বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী : ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতটি হচ্ছে খৃস্টীয় বর্ষপঞ্জির শেষরাত। যাকে আমরা ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ নামে অবিহিত করে থাকি। এ রাতের ১২টা এক মিনিটে নববধূর মতো ঘোমটা খুলে নতুন আরেকটি সনের। ইংরেজিতে যাকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ স্বাগত জানানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমরা এটাকে ইংরেজি নববর্ষ বলে চালিয়ে দিচ্ছি। তা কিন্তু আসলে ইংরেজি নববর্ষ নয়, বরং এটা হচ্ছে খৃস্টীয় বা গ্রেগরিয়ান নববর্ষ। যার সাথে মিশে আছে খৃস্টীয় কর্মযজ্ঞ। তাইতো এর নামকরণও করা হয়েছে খৃস্টানদের ধর্মযাজক পোপ গ্রেগরিয়ানের নামানুসারে।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, খৃস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ১ জানুয়ারিতে নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করে। পরে তা ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশও। প্রবল উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে এ দেশেরই একটি জনগোষ্ঠী এই থার্টিফার্স্ট নাইট ও হ্যাপি নিউ ইয়ার উদযাপন করে থাকে। শুধুই কী উদযাপন?
এ দেশের প্রতিটি শহর-নগরের জায়গায় জায়গায়, বিভিন্ন স্পট এবং প্রায় সবক’টি অভিজাত হোটেল রেস্তোরাঁয় থার্টিফার্স্ট নাইট ও হ্যাপি নিউ ইয়ার উদযাপনের নাম করে কায়েম করা হয় অশ্লীলতার স্বর্গরাজ্য। কুরুচিপূর্ণ নাচগান, মদ, জুয়া, ব্যভিচারসহ হেন কোনো কাজ নেই যা এই উৎসবকে কেন্দ্র করে হয় না। আর এ সবকিছুই চালানো হচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না সংস্কৃতি আসলে কী। ফলে আমরা না জেনেই সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির ফেরি করে বেড়াচ্ছি। তাই আমাদেরকে আগে সংস্কৃতি কী তা ভালোভাবে বুঝতে হবে। সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশের নাম। সংস্কৃতি হলো মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে টিকে থাকার কৌশল, যা নির্ভর করে ভৌগোলিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর। সংস্কৃতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা। কেননা সংস্কৃতির অর্থই হচ্ছে, সংস্কার বা বিশুদ্ধিকরণ। সমাজের সব অসত্য, অন্যায়-অনাচার এবং কুসংস্কার দূর করে সত্য ও সুন্দরের চর্চা করাই সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য। তাই সমাজ জীবনে সংস্কৃতির গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু সংস্কৃতির নামে এই ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ বা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ উদযাপন এমনই একটি অপসংস্কৃতির নাম, যা কোনো রুচিশীল মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, সংস্কৃতির মূল উৎসই হলো ধর্ম। তাই ধর্মকে পাশ কাটিয়ে সংস্কৃতিকে বরণ করা মানে অন্ধকারে নিজেকে ঠেলে দেওয়া। যা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ, এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ইসলামের অনুসারী এদেশের ৯৫% মানুষ। এই ৯৫% মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইসলামী সংস্কৃতির বদলে বংশবিস্তার হয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির। আর এর মূলে রয়েছে পশ্চিমাদের কিছু দালালগোষ্ঠী। যারা নিজেদের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে এসব অপসংস্কৃতির বিষবৃক্ষগুলোকে রোপণ করে যাচ্ছে।
আবার এমন কিছু সেক্যুলার লেখক-প্রকাশকও আছে যারা পবিত্র কলমকে নষ্টামি চর্চায় ব্যবহার করে এদেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে। এই অভিশপ্ত পথের পথিক কিন্তু বড়রাও কম নয়। যারা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বে¡ও কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেদারছে তা গ্রাস করছে আবার নিজেদেরকে মুসলিম বলেও পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে চেষ্টা করছে না যে, এই অপসংস্কৃতি ইসলাম সমর্থন করছে কি-না। অথচ এসব কাজের দ্বারাই কিন্তু তারা ধর্ম থেকে অনেক দূরে ছিঁটকে পড়ছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (মিশকাত শরীফ : ৪৩৪৭)
এবার আসুন! বিবেকের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখি ইসলাম কেন এই থার্টিফার্স্ট নাইট ও হ্যাপি নিউ ইয়ার উদযাপন করাকে অপছন্দ করে।
এই থার্টিফার্স্ট নাইট ও হ্যাপি নিউ ইয়ার উদযাপন প্রথাটি আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পক্ষ থেকে নবী মুহাম্মমাদ (সা.)-এর ওপর অর্পিত শরীয়ত পরিপন্থী। এছাড়াও আরো যে সকল কারণে ইসলাম এই উৎসব উদযাপন করাকে নিষিদ্ধ করেছে সেগুলো হচ্ছেÑ
১. অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা : থার্টিফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে রাতভর চলে অশালীন ও বেহায়পনার মহোৎসব। যুবতীরা আটঁসার্ট, অশালীন ও অর্ধনগ্ন পোশাক পরিধান করে অবাধে চলাফেরা করে। অথচ এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন, ‘ঐসব নারী যারা হবে পোশাক পরিহিতা কিন্তু নগ্ন। যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’ (সহীহ মুসলিম : ২১২৮)
২. গান বাজনা : এ রাতে আয়োজিত হয় বিভিন্ন কনসার্ট। যেখানে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ও রাসূল (সা.) এসব নিন্দনীয় কাজকে সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। আর যারা এসব কাজে লিপ্ত তাদের জন্য করেছেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সূরা লুকমান : ৬)
৩. আতশবাজি ও পটকাবাজি : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজি। যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া এসব কর্মকা-ে জনসাধারণকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়। অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহযাব : ৫৮)
৪. অর্থ অপচয় : এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামিক ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়। যা একদিকে যেমন মারাত্মক গুনাহের কাজ অপরদিকে অপচয়। আর ইসলাম অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৭) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘আর তোমরা অপচয় করো না, কেননা তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনআম : ১৪১)
৫. যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশা : এ রাত্রিতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, সমুদ্র সৈকত, নাইট ক্লাবগুলোতে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। যা ইসলামের পরিভাষায় ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে আমরা খারাপ কিছু করব না শুধুমাত্র উৎসব উদযাপন করব তাহলে বুঝতে হবে এরাই ধোঁকাবাজ। এরা হয়তো আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে, নয়তো তারা নিজেরাই ধোঁকায় পড়ে আছে। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।’ (মিশকাত শরীফ : ১৩১৮) আর শয়তানের উপস্থিতি মানেই বিপদের দিকে ধাবিত হওয়া। এসব কারণ ছাড়াও আরো অসংখ্য কারণ বা অপকারিতা রয়েছে এই থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনে। সুতরাং একথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মুসলিম যুবসমাজকে ধ্বংস করার লক্ষ্যেই ইহুদি-খ্রিস্টানদের নীলনকশার একটি অংশ হচ্ছে এই থার্টিফার্স্ট নাইট।
সুতরাং কোনো মুসলমানের জন্য শুভনীয় নয় এসব অসভ্য ও বর্বরোচিত কালচার গ্রহণ করা। আমাদের খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, উৎসব হচ্ছে একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধ। সে জন্যই নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসব নির্ধারণ করে গেছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ (খুশি) রয়েছে, আর এটা (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) আমাদের ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)
তাই মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলোÑ এই থার্টিফার্স্ট নাইট বা হ্যাপি নিউ ইয়ারের নামে সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হৈ-হুলোড় এবং নগ্নতার প্রদর্শনকে এড়িয়ে চলা। পাশাপাশি বছরের সূচনালগ্ন যখন আমাদের মাঝে উপস্থিত হবে, তখন আমাদের করণীয় হবে যে, বছরটা আমাদের জীবন থেকে গত হয়ে গেল, তা কোন কাজে ব্যয় করলাম তার হিসেব করা, ভুলত্রুটির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়া। এবং আগত দিনগুলো যেন আমাদের জন্য কল্যাণকর হয় সেজন্য রাব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা। আর এটাই হলো নববর্ষ উদযাপনের জন্য সত্যিকারের বুদ্ধিমানের কাজ।
তাই আসুন! অন্যদের সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ না করিয়ে বরং নিজেদের সংস্কৃতিকে লালন করে বুকে ধারণ করি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আর ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। কল্যাণকর এমন কোনো দিক নেই যা ইসলাম তার অনুসারীকে দেয়নি। তা জীবনধারণের জন্য জীবিকাই হোক, আর চিত্তের প্রফুল্লতার জন্য বিনোদনই হোক। এক কথায় মানবতার কল্যাণে নিহিত সবকিছুই রয়েছে কল্যাণের ধর্ম ইসলামে। সুতরাং অন্যের সংস্কৃতি ফেরি করা কিংবা চর্চার কোনো প্রয়োজন নেই। অতএব, নতুন বছরে আমাদের সবার সংকল্প হোক- আগামী দিনগুলোতে একমাত্র ইসলামী সংস্কৃতিই হবে আমাদের নিত্যকার সঙ্গী।
লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
[email protected].
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।