চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
কোন ধর্ম যদি বিশেষ কোন গোত্র বা বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট করা না হয় অথবা সীমবদ্ধ না থাকে কোন ভৌগোরিক সীমারেখার মধ্যে, বরং ধর্মের লক্ষ্য যদি হয় বিশ্ব জগতের সমগ্র জনগোষ্ঠী তা হলে দু’ভাবে সে ধর্ম গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণ করার মাধ্যমে দ্বিতীয়ত জন্মগত সূত্রে। জন্মসূত্রে ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্নটি গৌণ।
স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনভাবে একটি ধর্মকে পরিহার করে এবং আরেকটি ধর্ম গ্রহণ করে। কোন ধর্ম গ্রহণ বা বর্জন করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তার পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, ‘তাকে মুখে ঘোষণা দিতে হবে এবং অন্তরে বিশ্বাস করতে হবে।’ স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে প্রথমে গোসল করার মধ্য দিয়ে অবিশ্বাস এবং অজ্ঞতার কালিমা দূরীভূত হয়। অতঃপর সে দু’জন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে ঘোষণা দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসূল বা প্রেরিত পুরুষ।
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে, কোন লোক ইসলাম গ্রহণ কলে প্রিয়নবী (সা.) তাঁর পূর্ব নাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। যদি দেখা যেত যে, তাঁর নামের সঙ্গে অনৈসলামিক কোন ধ্যান-ধারণা জড়িয়ে আছে, অথবা তার না কা’বার পূজারী, সূর্যের পূজারী, ভ্রান্ত পথের অনুসারী অথবা এ জাতীয় কোন অর্থ বহন করে, তাহলে সে নামগুলো পাল্টিয়ে সুবিধাজনক একটি নতুন নাম ঠিক করে দিতেন। বর্তমান সময়ে নওমুসলিমগণ পূর্ব নামের সঙ্গে একটি আরবি নাম যোগ করে থাকেন। নবী করীম (সা.) এর মাতৃভাষা আরবি। তাঁর স্ত্রীগণ উন্মুল মু’মিনীন বা মুসলমানদের মাতা হিসাবে পরিচিত। তাঁরাও আরবি ভাষায় কথা বলতেন। সে হিসাবে প্রতিটি মুসলমানের একটি মাতৃভাষা আরবি। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, আরবি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জগতের মাতৃভাষা। সে কারণেই আরবি ভাষা লেখা, বিশেষকরে মূল আরবিতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে পারাটা প্রত্যেক মুসলমানের একটি পবিত্র দায়িত্ব।
মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে একটি শিশু ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকে। ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরই তার ডানকানে আযান এবং বাম কানে আকামত দেওয়া হয়। অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করার পর প্রথমেই সে শুনতে পায় আল্লাহর একত্মবাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দান এবং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও নিজের কল্যাণের জন্য আহ্বানের কথা। আযানের সময় তাকে শোনান হয় যে, আল্লাহ মহান; আমি শপথ গ্রহণ পূর্বক সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ (মাবুদ) বা উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। সালাতের জন্য এসো, কল্যাণের জন্য এসো, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ (মা’বুদ)নেই। আকামতের সময় তাকে আযানের সব কথাই শোনানো হয়। তাকে আরো শোনানো হয় যে, ওহে সালাতের সময় সমুপস্থিত।
বাল্যজীবন : শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর প্রথম চুল কেটে সমস্ত চুলের সমপরিমাণ ওজন রূপা বা টাকা গরীব-দু:খীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যাদের সঙ্গতি আছে তারা ছাগল বা ভেড়া যবাই করে এবং সেই গোশত দিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দু:খীদের আপ্যায়ন করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলে আকীকা। এরপরেই আসে পুত্র সন্তানকে খাতনা (মুসলমানী) করানোর প্রসঙ্গ। খাতনা করানোর নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নির্ধারণ করা নেই। সাধারণত বাল্য বয়সেই খাতনা করানো হয়। অবশ্য কোন বয়স্ক লোক ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে খাতনা করানোর ব্যাপরে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
