Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

| প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ দুই ॥
দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) বলতেন আমার ধরণা যদি ফুরাতের তীরে কোন ছাগী পথ হারিয়ে মারা যায় তবে আল্লাহ আমাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। “আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া *বৈরুত; দারুল কিতাবিল আরাবী, ৫ম সংস্করণ ১৪০৭ হি.), খ.১.পৃ.৫৩, ইবন সা‘দ আততাবাকাতুল কুবরা, খ.৩.পৃ. ৩০৫।”
ত্রুটিমুক্ত গাড়ি : নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য ক্রুটিমুক্ত গাড়ি প্রয়োজন। কেননা গাড়িতে ক্রুটি থাকলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য ড্রাইভিংয়ের পূর্বে ভালভাবে গাড়ির ক্রুটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। গাড়ির ক্রুটির কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় ড্রাইভারকে বহন করতে হবে। প্রতিটি দেশের ট্রাফিক আইন ও নির্দেশনায় রাস্তায় চলাচলে উপযুক্ত গাড়ির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ ট্রাফিক আইন : একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রাফিক আইন ড্রাইভিংয়ের মূলভিত্তি। এ আইনের কোন ধারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে তা পালন করা অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর সিদ্ধান্ত। (৭৫/২/ঘ:৮) ঃ “সড়ক আইনের যে বিষয়গুলো ইসলামী শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়, সে বিষয়গুলো মেনে চলা আবশ্যক। কেননা এ আইন মেনে চলা শাসকের সামগ্রিক আনুগত্যের অন্তভুক্ত। এর ভিত্তি হল মাসালিহে মুরসালাই “মাসালিহ মুরসালাহ বলা হয ঐসব বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলীকে যা শারী‘আত প্রণেতার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ, কিন্তু তা গ্রহণ বা পরিত্যাগ করার পক্ষে বিপক্ষে কোনো দলীল নেই। অথচ তা বিবেচনায় এনে কোনো বিধান প্রণয়ন করলে মানুষের কল্যাণ সাধিত অথবা অকল্যাণ দূরীভূত হয়। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মদ রুহুল আমিন, ইসলামী আইনের উৎস (ঢাকা, বাংলাদেশ ইসলামিক ল‘রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, ২০১৩ খ্রি.),পৃ.১৫০।” এ আইন শরীআহে অপরাধ প্রতিরোধের যে মূলধারা ও উপধারা রয়েছে তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। যা জনসাধারণের কল্যাণের বিবেচনায় আইনের এ অধ্যায়ে করা সম্ভব। এর অন্যতম একটি হল আর্থিক দ-। যে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করবে তার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেন সড়ক ও মহাসড়কে যে সব চালক সবাইকে বিপদের মুখোমুখি করে তারা নিবৃত্ত হয়”। “শাবাব (সাময়িকী), সংখ্যা .১৩.যুলহিজ্জাহাজ, ১৪২০হি.।” ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স গ্রহণ এ আইনের একটি অংশ।
ড্রাইভারের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ইসলামী শরীয়ার আলোকে ড্রাইভারের প্রধান দায়িত্ব ট্রাফিক আইন মানা। কেননা সরকার ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণার্থে এবং জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে এ আইন প্রণয়ন করেছে। এ প্রসঙ্গে ট্রাফিক আইন মানা শাসকের নির্দেশ মান্যকরণের আওতাভুক্ত।“ওহাবাব আল যুহাইলী, আল ফিকহুল ইসলামী ও আদিল্লাতুহু (দামিশক: দারুল ফিকর ৩য় সংস্করণ, ১৪০৯ হি.), খ.৬.পৃ.৭০৪।”
শাসকের অনুসরণের অপরিহার্যতা শরীয়তের উৎস ও বিধিবিধানের মূলসূত্র আল-কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণিত। আল্লাহতায়ালা বলেন : হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর আনুগত্য করো রাসূলের এবং তাদের তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী। “আল-কুরআন, ০৪ : ৫৯।” কাযী ইবনুল আরাবী (৪৬৮-৫৫৩ হি. বলেন, আনুগত্যের সারকথা হল নির্দেশ পালন করা। যেভাবে অবাধ্যতার সারকথা হল নির্দেশ অমান্য করা। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আমার মতে আয়াতের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা হল উলিল আমর’ দ্বারা উদ্দেশ্য শাসকবৃন্দ ও আলিম সমাজ। “ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন (বৈরুত : দারুল মা‘রিফা, সনবিহীন), খ.১,পৃ.৪৫১; আবুবকর আল জাসসাস, আহকামুল কুরআন (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ সনবিহীন), খ.২.পৃ,২৬৪; ইবন হাজর আল আসকালানী, ফাতহুল বারী (কায়রো : দারুর রাইয়্যান, ২য় প্রকাশ, ১৪০৯ হি.) খ.১৩,পৃ.১২০।” এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আয়াতে আল্লাহর আনুগত্য রাসূলের আনুগত্যের সাথে উলূল আমরের মাঝে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই গভীর যোগসূত্রকে সুস্পষ্ট করেছেন এই বলেন : “যে আমার আনুগত্য করবে সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হল সে আল্লাহর অবাধ্য হল। যে শাসকের অনুসরণ করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে শাসকের অবাধ্য হল সে আমার অবাধ্য হল। “ইমাম বুখারী আসসাহীহ আহকাম অধ্যায় বাব হাদিস নং (৬৭১৮); মুসলিম আসসহীহ, ইমারাত অধ্যায়, আল্লাহর নাফরমানী না হলে শাসকের আনুগত্য আবশ্যক, হাদিস নং (৪৭২৪)। উল্লিখিত হাদিসের শব্দ সহীহ মুসলিমের।”
