‘ভাষা আন্দোলনে অবদান না থাকলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে কেন জেলে বন্দি করেছিল’ এমন প্রশ্ন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে উনার কোনো অবদান নেই? তো উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন। গতকাল সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘একুশে পদক-২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশে অনেক বিজ্ঞজন। আমি নাম বলতে চাই না। চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছে ভাষা আন্দোলনে উনার (বঙ্গবন্ধু) আবার কী অবদান ছিল। উনি তো জেলেই ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তার যে অবদান সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। ’৭৫ এর পর বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের ভাষা, মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। আর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।

পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধজন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলো যে আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি। গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে এম আর আখতার মুকুলের কাছে যাই আমি আর বেবি মওদুদ। উনারা তো অনেক উঁচু মাপের লোক, আমাদের মত ছোট চুনোপুটিরা কিছু লিখলে তো হবে না। তো মুকুল ভাইকে বললাম আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন তারিখে কখন কী করেছেন এখানে সব ডিটেইল আছে। ফাইলটা দিলাম, আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেলো আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান, যে সেøাগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সেই জয়বাংলা সেøাগান নিষিদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সব নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন; সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি যেন সুন্দরভাবে বিকশিত হয়। আমরা বাঙালি হিসেবেই মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে চলবো। আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি এই বাংলাদেশকে আমরা আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব উন্নয়নের পথে।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা দিবস। শুধু আমাদের না, এটা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত দিয়ে রক্তের অক্ষরে একুশের শহীদরা লিখে দিয়ে গেছেন মাকে মা বলে ডাকতে চাই। তিনি বলেন, ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এরপর একুশ বছর পর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুণরায় সরকার গঠন করলে দেশের স্তিমিত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা গতি লাভ করে। এরপর আওয়ামী লীগ বিগত ৩ মেয়াদে টানা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। কাজেই এই দেশকে এখন আর কেউ পেছনে টানতে পারবেনা।

শেখ হাসিনা বলেন, শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায়না, বৃথা যায়নি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের সেই অবদান আমরা সবসময় স্মরণ করি। একুশে পদক প্রাপ্ত গুণিজন সকলকে তার আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণিজন রয়েছেন যাদের অনেকে নামটি পর্যন্ত জানে না। এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাদের অবদানকেই সকলের সামনে নিয়ে আসায় তার সরকারের প্রচেষ্টা। এজন্য সম্মাননা প্রাপ্তদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আশাকরি আমাদের নতুন প্রজন্মও এভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। কারণ, গুণিজনদের পদাংক অনুসরণ করেই আমাদের দেশকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব। কিন্তু আধুনিক বিশে^র সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ আমরা গড়ে তুলবো।

এবার ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান; শিল্পকলা বিভাগে অভিনয় ক্যাটাগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) এবং রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং চার লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন পদক বিতরণ পর্বটি সঞ্চালনা ও পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ দেশ বরেণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।