সাধারণত চার বছর পর শিশু লেখাপড়া শুরু করে। এ সময়ে বিশেষ দু’আ-দরূদ ও ভাল খাবারের আয়োজন করা হয়। শিশুকে সে অনুষ্ঠানেই প্রথম পাঠ দেওয়া হয়। শুভ সূচনা হিসাবে কুরআনুল করীমের সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত তিলাওয়াত করা হয়। শিশু উস্তাদের সঙ্গে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে। বলে রাখা আবশ্যক যে, হেরা গুহায় নবী করীম (সা.) সর্বপ্রথম যখন ওহী লাভ করেন, তখন এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল।
সালাত ও সিয়াম : লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে নামায পড়ার নিয়ম কানুনগুলো শিখতে হয়। তাকে মুখস্থ করতে হয় প্রয়োজনীয় দু’আ-দরূদ ও কুরআনের সূরাসমূহ। সাত বছর বয়সে সে সালাত আদায় করতে শুরু করে। প্রয়োজনবোধে পিতা-মাতা এ জন্য তাকে শাস্তি দেন। বাল্য বয়স থেকে সালাতে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য এটা জরুরী। একটি শিশু বয়:প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার উপর সালাত বা নামায পড়ার ন্যায় রোযা রাখা বা সিয়াম পালন করাটাও ফরয হয়ে পড়ে। অবশ্য মুসলিম পরিবারের শিশুরা বয়:প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই সিয়াম পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। জীবনে প্রথম যেদিন সিয়াম পালন করে. সেদিন সে খুবই আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয়ে থাকে। এমন কি এটা যেন তার পরিবারে একটা উৎসবের রূপ নেয়। সাধারণত বার বছর বয়সে ছেলেমেয়েরা সিয়াম পালন করতে শুরু করে এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে এ মাসব্যাপী সিয়াম পালনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
হজ্জ : সঙ্গতি সম্পন্ন লোকের জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। যিলহজ্জের দ্বিতীয় সপ্তাহে হজ্জ করা হয়। এ সময়ে হাজীগণ মক্কায় সমবেত হন এবং প্রায় সপ্তাহ ব্যাপী তাঁরা মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা এবং আবার মিনায় অবস্থান করেন। এ তিনটি স্থান মক্কার উপকন্ঠে অবস্থিত। যিলহজ্জ মাস ছাড়াও বছরের যে কোন সময় কা’বা ঘরে যাওয়া যায়। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলা উমরাহ। যিনি হজ্জ করবেন তাকে অবশ্যই নিত্যদিনের পোশাক পরিত্যাগ করতে হবে। এ সময়ে তাকে বিশেষ এক ধরনের পোশাক পড়তে হয়, এটাকে বলে ইহরাম। ইহরামে দুই প্রস্থ কাপড় থাকে। কাপড়ে কোন রকম সেলাই চলে না। এক প্রস্থ কাপড় সে পরিধান করে, অন্য প্রস্থ দিয়ে কাধ ও শরীর ঢাকে। কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য মাথা উন্মুক্ত রাখে। মহিলারা স্বাভাবিক পোশাক পরে। তবে তা হতে হয় শালীন ও মার্জিত। তাদের হাত এবং পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত সমস্ত শরীর আবৃত রাখতে হয়। মক্কার আরেক নাম হেরেম শরীফ। হেরেম শরীফে প্রবেশের পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হয়। হেরেম শরীফে প্রবেশের পূর্বে যেখান থেকে ইহরামের পোশাক পরিধান করতে হয় সে স্থানকে মীকাত বলে।
আর মক্কাবাসীদের ইহরাম বাঁধতে হয় হেরেম শরীফ বা মক্কার অভ্যন্তর থেকে। হেরেম শরীফ থেকে সে চলে যায় মিনায়। ৯ই যিলহজ্জ যায় আরাফাতের ময়দানে। সারাটা দিন সেখানে কাটিয়ে দেয় ইবাদ-বন্দেগী ও দু’আ-দরূদ পাঠের মধ্যে দিয়ে। রাত্রি যাপন করে মুযদালিফায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। ১০, ১১ ও ১২ তারিখ এ তিন দিন অতিবাহিত করে মিনায়। মিনায অবস্থানকালে প্রতিদিন সে শয়তানের প্রতিকীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে। সুযোগ বুঝে এক সময়ে (১০ কিম্বা ১১ তারিখ) তাকে মক্কায় যেতে হয়। তখন সে তওয়াফ ও সাঈ করে। নির্ধারিত নিয়মে পবিত্র কা’বা ঘর ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তওয়াফ বলে। আর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে ৭ বার আসা যাওয়াটা হল সাঈ। কা’বা ঘর তওয়াফ এবং সাঈ করার নির্দিষ্ট কতকগুলো পদ্ধতি ও দু’আ রয়েছে। বস্তুতপক্ষে ইহরাম পরিধান করার পর থেকে ইহরাম ছাড়া পর্যন্ত একজনকে সারাক্ষণ আল্লাহর যিকর করতে হয়। এ সময়ের এ যিকরকে বলে তলবিয়া। তলবিয়ার দোয়া এরকম : ‘লাব্বায়িক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়েক লা শারীকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক্। উমরা করার জন্য আরাফাত, মিনা বা মুযদালিফায় যেতে হয় না। কিন্তু যথারীতি তওয়াফ ও সাঈ করতে হয় এবং ইহরামের কাপড় পরিধান করতে হয়। এমনকি মক্কায় বসবাসকারী মুসলমানগণকে উমরা করার জন্য মক্কার বইরে গিয়ে ইহরাম করে হেরেম শরীফে প্রবেশ করেত হয়। তওয়াফ ও সাঈ করার পর মাথা মুন্ডন করে তারা স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসে।
