Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পারিবারিক পরিবেশের গুরুত্ব

জাফর আহমাদ | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সমাজ জীবনের প্রাথমিক ইউনিট হলো পরিবার। এই ইউনিটের ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, তাহলে সেই সমাজ দূর্বল হয়। সমাজ দুর্বল হলে, রাষ্ট্র দুর্বল হয়। তাই পরিবারকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য পারিবারিক বন্ধন ও সম্প্রীতিকে মজবুত করতে হবে। একটি মজবুত সমাজ গঠণ করার জন্য একটি সুস্থ পারিবারিক পবিবেশ গড়ে তুলতে হবে। অসুস্থ পরিবার সমাজ জীবনের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নবী সা. বলেছেন,‘প্রত্যেক সন্তানই ফিৎরতের (দ্বীন বা সত্য কবুল করার যোগ্যতা) ওপর জন্মগ্রহন করে থাকে। অতঃপর তার পিতা মাতা (নিজেদের বর্তমান চরিত্র দ্বারা) তাকে ইহুদী বা খৃষ্টান করে দেয় অথবা অগ্নি উপাসক করে দেয়।’ মানব শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর যাদের পরিবেষ্টনে আবদ্ব থাকে সেটি সে শিশুর পরিবেশ বলা হয়। ছোট্র এ গ-ি বা বেষ্টনীর প্রধান দু’জন সদস্য হলো পিতা ও মাতা, যাকে আমরা পারিবার বলে থাকি। একটু ব্যাপকাকারে বলতে গেলে এর সাথে দাদা-দাদী, চাচা ও ফুপিকেও সদস্য হিসাবে যোগ করতে পারি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার পেিবশেরও সম্প্রসারণ ঘটে। পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে সমাজ ও মনেবিজ্ঞানীগণ ব্যাপক গবেষণা ও আলোচনা করেছেন। রাসুল সা. এর উল্লেখিত হাদিসখানির প্রতি গভীর মনযোগ নিবদ্ধ করলে বুঝা যায় যে, তিনি কত বড় একজন পরিবেশবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। পরিবেশ মানব শিশুর বিভিন্নমুখী আচরণ, ব্যবহার ও দোষ-গুণের ওপর কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করে। উল্লেখিত হাদিসে ফিৎরাত বলতে দ্বীন বা সত্য ও ন্যায় তথা ইসলামকে কবুল করার যোগ্যতা ও মানসিকতাকে বুঝানো হয়েছে। সকল শিশুই এ যোগ্যতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। যে পরিবেশে বা পরিবারে সে জন্ম গ্রহণ করেছে সেটি যদি তার ফিতরাতের অনুকুল হয়, তবে সে সত্য ও ন্যায়ের উপর টিকে থেকে তার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সুচারুরূপে প্রস্ফুুটিত করতে পারে। আর পরিবেশটি যদি বিপরীতমুখী হয় তবে তার চরিত্র বিপরীতমুখী ধাঁচেই গড়ে উঠবে। পারিবারিক পরিবেশ যদি উশৃংখল চরিত্রের হয়, সে পরিবেশের শিশুটি শয়তানের শিরোমনি হবে এটাই স্বাভাবিক।

পরিবার হলো, একটি শিশুর জীবন গড়ার প্রাথমিক পাঠশালা। এ পাঠশালার পাঠ্য তালিকায় যে ধরনের বই সিলেকশন করা হবে, শিশুর জীবনের ভীত রচিত হবে সে সিলেবাসেরই উপড়। এ জন্য পরিবারের শক্তিশালী দু’জন সদস্য পিতা ও মাতার গুরুত্ব অপরিসীম। পিতা-মাতা যে ধরনের আচরণ, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্ম করেন, ছেলে-মেয়ে সে সব অনুসরণ করতে শেখে। ছেলে-মেয়েরা তাদের জীবনের মডেল হিসাবে পিতামাতাকে গ্রহণ করে থাকে। তাই অনুকরণ প্রিয় শিশুর পিতা-মাতা যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসণের পূর্ণ অসুসারী হন এবং পারিবারিক পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল স: প্রদর্শিত পন্থায় পরিবেশকে গড়ে তুলেন, তাহলে তাদের সন্তানেরাও সেভাবেই গড়ে উঠবে। ছেলে-মেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠণ করা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা সুষ্পষ্ট জুলুম হিসাবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:‘তোমাদের নিজেদেরকে ও পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো।’ (আল-কুরআন)।

রাসুল সা. বলেছেন : ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চাইতে উত্তম কিছুই মা বাপ সন্তানদের দান করতে পারেন না।’ (তিরমিযি) আবু দাউদে বর্ণিত, রাসুল স: বলেছেন: কোন বালকের সাত বৎসর বয়স হলেই তাকে নামাযের আদেশ দাও। আর দশ বৎসর বয়স হলে সে জন্য প্রহার করো ও বিছানা আলাদা করে দাও।’ প্রত্যক্ষ করুন আল-কুরআনের সুরা লোকমানে একজন আদর্শ পিতা হয়ে তাঁর সন্তানকে কিভাবে উপদেশ দিচ্ছেন :-‘ স্মরণ করো যখন লোকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো ‘হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম।’(সুরা লোকমান : ১৩)।

