় দুজন একত্রিত হয়, যার একজন সরাসরি দুর্ঘটনা সংঘটন করে আর অপরজন ক্ষতি সংঘটনের কারণ হয়, তখন দুর্ঘটনার বিধান (অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ) আরোপিত হবে যে ক্ষতি সংঘটিত করেছে তার উপর। ক্ষতি সংঘটন ও ক্ষতির কারণের মাঝে পার্থক্য করা হলে ক্ষতি সংঘটনের ক্ষেত্রে কারণের ভূমিকা থাকে না, যেমনটা আমরা উদাহরণে আলোচনা করছি।
ক্ষতি সংঘটনের ক্ষেত্রে মুকাল্লাফ (প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন) হওয়া শর্ত নয়। সুতরাং যদি চালক অপ্রাপ্তবয়স্ক হয় আর যদি কোন প্রাণহানি ঘটায় বা সম্পদের ক্ষতি করে, তাহলে সে যা ক্ষতি করেছে তার দায় বহন করবে। কেননা ক্ষতির দায় বহন করার ক্ষেত্রে দায় বহন করার যোগ্যতা শর্ত নয়। বরং ক্ষরিত দায় বহন করার জন্যে তার বদলা আবশ্যক হওয়ার উপযোগিতা থাকাই যথেষ্ট।“যারকা, আল মাদখালুল ফিকহীয়্যুল ‘আম, খ.২,পৃ. ৭৪৪।” যুহরী ও কাতাদা (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও পাগলের ইচ্ছাকৃত হত্যার প্রতিবিধান হল দিয়্যাত (রক্তমূল্য)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।