যাকাত : যাকাত এক ধরনের সাদাকা। সকল প্রকার সঞ্চয়, মওজুদ, সম্পদ, উৎপন্ন ফসলের উপর যাকাত প্রদান করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে : কৃষিপন্য, বাণিজ্য সামগ্রী, খনিজ সম্পদ, সরকারী চারণ-ভূমিতে পালিত মেষ-ছাগল, গরু, উট। আজকালকার দিনে মুসলমানগণ সঞ্চিত সম্পদের উপর প্রদত্ত যাকাত ব্যক্তিগতভাবে প্রদান করে থাকেন। মুসলিম বা অমুসলিম সব রাষ্ট্রেই এ নিয়ম চালূ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য কর বা খাজনার পরিমাণ স্থানীয় সরকার নির্ধরণ করেন এবং তা আদায়ও করা হয় সরকারী তত্ত্বাবধানে। যাকাতের হিসাব এ রকম যে, কারো কাছে যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সমমুল্যের অর্থ এক বছরের বেশি সময় জমা থাকে তাহলে তাকে উক্ত সঞ্চয়ের উপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হয়। যাকাতের অর্থ সরাসরি বিরতণ করা যেতে পারে অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও তা ব্যয় করা বৈধ। যাকাতের অর্থ ব্যয় করার ৮টি খাত আল্লাহ তা’আরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী এক বা একাধিক খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে পরে।
বছরের দুটি প্রধান উৎসব দুই ঈদে আরেক ধরনের সাদকা প্রদান করতে হয়। রমযান শেষে ঈদুল ফিতরের সময় দিতে হয় ফিতরা। এর পরিমাণ হল পূর্ণ বয়স্ক একজন লোকের সারা দিনের খোরাকের সমান। এ অর্থ একজন নি:স্ব দরিদ্র লোকের প্রাপ্য। আবার পবিত্র নগরী মক্কায় যখন হজ্জ পালন করা হয় তখন আসে ইদুল আযহা। এ সময় সঙ্গতি সম্পন্ন লোকেরা গরু, ছাগল অথবা মেষ কোরবানী করে থাকেন। কোরবানীর গোশতের একটি অংশ নিজেদের জন্য রেখে বাকি অংশ দু:স্থ ও গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়।
অর্থনীতি প্রসঙ্গে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, একজন মুসলমানের পক্ষে কোন রকম সুদী কারবারে অংশ গ্রহণের অনুমতি নেই। সে বিষয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জুয়া, লটারী অথবা ফটকাবাজী কোন কাজে হাত দিতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বেচ্ছায় কেউ কখনো সুদ দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে ঋণ দিয়ে তার উপর সুদ আদায়ের প্রবণতাকে সম্পুর্ণরূপে পরিহার করতে হবে।
ব্যাংকে জমা রাখা টাকার উপর যে সুদ আসে সে ব্যাংকটি যদি সুদী কারবারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তাহলে এর লভ্যাংশও অবৈধ। কিন্তু এমন অনেক দেশ আছে যেখানে সুদী ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোন ব্যাংক নেই।
তখন তাকে বাধ্য হয়েই সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি ব্যাংকে তার সঞ্চয়ের উপর যে সুদ আসে তা গ্রহণ না করে, তাহলে ব্যাংক ইচ্ছা করলে অদাবিকৃত সুদের অর্থকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে। কখনো কখনো অনুদান প্রাপ্ত এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে। সে কারণেই ব্যাংকে জামা টাকা উপর যে সুদ আসে তা ছেড়ে না দিয়ে বরং তা গ্রহণ করা উচিত। অবশ্য এ অর্থ নিজের বা পরিবারের জন্য ব্যয় না করে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। প্রখ্যাত মুফতী সারাখশী বলেছেন যে, ‘অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে এবং এ সম্পদকে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে’। কারো কারো মতে সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও দায়-দেনার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সোসাইটির সঙ্গে বীমা করা বিধিসম্মত। কিন্ত পুঁজিবাদী মুনাফালোভী কোন কোম্পানীর সঙ্গে বীমা করাটা অবৈধ।
বিবাহ : এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একজন মুসলমান পুরুষ একজন মুসলমান মহিলাকে বিয়ে করবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে খৃষ্টান বা ইয়াহূদী ধর্মাবলম্বী নারীকে বিয়ে করাটা বৈধ বরে বিবেচিত। কিন্তু সে কোন পুতুল পূজারী, নাস্তিক বহু ঈশ্বরবাদী মহিলাকে বিয়ে করতে পরে না। কিন্তু একজন মুসলিম মহিলা কোন অমুসলিমকে বিয়ে করতে বা অমুসলিমকে নিয়ে দামপত্য জীবন যাপন করতে পরে না। সে অমুসলিম পুরুষ, ইয়াহূদী, খৃষ্টান নাস্তিক, যাই হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। অমুসলিম পরিবারের পুরুষ যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কিন্তু স্ত্রী ইয়াহূদী বা খৃষ্টার থেকে যায়, তাতে দাম্পত্য