Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

শুধু মার্কাই যথেষ্ট নয়, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীও দরকার

| প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বাহ্যিকভাবে হোক আর আপাতদৃষ্টিতে হোক, সুষ্ঠু যে হয়েছেÑ তাতে সন্দেহ নেই। ‘বাহ্যিক’ ও ‘আপাতদৃষ্টি’ বললাম এ কারণে যে, বিএনপি নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে। দলটির মনে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। তবে এ সন্দেহ সৃষ্টিকারী ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ কোথায় এবং কীভাবে হয়েছে, তা দলটি ধরতে পারছে না। এ নিয়ে সে খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। আত্মবিশ্লেষণও করছে। কেন ও কী কী কারণে এমন ফলাফল হলো তা নিয়ে বিস্ময়ের ঘোরে রয়েছে। তার কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হচ্ছে। কারণ দলটি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, সে বিপুল ভোটে জিতবে। এই আত্মবিশ্বাসের মূলে ছিল একটি বদ্ধমূল ধারণা। ধারণাটি এই, দলটি সবসময় মনে করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া জোর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। ফেয়ার ইলেকশন হলে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। এ প্রেক্ষিতে বিএনপি যদি ধানের শীষ মার্কা দিয়ে একটি ‘কলাগাছ’ও দাঁড় করিয়ে দেয় তবে আপনা-আপনি পাস করে আসবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে একজন স্বল্প পরিচিত প্রার্থীকে একজন পোড় খাওয়া বহুল পরিচিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। দলটির প্রার্থীর ভাবমর্যাদা ও ভাল মানুষের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে যুদ্ধটি যখন দুই পরাশক্তির মধ্যে হয় তখন আটঘাট বেঁধে নামাই যুক্তিযুক্ত। যুদ্ধ ও ভালবাসার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’। যুদ্ধ যদি নির্বাচন নিয়ে হয়, তখন তা কখনো কখনো ‘ওয়াইল্ড ওয়ার’-এ পরিণত হয়। এখানে ‘নবিশ’ সৈন্য-সামন্ত নামানো মানে পরাজয়ের শঙ্কাকেই আমন্ত্রণ জানানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী সম্পর্কে কোনো ধরনের বিতর্ক, আপত্তি এমনকি ন্যূনতম বদনাম কেউ তুলতে পারেনি। প্রত্যেকেই একবাক্যে তাদের ‘সাদা মানুষ’ হিসেবেই চেনেন। দুজন ভাল মানুষ যখন প্রার্থী হয় তখন সাধারণ ভোটারদের মহাবিপদ হয়ে দাঁড়ায়। ‘কাকে রেখে কাকে ভোট দেব’ এমন দোটানার সৃষ্টি হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের কথা আলাদা। তারা দলের প্রার্থী সাদা হোক আর কালো হোক তাকেই ভোট দেবে- এটা সাধারণ কথা। তবে সাধারণ ভোটাররা সাদা-কালো বাছবিচার করেই ভোট দেয়। দু’জন ‘সাদা মানুষে’র মধ্যে একজন যদি দল-মত নির্বিশেষে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা দিয়ে উৎরাতে থাকেন তখন তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া খুবই কঠিন। তখন তাকে শুধু দলের প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন নয়, সুকঠিনও বটে। এমন এক প্রার্থীর বিপরীতে অনভিজ্ঞ ও অপরিক্ষীতকে যত ভাল মানুষই হোক না কেন, দাঁড় করিয়ে দিলে ফলাফল আগেভাগেই আঁচ করা যায়। এক্ষেত্রে দল যা করতে পারে তা হচ্ছে প্রার্থীকে সহায়তা করে এগিয়ে দেয়া। তবে প্রার্থীর নিজেরও হাঁটার সক্ষমতা থাকতে হবে। ঠেলেঠুলে তো মনজিলে মকসুদে পৌঁছানো সম্ভব নয়। নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রার্থীর পরাজয়ের মূল কারণ যদি খোঁজা হয় তবে এটিই অন্যতম কারণ।
দুই.
