Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গভবনে সংলাপে সুবাতাস

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সংঘাতময় রাজনীতির মধ্যেও ৪৫ বছরে দেশের অনেক অর্জন। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে, মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার, তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ওষুধ-বিদ্যুৎ শিল্পে সাফল্য, বঙ্গবন্ধু সেতুর পর তৈরি হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশে আরো বড় বড় অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২৪ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত তালিকা থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির হাতছানি। এই অর্জন ধরে রাখতে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র, শিল্প, ব্যবসা, আইনের শাসন সর্বত্রই যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা আবশ্যক; সে লক্ষ্যে সংলাপ চলছে বঙ্গভবনে। সংলাপে সব রাজনৈতিক দলের যুদ্ধংদেহী কঠোর অবস্থানের জমাটবাঁধা বরফ গলে আস্থার সুবাতাস বইতে শুরু করায় ‘টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর রশ্মি’ দেখা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে সংলাপে ইসি গঠনে প্রস্তাবনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ইতিবাচক। নতুন নির্বাচন কমিশন হবে; সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে, নারায়ণগঞ্জের মতো দেশের সবাই ভোট দেবে এবং বর্তমানের ‘পতুল’ সংসদের বদলে আমরা একটা শক্তিশালী সংসদ পাব। সে ইংগিত দিয়েছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, সবার প্রস্তাবে রয়েছে অনেকগুলো ঐকমত্য।