জীবন অবৈধ হয় না। কিন্তু একটি অমুসলিম পরিবারের স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর স্ত্রী যদি নাস্তিক, পুতুল পূজারী বা বহু ঈশ্বরবাদী থেকে যায় তা হলে সে বিয়ে তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে যায়। অবশ্য দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে দেওয়ার পূর্বে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য স্ত্রীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে হয়। অনুরূপভাবে কোন অমুসলিম পরিবরের স্ত্রী যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে স্বামীকে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দেওয়া হবে। এরপরও স্বামী মুসলমান না হলে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটবে এবং মুসলমান স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হবে।
মৃত্যু : মৃত্যুপথযাত্রী একজন মুসলমান শেষ মুহূর্তেও পাঠ করতে চায় : ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ -অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসূল। মৃত্যু পথযাত্রীর পাশে যারা থাকে তারাও রোগীকে বার বার এ কথাগুলো উচ্চারণ করতে সাহায্য করে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলে তালকীন। মৃত ব্যক্তির শরীর শক্ত হয়ে যাওয়ার পূর্বে তার হাত দুটি সালাতের ভঙ্গিমায় হয় বুকের উপর অথবা শরীরের দু’পাশে সোজাভাবে রাখতে হয়। সম্ভব হলে মৃতদেহ করবস্থা করার পূর্বে ওযু-গোসল দিয়ে পবিত্র করা হয়। নিত্যদিনের পোশাকগুলো খুলে তিন প্রস্থ সাধারণ কাপড় দিয়ে দেহ আবৃত করা হয়। মৃতদেহ গোসল করানোর প্রথম পর্যায়ে মৃতদেহের সমস্ত শরীরে সাবানের পানি ঢালা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে গায়ে লেগে থাকা সাবানের পানি ভালভাবে পরিস্কার করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্পুর মিশ্রিত পানি দিয়ে সারা শরীর ধুয়ে ফেলতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষ নেহায়েত অসুবিধার কারণে পানি দিয়ে পরিস্কার করা সম্ভব না হলে তায়ামমুমের সাহায্যে মৃতদেহ পাক পবিত্র করতে হয়।
সাধারণ কাপড় দিয়ে মৃতদেহ আবৃত করার পর জানাযার নামাযের ব্যবস্থা করা হয়। এটা ফরযে কিফায়া। মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও জানায়ার যে নামায পড়া হয় তাকে বলে গায়েবানা জানাযা। যতদূর সম্ভব মক্কার সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণে কবর খোধাই করা হয়। কবরের মধ্যে মৃত ব্যক্তির মাথা উত্তরের দিকে রেখে মুখ ডান দিকে সামান্য কাত করে দেওয়া হয়। মৃতদেহকে কিবলামুখী করে রাখাই এর উদ্দেশ্য। মৃতদেহ কবরে রাকার সময় বার বার এ দু’আটি পড়তে হয় “বিসমিল্লাহ ওয়া’আলা মিল্লাতি রাসূলুল্লাহ”। মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, মৃতদেহ কবরস্থ করার পর দুজন ফেরেশতা কবরের মধ্যে আসেন এবং মৃত ব্যক্তিতে তার ঈমান সম্পর্কে কতকগুলো প্রশ্ন করেন। এ বিশ্বাসের সূত্র ধরেই কবরের পাশে দাড়িয়ে দু’আ পাঠ করা হয়্ কুরআন মজীদের এই আয়াতও বার বার তিলাওয়াত করা হয় যার অর্থ হচ্ছে : হে প্রশান্ত চিত্ত, তুমি তোমার রব-এর নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষ ভাজন হয়ে। আর বান্দাদের অন্তুর্ভূক্ত হও এবং আমার জান্নাতে দাখিল হও (৮৯ : ২৭-৩০)। করবস্থানকে জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার জন্য যে কোন রকম বাহুল্য ব্যয় বাঞ্ছনীয় নয়। কবরস্থানকে যতাসম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা উচিত। বস্তুতপক্ষে মৃত ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে অভাবী ও গরীবদের মধ্যে বেশি দান খয়রাত করা ভাল। আল্লাহর দরবারে এ মুনাাত করতে হবে যে, তিনি যেন দান খয়রাতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির রূহের উপর পৌছে দেন। একে সওয়াবে রিসানী বলে।