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়া দেখে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের কথা মনে পড়ে যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সারা বিশ্ব একবাক্যে বিশ্বাস করেছিল, হিলারি ক্লিনটনই আগামী দিনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। এটা অবধারিত। হিলারির প্রয়োজন শুধু নির্বাচনের দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পার করা। আমেরিকা তো বটেই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের এমনই ধারণা ছিল। তারা অনেকটা ফুলের ডালা নিয়ে হিলারিকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছিল। নির্বাচনের ফলাফলের দিন-দুপুরেই যেন সব আশা-ভরসা, বিশ্বাস কর্পুরের মতো উড়ে যেতে লাগল। আত্মবিশ্বাসের একেকটি পাহাড় ধসে পড়তে শুরু করল। বহুল বিতর্কিত প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের ঘোড়া এমনভাবে ছুটে চলল যে, কেউ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সবার মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। ‘এ কী হলো!’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এ অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! কিছুতেই মানা যায় না। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের জনগণ তো ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নয়, বলে রাস্তায় বের হয়ে পড়ল। মানি না, মানব না বলে কত চিৎকার-চেঁচামেচি! আমেরিকার প্রশাসনও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা কৌশলে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে শুরু করে। ফলাফল উল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার হামলার অভিযোগ উত্থাপন করে। অবিশ্বাস দূর করতে ভোট পর্যন্ত পুনঃগণনা করা হয়। তাতেও কিছু হলো না। ফলাফলটি সবার কাছে অবিশ্বাস্যই থেকে গেল। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির কাছেও এমন অবিশ্বাস্যই ঠেকেছে। দলটি ফলাফলে কারচুপি হয়েছে কিনা, তার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করে বসে। অথচ এখানে অবিশ্বাস্য বলে কিছু ছিল না। স্বাভাবিকভাবে যা হওয়ার কথা, তাই হয়েছে। টেলিভিশনে নির্বাচনী প্রচারণার খবরাদি দেখে অন্তত মনে হয়েছিল, নারায়ণগঞ্জের মানুষ যেভাবে আইভীকে গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল, এমনকি বাসাবাড়ির মহিলারা বারান্দা ও জানালা দিয়ে ‘পাঁপড়ি বৃষ্টি’ ঝরাচ্ছিল তখনই তার বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সাখাওয়াত হোসেনকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি নিজেকে পরিচিত করার জন্য জানপরাণ দিয়ে এলাকা থেকে এলাকা ছুটে বেড়াচ্ছেন। পার্থক্যটা এখানেই। একজন চিরপরিচিত প্রার্থী বিজয়ের পথ ধরে ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাচ্ছেন আরেকজন বিজয়ের পথে উঠার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। মনে হয়েছে, রেসে অভিজ্ঞ ঘোড়ার পাশে অনভিজ্ঞ নতুন ঘোড়া জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে বিএনপির জন্য আশার কথা হচ্ছে, সে তার স্বাভাবিক যে ভোট, তা পেয়েছে। জেতার জন্য ভাসমান যে ভোট দরকার ছিল, তা কুড়িয়ে নিতে পারেনি। এর কারণ ভোট সুইপ করার জন্য যে ধরনের দক্ষ সুইপার দরকার তা দলটি দিতে পারেনি। দলটির প্রার্থী দেয়া থেকে মনে হয়েছে, সে নির্বাচনটিকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছে। কারণ দলটি ভাল করেই জানে আইভী নারায়ণগঞ্জে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকি গতবারের নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে তার প্রার্থী প্রত্যাহার করে প্রকারন্তরে আইভীকেই সমর্থন দিয়েছিল। এবারও তার প্রার্থী মনোনয়ন দেখে মনে হয়েছে, আইভীর ইমেজের সমতুল্য আরেকজন ক্লিন ইমেজধারী ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য দাঁড় করিয়েছে। যদি পাস করে যায়। তা নাহলে দলটি ভিন্ন প্রার্থীর কথাও চিন্তা করতে পারত, নারায়ণগঞ্জে যার ব্যাপক পরিচিতি এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিপক্ষের দক্ষতা ও যোগ্যতা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া না হয়, তবে ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়। এখানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সুযোগ নেই, প্রকৃতই যুদ্ধ করতে হয়। তা না হলে কাউন্সিলর পদে বিএনপি ১২টি আর আওয়ামী লীগ ১১টি পাবে কেন? নিশ্চয়ই যারা বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন তারা এলাকায় অত্যন্ত পরিচিত ও রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ। তাদের এই অভিজ্ঞতার ফলাফলই তারা পেয়েছেন। হ্যাঁ, এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, যেখানে বিএনপির কাউন্সিলর পাস করেছে, সেখানে মেয়র ফেল করল কেন? এর কারণ কয়েক প্রকার হতে পারে। প্রথম কারণটি হচ্ছে সেখানের