স্টালিন সরকার : বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’। জহির রায়হানের এই উপন্যাসে ডায়লগ ‘কেন কাঁদছো লিলি? জীবনটা কী কারো অপেক্ষায় বসে থাকে? পৃথিবীর চলা বন্ধ হবে না কোনদিন। যে শক্তি পৃথিবীকে চালিয়ে নিয়ে যায় তার কী কোনো শেষ আছে লিলি?’ উপন্যাসে নিম্নবিত্তের সংগ্রাম আছে; দুঃখ-দৈন্য আছে; টানাপোড়েন, ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই; আত্মমর্যাদার সীমাবদ্ধতাও আছে। আরো আছে নিম্নবিত্তের পরিবারের আশা-স্বপ্ন; কিশোরী প্রেমের সলজ্জ সাধ; আছে আদর্শের লড়াই। ‘বরফ গলা নদী’ আশা-নিরাশার উপাখ্যান। উপন্যাসে লিলির উদ্দেশে দেয়া ওই ডায়লগের মতোই বলতে হয় ‘কেন কাঁদছো বাংলাদেশ’? অপার সম্ভাবনার দেশ তুমি এগিয়ে যাবেই। তোমার উর্ধ্বে ওঠা কেউ ঠেকাতে পারবে না। গত ৪৫ বছরে অনেক অর্জন। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে, মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার, তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ওষুধ শিল্পে সাফল্য, বঙ্গবন্ধু সেতু আছে; তৈরি হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ২০২৪ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির হাতছানি। যে ১১টি দেশকে পরবর্তী শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই অর্জন ধরে রাখতে হলে সর্বত্রই যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার; সে সড়কে উঠার প্রস্তুতির সংলাপ চলছে বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের বাইরেও সংলাপের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কণ্ঠে।
দেশকে যদি একটি পরিবার ধরি; আর ওই উপন্যাসের চরিত্র মাহমুদ, মরিয়ম, হাসিনা, দুলু’র মতো আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী দল, বাম দলগুলোকে পরিবারের সদস্য ধরি তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়? উপন্যাসে যেমন বিরোধ, দুঃখ-দৈন্য, ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই আর আত্মমর্যাদা-প্রেম আছে; তেমনি আমাদের দেশেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেটা উপস্থিত। ক্ষমতার লড়াইয়ে দলগুলোর একগুঁয়েমি-গোয়ার্তুমির জন্য ক’বছরে দেশের রাজনীতিতে বিরোধের বরফ কঠিনভাবে জমাট বেঁধেছে। রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ অবস্থানে গণতন্ত্র বিপন্ন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গার্মেন্টস, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানুষের যাপিত জীবনে সর্বত্রই অনিশ্চয়তা। চাপা ক্ষেভে গুমরে মরছে মানুষ। আমেরিকা জিএসপি স্থগিত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও রাজনৈতিক বিরোধের জন্যই সেটায় দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোতেও ভাটার টান। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া দেশে ভোটের অধিকার, মানুষের বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ। গণমাধ্যরে রূপান্তর ঘটেছে প্রচার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের আকাশের জমাট বাঁধা কালোমেঘের বরফ বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আয়োজিত সংলাপের মাধ্যমে যেন গলতে শুরু করেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বড় দুই দলের নীতি-নির্ধারকরা কিছু ছাড় দিয়ে হলেও হয়তো সমঝোতায় পৌঁছাতে চাচ্ছেন। সে আভাস পাওয়া যাচ্ছে মহামান্য প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে ‘সংলাপে’র আয়োজন করেছেন। ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে শুরু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ (রব), জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু)’র সঙ্গে সংলাপ করেছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। ধারাবাহিক ভাবে সে সংলাপ চলছে।
সংলাপে অধিকাংশ দল নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এতোদিন ছিল নিরুত্তর। বিএনপি নতুন ইসি গঠনে সংলাপের দাবি জানালে, এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব দিক। অবশেষে বিএনপি বঙ্গভবনে সংলাপ করে প্রেসিডেন্টকে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন’র বক্তব্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট মনে করেন বঙ্গভবনে দেয়া বিএনপির প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক। এ ধরনের সংবাদগুলো আমাদের আশা জাগায়। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলোচনা হয়েছে তাতে কিছু কিছু ব্যাপারে ঐকমত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণতন্ত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা খুবই জরুরি। নির্বাচনকে স্পোর্টসম্যানশিপ স্পিরিট থেকে দেখা উচিত’। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সাক্ষাতের সময় বলা হয়, প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। তারা আশা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
 সংলাপ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের যে কোনো সিদ্ধান্ত তারা মেনে নেবেন। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আশাবাদী হয়েছি। প্রেসিডেন্ট দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিঃসন্দেহে তিনি ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবেন। বিএনপির অন্য নেতারা জানান, বিএনপির চেয়ে অন্য যারাই ভাল প্রস্তাব দেবেন দলটি তা মেনে নেবে। ফলে দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গবেষকরা ‘আশার আলো’ দেখতে পারছেন। তবে তারা বলেছেন, দুই পক্ষকেই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) ছাড় দিতে হবে। যতদূর জানা যায়, বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপি ১৩ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৫ দফা, ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ দফা, জাসদ ৮ দফা প্রস্তাবনার পাশাপাশি অন্যান্য দলগুলোও নিজেদের মতো করে প্রস্তাবনা দিয়েছে। সবার প্রস্তাবনায় কিছু ভিন্নতা থাকলেও অধিকাংশ দফায় মিল রয়েছে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়েছে। তবে এ এখতিয়ার প্রয়োগে প্রেসিডেন্ট স্বাধীন নন। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে প্রেসিডেন্টকে এ নিয়োগ দিতে হয়। যোগ্যতার শর্তাবলী না থাকায় যে কোনো ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ ২০১২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান বাছাই কমিটির (সার্চ কমিটি) মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেন। এই নিয়োগের আগে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী। নতুন নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। ওই সময় সার্চ কমিটির দেয়া ১০ জনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ৫জনকে বেছে নেন।