সাধারণ আচরণ : নিয়মিত সালাত আদায় এবং রমযান মাসে রোযা রাখা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ আচার-আচরণের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিয়মিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা, কুরআনের অর্থ বুঝা এবং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করা। বস্তুত পক্ষে কুরআনের বিভি-বিধানগুলো নিজেদের জীবনে রূপায়িত করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিটি কাজ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে শুরু হবে। আবার কাজ শেষ করেই বলতে হবে আলহামদুলিল্লাহ। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার ইচ্ছা পোষন করলে অথবা ওয়াদা করলে সঙ্গে সঙ্গে ইনশাআল্লাহ বলতে হবে। একজন মুসলমানের সঙ্গে আরেকজন মুসলমানের দেখা হলে আসসালামু আলায়কুম বলে অভিবাদন করতে হবে। এর জবাবে অন্যজন বলবে ওয়া আলায়কুমুস সালাম। দুনিয়াতে অভিবাদন জানানোর যত রীতি ও পদ্ধতি আছে, তন্মধ্যে এ বাক্য দুটি খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। গুড মরনিং, গুড ইভিনিং (শুভ প্রভাত, শুভ সন্ধ্যা) ইত্যাদি আইয়ামে জাহিলিয়াতেরই অবশিষ্টাংশ। নিদ্রায় যাওয়ার অথবা নিদ্রা থেকে জাগরণের সময় প্রত্যেক মুসলমানকে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সুবহানাল্লাহ ইত্যাদি পাঠ করা ভাল। সেই সঙ্গ নবী করীম (সা.) এর উপর দরুদ শরীফ পড়তে হবে। এর জন্য সবচাইতে সহজ পথটি হল ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি‘আলা মুহাম্মাদ ওয়াবারিক ওয়া সাল্লাম’ বলা।
নবী করীম (সা.) ডান দিককে বেশি পসন্দ করতেন। যেমন জুতো স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার সময় প্রথমে ডান পা এবং পরে বাম পায়ের জুতো পরতেন। আবার খোলার সময় এর ঠিক উল্টোটি করতেন। অর্থাৎ প্রথমে বাম পা এবং পরে ডান পায়ের জুতো খুলতেন। পিরহান (জামা) গায়ে দেওয়ার সময় প্রথমে ডান হাত এবং পরে বাম হাতের আস্তিন গায়ে দিতেন। মাতা আঁচাড়ানোর সময় ডান দিকের চুল আঁচড়ানোর পর বাম দিকের চুল আঁচড়াতেন। মসজিদ অথবা ঘরে প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা ফেলতেন। কিন্তু গোসলখানা বা পায়খানায় ঢোকার সময় প্রথমে বাম পা দিতেন, আবার বেরিয়ে আসার সময় প্রথমে ডান পা বাইরে ফেলতেন। সঙ্গী সাথীদের মধ্যে কোন কিছু বিতরণের সময় ডান দিকে দিয়ে শুরু করতেন এবং বাম দিক দিয়ে শেষ করতেন।
পানাহার : পর্ক বা শুকুরের মাংস বা চর্বি কোনভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। মদের ব্যাপারেও এই একই কথা। ইসলাম উভয়টাকেই হারাম করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ভ্রান্তির অপনোদন হওয়া আবশ্যক। কুরআন মাজীদে ‘খামর’ একটি শব্দ আছে। সাধারণত আঙ্গুর থেকে তৈরি মদকে খামর বলে। কিন্তু নবী করীম (সা.) এর যামানায় যে কোন প্রকার মদকেই ‘খামর’ বরে চিহ্নিত করা হত। সেখানে মদ কি দিয়ে তৈরি করা হত তা ছিল গৌণ। তাই দেখা যায় যে, ‘খামর’ সংক্রান্ত আয়াতটি যখন প্রথম নাযিল হয় তখন মদীনার মুসলমানগণ শুধু মদই ফেলে দেয়নি। বরং দেহের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এ জাতীয় সমস্ত পানীয়কে তারা নষ্ট করে ফেলে। সে আমলে মদীনায় খেজুর থেকেও এক ধরনের পানীয় তৈরি করা হত। কিন্তু এ পানীয়টি উত্তেজনা সৃষ্টি কারী ছিল বিধায় তাও ফেলে দেওয়া হয়। যে পশু বা পাখি ইসলামী কায়দায় যবেহ করা হয়নি, মুসলমানরা তার গোশত আহার করতে পারে না। এমনকি কোন অমুসলিম যদি গরু বা ছাগল যবেহ করে, তাহলে সে গরু বা ছাগলের গোশত খাওয়া মুসলমানদের জন্য হারাম। আবার একজন মুসলিম যদি রীতিসিদ্ধ ভাবে যবেহ না করে একটি মুরগী ছানাকে গলাটিপে মেরে ফেরে, তাও হারাম হয়ে যায়।
পাখি বা পশু যবেহ করার ইসলামী কায়দা এই যে, বিসমিল্লাহ বরে যবেহ করতে হবে। যবেহ করার সময় শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও গলার দুটি রগ কেটে দিতে হবে। কিন্তু পশু-পাখির মেরুদন্ড বা গলার হাদ দ্বিখন্ডিত করা ঠিক নয়। তাছাড়া প্রানীটি মরে যাওয়ার পূর্বে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার বা চামড়া ছাড়া নিষেধ। খাওয়া-দাওয়ার জন্য স্বর্ণ বা রৌপ্যের তৈরি থানা বা তৈজসপত্র ব্যবহার করা হারাম। নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, পুরুসের জন্য স্বর্ণ বা সিল্কের ব্যবহার করা হারাম। নারীর জন্য এটা জায়েয।’ অবশ্য স্থান বিশেষে এর কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন-সামরিক পোশাক হিসাবে সিল্কের ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। দাত বাধানোর জন্য স্বর্ণেল ব্যবহার করা জায়েয। জানা যায়, খলীফা উসমান (রা) এর দাত স্বর্ণ দ্বারা বাধান ছিল। আরফাজা ইবন আসাদ নামক জনৈক ব্যক্তি বর্ণিত এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, একবার এক যুদ্ধে তাঁর নাক কাটা যায়। এবঙ তিনি রূপোর তৈরি একটি নকল নাক ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রিয়নবী (সা.) এর অনুমতিক্রমে তিনি রুপোর তৈরি নাকের পরিবর্তে স্বর্ণের তৈরি নাক ব্যবহার করতে শুরু করেন।
