Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডেঞ্জার জোন ঝুঁকি মোকাবেলা কেবল কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ

সিলেটে ধাক্কা মারলো ভূমিকম্প!

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

শতাব্দীর ভয়াবহ ভ‚মিকম্পে লন্ডভন্ড যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও আধুনিক তুরস্ক। মানব সৃষ্ট না কৃত্রিম এ কম্পন, তা নিয়ে বির্তক চলছে দুনিয়া জুড়ে। বিতর্কের ক‚লকিনারা না হলেও কম্পনে সৃষ্ট ধ্বংসের ক্ষত নাড়িয়ে দিয়েছে সিরিয়া তুরস্ককে। সেই সাথে ভ‚মিকম্পের আতঙ্কও ছড়িয়েছে বিশে^র নানা প্রান্তে। সেই আতঙ্কে গভীরভাবে আতঙ্কিত ভ‚মিকম্পের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিলেট। একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভ‚মিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার কম্পনে ধাক্কা মেরেছে সিলেটের একটি অঞ্চলে। রিখটার স্কেলে এ কম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। সকাল ৯টা ৫৬ মিনিটে ছাতকের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভ‚মিকম্প অনুভ‚ত হয় বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।

আবহাওয়া অধিফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, রিখটার স্কেলে ভ‚মিকম্পটির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। এর কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্য। এতে মৃদু কম্পন অনুভ‚ত হয়েছে সিলেটে। মার্কিন ভ‚-তাত্তি¡ক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুসারে, এই ভ‚মিকম্পের গভীরতা ছিল ৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এ ভ‚মিকম্পনে।

এনিয়ে গত দুই বছরে সিলেটে অন্তত ১৬ বার ভ‚মিকম্প হয়েছে। ভ‚মিকম্পের ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবেলায় সিলেটের নেই কোন কার্যকর প্রস্তুতি। ২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফা ভ‚মিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ কাগজে কলমে নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভ‚মিকম্পের ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া সিলেটের ৬টি বিপণিবিতান বন্ধ করে দিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এগুলো ভেঙে ফেলা হবে বলেও সেসময় জানিয়েছিল সিসিক। তবে ভেঙে তো ফেলা হয়নিই, উল্টো কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের খুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বিপণি বিতানগুলো। এ নিয়ে জনশ্রæতি রয়েছে, ভ‚মিকম্প ঝুঁকির ট্যাগ লাগিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সেগুলোকে আবার খুলে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

আবহাওয়া অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সংগঠিত ভ‚মিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। এরমধ্যে ১১টি হচ্ছে সিলেট অঞ্চলে। বাকি ৭টি ছিল সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বারবার ভ‚মিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার চ্যুতির লাইনগুলো আছে সক্রিয়। এদিকে, থমকে গেছে সিলেটের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভ‚মিকম্পের সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগও।

সিসিক কর্মকর্তারা জানান, অর্থের অভাবে ভবন পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। ফলে এখন পর্যন্ত তর্জন গর্জনেই সীমাবদ্ধ ঝুঁকি মোকাবেলার উদ্যোগ। সম্প্রতি তুরষ্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভ‚মিকম্পের পর আবার আলোচনায় উঠে এসেছে সিলেটের ঝুঁকির বিষয়টি। ২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভ‚মিকম্পের পর বড় ভ‚মিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরের সব বহুতল ভবনের ভ‚মিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা । এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নগরীর বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করানো হয়।

এই বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম ইনকিলাবকে বলেন, সিলেটের ভবনগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিভাবে। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভ‚মিকম্প প্রতিরোধকভাবে নির্মাণ করা হয়নি। তাই ৭ মাত্রার ভ‚মিকম্প হলেই ভেঙে পড়তে পারে ৮০ ভাগ বহুতল ভবন। দুই-চারটি ভবন নয়, বরং নগরের সবগুলো ভবন একসঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভ‚মিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কাজনক বক্তব্যের কোন দামই যেন নেই কারো কাছে। সেকারণে ভ‚মিকম্পের ঝাঁকুনি সিলেটে হলে তোড়জোড় বাড়ে তারপর যেই সেই। অথচ ২০২১ সালে দফায় দফায় সিলেটে ভ‚মিকম্পের পর বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। ওইদিনই নগরী সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানসন ও রাজা ম্যানসন নামের ৭টি বিপণি বিতানকে নির্দেশ দেয়া হয় ১০ দিন বন্ধের। একই সময়ে নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। কিন্তু অর্থ সঙ্কটে সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। আর নির্ধারিত ১০ দিন পর কোনো সংস্কার ছাড়াই খুলে দেয়া হয় বন্ধ করা ভবনগুলো। এখনও এগুলোতে চলছে স্বাভাবিক কার্যক্রম।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা বলেছিলাম মালিকপক্ষকে। কিন্তু তা শোনেননি তারা। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে আদালতে মামলা করে বসেন মার্কেট মালিকপক্ষ।

৪২ হাজার ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ প্রসঙ্গে নূর আজিজুর রহমান বলেন, আমরা নগরের ৪২ হাজার ভবনে ভ‚মিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপও করি। ওই প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে নগরীর ৪০ থেকে ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষায় প্রয়োজন ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই।

সিসিক সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে পূর্বে আরেকবার নগরের বহুতল ভবনগুলোর ভ‚মিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখনও মাঝপথেই আটকে যায় সে উদ্যোগ।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, নগরীর ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করা গেলে কয়েকশত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বড় ধরনের ভ‚মিকম্প হলে এগুলো ধ্বসে পড়ে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

সিলেটের অনেক ভবনেরই অনুমোদন নেই জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, সিলেটের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভ‚ঞা বলেন, অনেক বহুতল ভবনই নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদনহীনভাবে সিলেটে। অলিগলির রাস্তাও সরু, ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। সার্বিক বিবেচনায় ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না সিলেটে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভূমিকম্প

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৪ মার্চ, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