‘ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’ প্রবাদের মতোই যেন ভূমিকা রাখছে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচনের পর পাল্টাতে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত দেশের মানুষ ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে। অতঃপর একের পর এক উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের নামে হয়েছে ‘পাতানো খেলা’। ভোটের নামে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল, অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন, রক্তারক্তি, আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব আচরণ, সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রতিপক্ষের প্রার্থী ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি কারণে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আর ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় মীর জাফরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে রকিবউদ্দেনের নেতৃত্বাধীন ইসি  ‘অনুগত’ দায়িত্ব পালন করেছে। অন্যদিকে সংবিধান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে প্রার্থী ও ভোটারবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ‘দিল্লীর খুটির’ জোরে সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে নির্বাচন প্রতিহত করা বিএনপি নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার’র দাবিতে আন্দোলনের নামে। ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে শুরু হওয়া ৯২দিন লাগাতার অবরোধের সংঘাত-সংঘর্ষ, জ্বালাও পোড়াও এ বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। আইন শৃংখলার চরম অবনতি এবং বিএনপি নেতাদের ঠেঙ্গাতে আইন শৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি হয়ে পড়ে ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। সীমান্ত হত্যা, তিস্তা চুক্তি, ট্রানজিট-টিপাইমুখে বাঁধের মতো জাতীয় ইস্যুকে গুরুত্ব না দেয়ায় বিএনপির আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা তেমন হয়নি। জনগণ থেকে কিছুটা দূরে সরে যাওয়া বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে না দেয়ায় দলটি কার্যত ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। দলের নেতাদের আন্দোলনের নামে ঘরের ভিতরে মিছিল করতে দেখা যায়। এতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রকাশ্যে থাকলেও দেশের প্রকৃত রাজনীতি যায় হাওয়ায় মিলিয়ে। এ ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ হাজার হাজার নেতার বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়। যা মোকাবিলা করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। জাতিসংঘ, প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো সংলাপের মাধ্যমে ‘সমঝোতা’ পরামর্শ দেয়। জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ সহকারী অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো ঢাকা সফর করে দুই দলের নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বৈঠক করে রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা করতে পারেননি। ঢাকায় কর্মরত বিদেশী রাষ্ট্রদূত-হাইকমিশনাররা নানা উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন দুই বড় দলের অনড় অবস্থানে। শীর্ষ নেতাদের নেতিবাচক মনোভাবে পরিস্থিতি কার্যত অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। দেশি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, চাপের মুখে পড়ে যায় দেশের অর্থনীতি। দুর্নীতি হয়ে পড়ে ওপেন সিক্রেট। সর্বত্রই আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়। আমেরিকার পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট, ইংল্যা-ের সিনেটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের দুই দলের নেতাদের মধ্যেকার জমাটবাঁধা বরফ গলানো নিয়ে আলোচনা হয়, উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিছুতেই কিছু হয়নি; বরফের জমাট শক্ত হতে হতে পাথরের মতো কঠিন রূপ ধারণ করে। সব শেষে নির্বাচন কমিশনে নানা প্রকল্পে সহায়তা দেয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে ব্রাসেলসে আলোচনা করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করা হলে নির্বাচন কমিশনে তাদের দেয়া সহায়তা বন্ধ হয়ে হতে পারে এমন ইংগিত দেয়। এরই মধ্যে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে নতুন ইসি গঠনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেন। সংলাপ চলার সময় অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনে ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং ওই নির্বাচনই পাল্টে দেয় রাজনীতির চিত্র। এখন সবাই আশাবাদী প্রেসিডেন্টের উদ্যোগ সফল হবে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হবে। মূলত ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষকে কোনো সুযোগই দেব না মানসিকতায় টানেলের শেষ মাথায় অনেক দিন ধরেই কোনো আলো দেখা মেলেনি। বঙ্গভবনের উদ্যোগে এখন বরফ গলতে শুরু করায় সেই আলো রশ্মি দেখা যাচ্ছে।
’৭৮ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের পর ইতিহাসের প্রায় পুরো সময় বাংলাদেশের রাজনীতি দু’টি ধারায় প্রবাহিত। ’৯০ এর পট-পরিবর্তনের পর ভোটের রাজনীতিতে এই দুই ধারা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক ধারার আওয়ামী লীগ; অন্য ধারার বিএনপি। দেশের মোট ভোটের ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ প্রায় ৭০ শতাংশ রয়েছে এই দুই ধারার নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের কিছু ভোট থাকলেও দল নিরপেক্ষ প্রায় ৩০ শতাংশ সুইং ভোট নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়। যার কারণে যারা যখন ক্ষমতায় থাকে তারা ভোট প্রভাবিত করেন। বাধ্য হয়েই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসে। আর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেটা বাতিলও করা হয়। নির্বাচনী দৌঁড়ে বড় দলগুলো অর্থ, পেশিশক্তি এবং ব্যবসায়ীদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়ার দিকে ঝোকেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আইভির বিজয় অতীতের সব হিসেবে পাল্টে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা এখন বলতে শুরু করেছেন; পেশিশক্তি, অস্ত্র আর টাকার খেলা নয়; ভোটে যোগ্যদের প্রার্থী করা হলে বিজয় সুনিশ্চিত। শুধু আওয়ামী লীগই নয় বিএনপিসহ অপরাপর দলগুলোরও এই বোধোদয় হয়েছে; এবং তারা সেটা প্রকাশও করছেন। অতএব প্রেসিডেন্ট যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা ফলোপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা। কবি বলেছেন ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনি ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে’। রাজনীতির আকাশে দীর্ঘদিন থেকে কালোমেঘ দেখা গেলেও বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে সে মেঘ কেটে যাবে এবং সামনে রাজনীতির আকাশে সূর্যের হাসির দেখা মিলবে সেই প্রত্যাশায় মানুষ অপেক্ষা করছে।



 

Show all comments
  • সাইমন ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:২৫ এএম says : 0
    ভালো কিছুই প্রত্যাশা করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Nazrul Islam Khan ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:১৪ এএম says : 0
    Insha Allah ভালো কিছুই প্রত্যাশা করছি। Let us all pray to Allah SWT
    Total Reply(0) Reply
  • মারিয়া ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৫৫ এএম says : 0
    আশা করছি, প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
    Total Reply(0) Reply
  • খলিল ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৫৮ এএম says : 0
    নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি।
    Total Reply(0) Reply
  • আল ইমরান ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ পিএম says : 0
    প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গভবন

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