পোশাক ও কেশ বিন্যাস রীতি : মুসলমান পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক রেশম (সিলক) দিয়ে তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করা হারাম। অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে পোশাক লাল রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে। নবী করীম (সা.) দাড়ি রাখতেন। তিনি দাড়ি রাখার জন্য জোড় তাকিদ দিয়েছেন। মুসলমানদের পোশাক এমন হতে হবে যাতে সমস্ত শরীর ঢেকে থাকে। পোশাকটি হতে হবে শালীন ও রুচিসম্মত। তারা এমন পোশাক পরিধান করবে না যাতে গলা ও কাধ বেরিয়ে থাকে, আবার পোশাকটি এমন পাতলাও স্বচ্ছ হওয়া উচিত নয় যাতে শরীরের আব্রু থাকে না অথবা নগ্নতা প্রকাশ পায়। তাছাড়া যে সমস্ত পোশাকের কারণে অন্যরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তেমন পোশাককে সর্বোতভাবে পরিহার করতে হবে।
ওযু ও সালাত : নবী করীক (সা.) বলেছের যে, “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।” সে কারণে সালাত আদায় করার শুরুতেই একজনকে দৈহিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। তবে সালাত আদায়ের পূর্বে সাধারণভাবে ওযু করতে হবে। ওযু করার আগে প্রয়োজনে গোসল করতে হবে। আর শুক্রবার জুম’আর সালাতের পূর্বে গোসল করার জন্য বিশেষ তাকিদ রয়েছে। ইসলামে গোসল করারও একটা নিয়ম আছে। প্রথমে তাকে ওযু করতে হবে। তারপর সারা শরীরে পানি দিয়ে ভালভাবে ধৌত করতে হবে। আর কুয়ো বা বালতির পানি দিয়ে গোসল করলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কমপক্ষে তিনবার পানি ঢালতে হবে।
ওযু করার নিয়মটা এ রকম : প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ নিয়ত করতে হবে ও বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে : দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া, পানি দিয়ে কুলি করা, নাক পরিস্কার করা, কপাল থেকে থুতনি এবং এক কান থেকে অপর কান পর্যন্ত সমস্ত মুখমন্ডল ধোয়া, প্রথমে ডান হাত এবং পরে বাম হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়া, মাথা মাসেহ করা, সর্বশেষ ডান বা বাম পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ধোয়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কাজ তিনবার করতে হবে। আর যদি এরকম হয় যে, কোথাও ওযু করার মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তাইয়াম্মুমের বিধান রয়েছে। তাছাড়া যে রুগ্ন, চিকিৎসাগত কারণে যে পানি ব্যবহার করতে পারে না, তার জন্যও তায়াম্মুমের অনুমোদন রয়েছে। তায়াম্মুমের বেলায়ও প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিয়ত করতে হবে, এবং বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হবে। তাপর সে পরিস্কার মাটির উপর হাত রাখবে, এবং দু’হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল মুছে ফেলবে। সে আবার মাটিতে হাত রাখবে অত:পর বাম হাতের তালু দিয়ে ডান হাতের কনুই পর্যন্ত মুছে ফেলবে এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বাম হাতের কনুই পর্যন্ত মুছে ফেলবে। বস্তুতপক্ষে এটা হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি মানুষের বিনয়-নম্রভাব প্রকাশের একটা নমুনামাত্র। বিভিন্ন কারণে ওযু নষ্ট হতে পারে। যেমন-মুখ ভর্তি বমি করা, ঘুম আসা, পায়খানা-প্রশ্রাব করা প্রভৃতি। তখন সালাত আদায় করতে হলে তাকে পুরনায় ওযু করতে হবে। ওযু ভঙ্গের আরো কারণ আছে।
সালাত আদায় করার শর্ত এই যে, তার কাপড় পাক হতে হবে, জায়গা পাক হতে হবে, তাকে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে হবে। আর কিবলা নির্বাচন করাটাও কঠিন কোন ব্যাপার নয়। বিশ্বের একটি সাধারণ মানচিত্র দেখেও এটা নির্ধারণ করা যায়। কম্পাসের সাহায্যে দিক নির্ণয় করা আরো সহজ। বলে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবী গোলাকার। ফলে যে দিকে মুখ করে দাড়ালে কা’বা সবচেয়ে কাছকাছি হয়। সালাতে সে দিকে মুখ করে দাড়াতে হবে। যেমন যারা নিউইয়ক শহরে আছে তারা পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ মুখ করে দাড়ালে কা’বা সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হবে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা সরাসরি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মুখ করে দাড়াবে। (বাংলাদেশীদের ও দাড়াতে হবে পশ্চিম মুখী হয়ে)। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে হয়। তন্মধ্যে শুক্রবার যোহরের সালাতের পরিবর্তে বৃহত্তর জামাতে জুম’আর সালাত আদায় করা হয়। তাছাড়া আরো দুটি বাৎসরিক সালাতের ব্যবস্থা আছে। একটি রমযান মাসে সিয়াম পালনের পর ১লা শওয়াল দিবসে, অপরটি মক্কা নগরীতে হজ্জ উদযাপনের সময়ে ১০ যিলহজ্জে। প্রথমটি ঈদুল ফিতরের সালাত দ্বিতীয়টি ঈদুল আযহার সালাম। এ দুটি ঈদে খাদ্য খাবারের আয়োজন করা হয়।