ভোটাররা তাদের এলাকার প্রার্থীকে চিনেছে, মেয়রকে চিনে নাই। মেয়র হিসেবে আইভীকেই চিনেছে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, অভিযোগ। কাউন্সিলরের ফলাফল ঠিক রেখে মেয়রের ফলাফল উল্টে দেয়া। এ অভিযোগ খুব একটা যৌক্তিক নয়। কারণ ফলাফল যদি উল্টেই দেয়া হবে, তবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর বাদ যাবে কেন? যাই হোক, ফলাফলে এখন অনেক ফাঁকফোকর খোঁজা যেতে পারে। অতি সূক্ষ্ম এবং অদৃশ্য কারচুপির প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। মিডিয়া ক্যুর কথাও বলা যেতে পারে। তবে জনগণ যা দেখার এবং যা জানার তা দেখেছে এবং জেনেছে। বিএনপিও যে এ ফলাফল মেনে নিয়েছে তা দুয়েকটি রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া ছাড়া বোঝা গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইভী এত ভোট পেল কীভাবে? প্রতিপক্ষকে প্রায় পৌনে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারালো কীভাবে, যেখানে দলীয় প্রতীক মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আইভী নৌকা মার্কার জোরে এত ভোট পেয়েছে। বিষয়টি এত সরল নয়। কারণ গতবার আইভী নৌকা ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট হেভিওয়েট প্রার্থী শামীম ওসমানকে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন। তার অর্থ হচ্ছে, আইভী নিজ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায়ই জিতেছেন। তিনি মার্কাকে অতিক্রম করে গেছেন। মার্কা ছাড়াও যদি তিনি নির্বাচন করতেন তবে ফলাফলের খুব একটা হেরফের হতো না। বিষয়টি ক্ষমতাসীন দল ভালভাবেই বুঝেছে। বুঝেছে বলেই তৃণমূলের প্রস্তাবিত প্রার্থীদের বাদ দিয়ে আইভীকে মনোনয়ন দিয়ে তার মার্কার ক্রেডিট নিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি তার মার্কার ভোট পেয়েছে, প্রার্থীর নয়। এটিই দলটির পরাজয়ের অন্যতম কারণ। প্রার্থী যদি দলের ভোটের বাইরে আইভীর মতো নিজ যোগ্যতায় ভোট টানতে পারতেন, তবে জিতেও যেতে পারতো। কারণ এক ধানের শীষ মার্কাই ভোট এনে দিয়েছে এক লাখের কাছাকাছি। অন্যদিকে গতবার এবং এবারের ফলাফলের ব্যবধানের হিসাব অনুযায়ী আইভী একাই নিজ যোগ্যতায় ভোট এনে দিয়েছেন প্রায় এক লাখ। আইভীর এই এক লাখ যদি বাদ দেয়া যায়, তবে ফলাফল অনুযায়ী ধানের শীষ মার্কাই নৌকার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
তিন.
দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশনকেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। কেবলমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলোই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে যেতে পেরেছে। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন কমিশন যে কতটা নির্লজ্জ ও মেরুদ-হীন হতে পারে তা বর্তমান নির্বাচন কমিশন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ইতিহাস বদলে দেয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো মর্মদায়ক ও পীড়াদায়ক নির্বাচন অতীতের যে কোনো নির্বাচনকে হার মানিয়ে দিয়েছে। রউফ কমিশনের অধীনে মাত্র একটি আসনে উপনির্বাচন (মাগুরা) নিয়ে এতদিন ঘৃণ্য নির্বাচনের যে দৃষ্টান্ত দেয়া হতো তাকে নস্যি করে দিয়েছে বর্তমান রকিব কমিশনের অধীনে প্রায় সবগুলো নির্বাচন। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ আসন তো বটেই যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার সবগুলোই অতীত ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে। ইতিহাসের খারাপ নির্বাচনের উদাহরণ দিতে গিয়ে এখন এক মাগুরার পরিবর্তে হাজারটা মাগুরার দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে। রকিব কমিশন আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির যে মানসম্মান তা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। নির্লজ্জতাকে গা সহা করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে যদি এমন আরও অনেক নির্বাচন হয় তবে আমাদের আত্মমর্যাদাবোধে তা খুব কমই বিদ্ধ হবে। এই যে নির্বাচনের সম্মানহানি ঘটানো হলো, এর প্রতিকার কি কোনো দিন আর হবে? হবে না। বলা বাহুল্য, অতীতে ছিটেফোঁটা যা কিছু হয়েছে তার প্রতিকার কখনোই হয়নি। হয়নি বলেই রকিব কমিশন নির্বাচনের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পেরেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে যারা আছেন তারা রক্ত মাংসেরই মানুষ। তাদের আত্মসম্মানবোধ অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি থাকার কথা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনে কমিশনার হিসেবে যারা রয়েছেন তাদের আত্মসম্মান কতটা রয়েছে তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত লজ্জাজনক নির্বাচন থেকেই তা বোঝা যায়। মাগুরার নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আত্মগ্লানিতে ভুগেছিলেন। নির্বাচনটি তিনি বাতিলও করতে চেয়েছিলেন। পারেননি তৎকালীন সরকারের কারণে। তবে তিনি যে অনুশোচনা ও আত্মগ্লানিতে ভুগেছিলেন তা দেশের মানুষ জেনেছে। কেন তিনি নির্বাচন বাতিল করতে পারেননি তাও জেনেছে। ফলে দেশের মানুষ সরকারকে দুষলেও তার প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করেনি। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনই যে, তাকে মেরুদ-হীন বললে, খুব কমই বলা হয়। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শত শত মানুষ আহত-নিহত এবং বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হলেও এই নির্বাচন কমিশন হাসিমুখে বলেছে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পুরো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। জানমালের যে বিপুল ক্ষতি হলো তার জন্য অনুশোচনা দূরে থাক সামান্য দুঃখও প্রকাশ করেনি। নিহতদের পরিবারের প্রতি কোনোরূপ সমবেদনা জ্ঞাপন করেনি। এভাবেই দীর্ঘ পাঁচটি বছর এই কমিশন কাটিয়ে দিল। মেয়াদের প্রান্তিক পর্যায়ে এসে সে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি করেছে। নির্বাচন কেমন হয়েছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু আফসোস হচ্ছে এই ভেবে, হায়! নির্বাচন কমিশন এতদিন তুমি কোথায় ছিলে! তোমার এই সুবোধ রূপ কেন আগে দেখতে পেলাম না! তাহলে তো এত প্রাণ এত রক্ত ঝরত না, এত সম্পদ পুড়ে খাক হতো না। দেশের স্বাভাবিক গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হতো না! তবে এ নির্বাচন কি নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু করেছে, নাকি সরকার? এ প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে। যারা নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তারা একবাক্যে বলছে, এতে নির্বাচন কমিশনের কৃতিত্ব নেই, সরকারের ইচ্ছায়ই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অর্থাৎ এখানেও নির্বাচন কমিশন তার মেরুদ- দেখাতে পারেনি। সরকারের কলের পুতুল হয়েই কাজ করেছে। শুধু বিদায়বেলায় সরকার চেয়েছে, তার অত্যন্ত আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে একটি ফেয়ার নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘ফেয়ার ওয়েল’ দিতে। এর মধ্য দিয়ে কমিশনের পাঁচ বছরের সকল বদনাম ঘুচিয়ে দিতে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সকল নির্বাচনে কমিশন যে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে পাঁচ বছর অতিক্রম করলো, তা সব ধুয়েমুছে দিতে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনটি সুষ্ঠু করে দিয়েছে। এতে সরকার দুটো বিষয় দেখাতে চেষ্টা করেছে। এক. নির্বাচন কমিশন নয়, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। দুই. বিদায়ী নির্বাচন কমিশন যা করেছে সব ভাল করেছে। কারণ এ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকার কখনোই কথা বলেনি। বরং তার পক্ষাবলম্বন করেছে।
চার.
সরকার চাইলে নির্বাচন, সেটা স্থানীয় হোক বা জাতীয় হোকÑ তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন, তার একটি ভাল উদাহরণ। তবে সরকার এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেখাতে চাইছে ভবিষ্যতেও তার অধীনে ভাল নির্বাচন হবে। এটা এখন সরকার বেশ জোর গলায়ই বলছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইট ইজ নট এনাফ। এটাই যথেষ্ট নয়। ভাল নির্বাচন করতে হলে সরকারের প্রভাবমুক্ত শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলও এখন এ দাবীই করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার তা করবে কিনা? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও মাস খানেক অপেক্ষা করতে হতে পারে। এর মধ্যেই আশা করা যায়, প্রেসিডেন্ট বিষয়টি পরিস্কার করবেন। আমরা আশা করতে পারি, নতুন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হবে। এতে সরকার কোনো ধরনের বাগড়া দেবে না। ভালয় ভালয় এ কমিশন গঠন হয়ে গেলে এবং গঠিত নির্বাচন কমিশনের সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রবণতা না থাকলে, নিশ্চিতভাবেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলগুলোর মধ্যে আগাম ঢামাঢোল বেজে উঠবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য একটি সতর্ক বার্তা হয়ে রইল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বলা যায়, এ নির্বাচন দলটির জন্য ‘ওয়েক আপ কল’। সতর্ক সংকেত। শুধু বিএনপির জন্যই নয়, সব দলের জন্যই তা প্রযোজ্য। নারায়ণগঞ্জ প্রমাণ করে দিয়েছে, সরকারের প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হলে বিজয় ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এর ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী বাছাই ও নমিনেশনের উপর ফলাফল অনুকূলে আসার বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করবে। শুধু মার্কাই যথেষ্ট হবে না।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিটি করপোরেশন


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