পক্ষান্তরে এ দ’ুজন যদি বিকৃত স্বভাব ও কুরুচি মনের অধিকারী হন। আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায় নিয়ে পাশ্চাত্যের উশৃংখল আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ব্যক্তিগত ও পরিবারিক পরিসরে চালু করেন, তবে তাদের পরিবারটি পশুর খোয়ারে পরিণত হবে। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ, লজ্জা-শরম, প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার পরিবর্তে বেয়াদবী, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও উশৃংখলতা ব্যাপকহারে চালু হবে। আদরের সন্তানটি চোখের সামনে মদ্যপ অথবা অপরিচিত মেয়ে মানুষ নিয়ে আসবে। অস্ত্রবাজ, গুন্ডা ও ছিনতাইকারী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের কুকর্ম দ্ধারা নিজেকে রাঙাবার শখ জাগবে। কারণ দিন-রাত নিজ পরিবারে এ দৃশ্যই সে দেখে আসছে। ব্যর্থ প্রগতিবাদী ও উশৃংখল কিছু পিতা-মাতা তো এমনটিও রয়েছেন যে, নিজেদের কোমলমতি ও নিস্পাপ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একই সাথে একই সোফায় বসে দেশী-বিদেশী টিভি পর্দায় অশ্লীল মারদাঙ্গা ছবি দেখেন অথবা নর্তক-নর্তকীদের উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ নাচ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কৃত্রিম যৌনাচার মুলক দৃশ্য খুবই তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করে থাকেন। একটি শিশু বদমায়েশ ও দুশ্চরিত্র হিসাবে গড়ে উঠার জন্য যতগুলো উপকরণ প্রয়োজন সবগুলোর যোগান এ পিতা-মাতাই দিয়ে থাকে। এর চেয়ে লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে ? রাসুল সা. বলেছেন : ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। যে ব্যক্তি পিতামাতার অবাধ্য, দায়ুস এবং পুরুষসুলভ আচরণকারী নারী। এখানে দায়ুস বলতে বুঝানো হয়েছে পরিবারের মধ্যে অশ্লীলতা ও পাপাচারের প্রশ্রয় দাতাকে। এটিকে ইমাম আয্যাহাবী তাঁর ‘কিতাবুল কাবায়ের’ গ্রন্থে কবিরা গুনাহ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিরমিযি শরীফে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন : নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা কোন বস্তুর কদর্যতাই বৃদ্ধি করে। আর লজ্জা কোন জিনিসের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে।’ আব্দুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত।

আল-কুরআনে পিতা-মাতার এতবেশী সম্মান, ইজ্জত ও অধিকার দান করার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে ? আমি মনে করি বহুবিদ কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, যেহেতু পিতামাতা অত্যন্ত পরিশ্রম করে নিজের সস্তানদেরকে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন, সুচরিত্রবান ও সামাজিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসাবে গড়ে তুলেন এবং এর পিছনে পিতা-মাতার অবদানই সবচেয়ে বেশী। যার দরুন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর আলোচনার পরপরই পিতামাতার কথা বলছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:‘তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তার সাথে কাউকে শরীক করো না, আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা : ৩৬) বুখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসুল সা. কে আরয করেনঃ হে আল্লাহর রাসুল! আমার ভাল ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী কে ? তিনি বললেন তোমার মা। এভাবে তিনবার মার কথা বলার পর চতুর্থবার পিতার কথা বলেন। পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে নবী সা. কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এছাড়াও আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও রাসুলের সা: হাদীসে পিতামাতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে সম্মানিত করা হয়েছে।
সন্তান দাম্পত্য জীবনের উত্তম ফসল ও প্রত্যাশিত আকাংখা, মানববংশ রক্ষাকারী সেতু এবং একজন পিতা ও মাতার সৌন্দর্য বর্ধনকারী। একে রক্ষা করা, লালন পালন করা, ব্যয়ভার বহন করা শিক্ষা-দীক্ষা সুস্থ-সবল করা পিতা-মাতার জন্য ফরয। পিতা ও মাতার অবহেলার জন্য যদি সে সুস্থভাবে গড়ে উঠতে না পারে এবং মানব ধারা কোন একস্থানে এসে বাধা গ্রস্থ হয়, তার জন্য অবশ্যই আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। মনে রাখতে পিতামাতার আচরণের ওপর সন্তানের ভীত রচিত হয়। আচরণ যদি সৎ ও সঠিক হয় অর্থাৎ দাম্পত্য জীবন যদি নেক্কার ও সৌভাগ্যবান হয় এবং পরস্পর সহযোগী হয় তাহলে মানবচরিত্র সেভাবেই বিকশিত হবে। আখিরাতে এ ধরণের পিতামাতাকে আল্লাহ তা’আলা পুরস্কৃত করবেন।

কিন্তু এ পিতামাতাই যদি নিজ হাতে নিজের সন্তানদেরকে ধ্বংসের রাজপথে তুলে দেন তবে সে সমস্ত পিতামাতাকে মুলতঃ দেশ ও জাতির শুত্রু বলে আখ্যায়িত করব। কারণ অপরিণামদর্শী এসব পিতা-মাতাই জাতীয় সন্ত্রাসী, গডফাদার, আন্তর্জার্তিক চোরাচালানী, চোর-ডাকাত ও বদমায়েশী শিক্ষার সবগুলো উপাদান চেতনে বা অবচেতনে পারিবারিক পরিবেশে ছোট্র কচি মনের শিশুটির জন্য প্রধান যোগানদাতার ভুমিকা পালণ করেন। অবশ্য দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এ জন্য কম দায়ী নন। তারাও তাদের তৃতীয় প্রজন্মকে চরিত্রবান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য যথাযথ ভুমিকা পালন করেন না। তাই সকল পিতামাতাকে বলব আপনার প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অসুসারী হিসাবে গড়ে তোলার নিমিত্তে পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল সা. প্রদর্শিত পন্থায় সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা চালু করুন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