সব সালাতের নিয়ম-রীতি ও ভঙ্গিমা একই ধরনের। পার্থক্য শুধুমাত্র রাকআতের ক্ষেত্রে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে প্রথমেই আসে ফজরের সালাত। ফজরের সালাতে দু’রাকআত ফরয আর মাগরিব ওয়াক্তে পড়েত হয় তিন রাকাত ফরয। আর যোহর, আছর ও ইশার সালাতে ৪ রাকআত করে ফরয আদায় করতে হয়। শুক্রবার জুম’আর এবং বাৎসরিক সালাতের প্রতিটি দু’রাকআত ফরয আদায় করতে হয়। কিন্তু বাৎসরিক সালাত দুটি ওয়াজিব আর জুম’আর সালাত ফরয। নবী করীম (সা.) এর বাইরের ‘ইশার সালাতের পর আরো তিন রাকআত সালাত আদায় করার জন্য তাকীদ দিয়েছেন। এটাকে বলে বিতরের সালাত।
দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরয। নবী করীম (সা.) প্রতি ওয়াক্তেই ফরযের অতিরিক্ত আরো কিছু সালাত নিয়মিতভাবে আদায় করতেন। ফরযের অতিরিক্ত এ সালাত সুন্নত হিসাবে পরিচিত। ফযরের ফরয দু’রাকআতের পূর্বে ২ রাকআত সুন্নত, দুপুরে যোহরের ফরয সালাতের পূর্বে ৪ রাক’আত, সুন্নত এবং পরে দু’রাকাত সুন্নত, সন্ধ্যায় মাগরিবের ফরয সালাতের পর দু’রাকাত রাতে ইশার ফরয সালাতের পর দু’রাকআত সুন্নত এবং তিন রাকআত বিতরের সালাত আদায় করা ছাড়াও একজনের ইচ্ছা করলে আরো অনেক সালাত আদায় করতে পারে। কিন্তু এর সবটাকেই বলা হয় নফল ইবাদত। সালাত ফরয, সুন্নত বা নফল যাই হোক না কেন, যুত আদায় করা যাবে সওয়াবও হবে তত বেশি। তাছাড়া মসজিদে প্রবেশের পর দু’রাকআত সালাত আদায়ের জন্য মুসলমানগণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটাকে বলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ।
সালাত আদায়ের নিয়মটা এ রকম : প্রথমে ওযু করবে, সালাতের জন্য উপযুক্ত স্থান বেছে নিয়ে কিবলামুখী হবে, কান পর্যন্ত দু’হাত উঠিয়ে সালাতের নিয়ত করবে। নিয়তের বাংলা তরজমা এ রকম, আমি অমুক ওয়াক্তের অত রাকআতের ফরয বা সুন্নত সালাত কিবলামুখী হয়ে একাকী অথবা সম্মিলিতভাবে ইমাম হিসাবে অথবা ইমামের পেছনে দাড়িয়ে আদায় করছি। নিয়ত বলার পর আল্লাহু আকবার বলে দু’হাত বাধতে হবে। বাম হাতের উপর ডান হাত থাকবে। হানাফী, শাফী এবং হাম্বলী মাজহারের অনুসারীরা এ নিয়ম অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু মালিকী ও শিয়া মজহাব অনুসারে আল্লাহু আকবার বলার পর দু’হাত দু’পাশে লম্বালম্বি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এর পর শুরু হয় সালাতের মূল পর্ব। তখন আর কারো সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কোন দিকে তাকান যাবে না। দৃষ্টি থাকবে সিজদায় গেলে কপাল যেখানে ঠেকবে ঠিক সে স্থানে। উঠা-বসা, সিজদা বা রুকূতে যাওয়ার সময় প্রতিবারেই তাকে আল্লাহু আকবার বলতে হবে।
আল্লাহু আকবর বলে হাত বাধার পরই সানা পাঠ করতে হয়। সানা এ রকম : ‘সুবহানাকা আল্লাহুমা ওয়া বিহামদিকা ওয়াতাবারাকাছমুকা, ওয়া তা’আলা জাদদুকা লাইলাহা গায়রুকা’। এরপর তাকে সূরা ফাতিহার সঙ্গে মিলিয়ে কুরআন শরীফের একটি অংশ তিলাওয়াত করতে হয়। যোহর ও আছর ব্যতীত অন্যান্য ওয়াক্তের ফরয সালাতের সময় কুরআনের অংশটুকু ইমাম সাহেব সরবে তিলাওয়াত করে থাকেন। সালাতের অন্যান্য দোয়া-দরূদ নীরবে পাঠ করতে হয। সূরা-কিরাত পাঠ করার পর হাটুতে হাত রেখে মস্তক অবনত করতে হয় অর্থাৎ রুকূতে যেতে হয়। রুকূতে তিনবার সুবহানা রাব্বিয়া আজীম তাসবীহ পড়তে হয়: অত:পর সোজা হয়ে দাড়াতে হয়। সোজা হয়ে দাড়ানোর সময় বলতে হয়। সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ। এ সময়ে দু’হাতকে সোজাভাবে শরীরের দু’পাশে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এর পরেই আসে সিজদা। সিজদায় কপাল, নাক ও হাতের তালুকে মাটিতে রাখতে হয়। মনে মনে তিনবার বলতে হয় সুবহানা রাব্বিয়াল আলা। এরপর বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় কিছু সময় বসে আবার সিজদায় যেতে হয়। এবং তাসবীহ পাঠ করার পর আবার উঠে দাড়াতে হয়। একজন ব্যক্তির এই বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে থাকা, ইহরাম বাঁধা, সূরা-বিরাআত পড়া, নত হওয়া, পর পর দু’বার সিজদায় যাওয়া এসব কিছুর নাম হল রাকআত।
দ্বিতীয় রাকআতে প্রথম রাক’আতের মতো সূরা-কিরাত পড়তে হয়, রুকূ-সিজদায় যেতে হয়, তাসবীহ বলতে হয়। শুধু পার্থক্য এই যে, দ্বিতীয় রাকআতে সে সেজাদা থেকে উঠে দাড়ায় না। বরং নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় বসে আত্তাহিয়াতু পাঠ করতে হয়। সালাত আদায়ের জন্য যদি কিবলার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না যায়, তাহলে অনুমানে যে কোন দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা যাবে। আর আল্লাহ তো সর্বত্রই বিরাজমান। তবে সালাত আদায় করতে হবে খুবই ধীরস্থিরভাবে ও মনোযোগ সহকারে। দাড়ান অবস্থায় দৃষ্টি থাকতে হবে সিজদার সময় যেখানে কপাল ঠেকবে ঠিক সে স্থানে, আর রুকূর সময় দৃষ্টি থাকবে দু’পায়ের সম্মুখ ভাগে। ডান বাম অথবা উপরের দিকে তাকানো যাবে না। অনুরূপভাবে অহেতুকভাবে নড়াচড়া বা আগ-পিছ করা যাবে না। সর্বক্ষণ স্থির থাকতে হবে, রুকূ-সিজদায় যেতে হবে নির্ধারিত ভঙ্গিমায়। দৈনন্দিন জীবনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরযে আইন। পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি মানুষের জন্য এটা ফরয। আর জানায়ায় সালাত ফরযে কিফায়া। সমাজের কিছু সংখ্যক লোক এ সালাত আদায় করলে অন্যদেরটা আদায় হয়ে যায়। আর কেউ যদি এ সালাত না পড়ে তাহলে সমাজের সবাইকে গুনাহগার হতে হয়।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অপেক্ষা জানাযার সালাত খানিকটা ভিন্নতর। জানাযায় সালাতেও ওযু করতে হয। কিবলামুখী হতে হয়, নিয়ত করতে হয়, সূরা-কিরাত পড়তে হয়। কিন্তু এখানে রুকূ-সিজদায় যেতে হয় না, বা তাশাহুদের ভঙ্গিমায় বসতে হয় না। সালাত আদায় করতে হয় চার তকবীরে। প্রথমে আল্লাহু আকবর বলার পর সানা, সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোন একটি সূরা তিলাওয়াত করতে হয়। দ্বিতীয় তকবীরের পর নবী করীম (সা.)-রে উপরে দরূদ পাঠ ও সমস্ত মু’মিন মুসলমানের জন্য মুনাজাত করা হয়। তৃতীয় তকবীরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ মুনাজাত করা হয়। চতুর্থ তকবীরের পর সালাম ফিরিযে জানাযার সালাত শেষ করতে হয়। কেউ অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে এবং দাড়িয়ে সালাত আদায় করতে সমর্থ না হলে সে তার সুবিধা অনুসারে বসে বা শুয়ে সালাত আদায় করবে। শুয়ে সালাত আদায় করার সময় সে নিয়ম মাফিক সূরা-ক্বিরাত ও দোয়া দরূদ পাঠ করবে। আর কল্পনায় রুকূ-সিজদায় যাবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে। অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী অবস্থায় একজন মুসলমান বসে এমনকি শুয়েও নামায আদায় করতে পারে। বসে নামায পড়ার সময় সে এমনভাবে রুকূতে যাবে যাতে কপাল পানি স্পর্শ না করে। যদি শুয়ে শুয়ে নামায পড়তেই হয়, তাহলে সে পর্যায়ক্রমে দাড়ান, রুকূ, সিজাদ ও তাশাহুদের কথা স্মরণ করবে। আর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমস্ত দোয়া-দরূদ তেলাওয়াত করতে হয়, মনে মনে সেগুলি তেলায়াত করতে হবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে।
কেউ যখন সফরে থাকে তখন সে চার রাক’আতের পরিবর্তে দুই রাক’আত ফরয পড়ে থাকে। আবার বিশেষ পরিস্থিতে সময়ের স্বল্পতা বা প্রচন্ড চাপের মুখে থাকলে দু’ওয়াক্তের সালাতকে একত্রে আদায় করতে পারে। যেমন দুপুর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় যোহন ও আছর এর মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করা যায়। হজ্জের সময় আরাফাতে ও মুজদালিফায় এ ভাবে সালাত আদায় করতে হয়।
মাযহাব : ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্নতা ক্ষেত্রে মুসলমাদের মধ্যে প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় রয়েয়ে-সুন্নী, শিয়া ও খারিজী। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আবার বিভিন্ন দল বা মাযহাব রয়েছে। যেমন সুন্নীদের মধ্যে রয়েছে চারটি মাযহাব : হানাফী, শাফী, মালেকী ও হাম্বলী। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা মাযহাবের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ বা আচরণ ও অনুষ্ঠাগত বৈষম্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখা যথেষ্ট যে নেতৃস্থানীয় ফকীহ ও মুজতাহিদগণ তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী করীম (সা.) এর বাণী ও আচার-আচরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। আমল করেছেন তদনুসারে। এখান থেকেই ফকীহগণের মধ্যে এক একটি মতের সূত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।