অতএব, ড্রাইভারের উচিত, ড্রাইভিংয়ের সময় ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করা ও যে কোন প্রকার ক্ষতি সাধন থেকে দূরে থাকা। দুটি ক্ষতির একটিকে গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির বিষয়টি অবলম্বন করা।
ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা : ট্রাফিক আইন মানার প্রথম দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলেন চালক। মানুষের জানমাল রক্ষার্থে এবং ট্রাফিক সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে শাসক যে আইন করেন তা মেনে চলতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন। এর পাশাপাশি এ আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা ও নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্য রয়েছে। আইনটি নিষ্ঠার সাথে প্রয়োগ করা পুলিশের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। তিনি মানুষের মাঝে কোন প্রকার বিভেদ ছাড়া, ব্যক্তি পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং উত্তম চরিত্রের গুণাবলী ধারণ করে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করবেন। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ইসলামে মুহতাসিবের “মুহতাসিব অর্থ হিসবাহ কার্যক্রম পরিচালনাকারী।
হিসবাহ বলা হয়, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নীতিমালার ভিত্তিতে চলমান শরীয়াহ তথা আইন বিরোধী কর্মকা- প্রতিরোধ এবং শরীয়াহ ভিত্তিক জীবনযাপনের দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোকে। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মদ রুহুল আমীন, শরীয়া আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নীতিমালা ও আল হিসবাহ : একটি পর্যালোচনা” ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, বর্ষ ৫৫, সংখ্যা ২, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫, পৃ.৩১” ভূমিকার ন্যায়। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে লোকদের উপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেবেন না। অপরদিকে নিজ কর্তব্য পালনে কোন শিথিলতা প্রদর্শন করবেন না। সড়ক দুর্ঘটনার দায় আলোচনার পূর্বে এর কারণ ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশ্লেষণ করা জরুরি বিধায় নিম্নে এ সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো : হৃদয়বিধারক সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। এ কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু ও সম্পদহানি ঘটে। নিম্নে সড়জ দুর্ঘটনার কারণসমূহ তুলে ধরা হলো :
মাত্রাহীন গতি : বাস্তবতা হলো, ড্রাইভিংয়ের গতির একক কোন মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। রাস্তা প্রশস্ত ও সংকীর্ণ হওয়ার বিবেচনায় গাড়ির ভিড় থাকা ও না থাকার বিবেচনায় গতির মাত্রা পরিবর্তন হয়। বরং এক গাড়ির সাথে অন্য গাড়ির গতির মাত্রায় ও পরিবতন হয়।
অতএব, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি কোন গতির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হলে সে গতিমাত্রায় গাড়ি চালানো আবশ্যক। আনাস (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেন : “ধীরস্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে”। “বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ.৪.পৃ.৮৯. হা. নং: ৪৩৬৭; সুয়ূতী আল জামিউস সগীর-এ হাদিসটিকে (৩৩৯০) যয়ীফ বলেছেন। তবে এ হাদিসের সমর্থনে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে এ হাদিসটিকে দুর্বল না হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়। এ কারণে শায়খ আলবানী সহীহুল জামিউস সগীর (৩০১১) বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।” “ইবনুল কারিম (রহ.) (৬৯১-৭৫১হি.) বলেন : তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে হওয়ার কারণ তাড়াহুড়া হলো চঞ্চলতা ও অস্থিরতা, যা ধীরস্থিরতা গাম্ভীর্য ও সহনশীলতার সাথে যেকোন কাজ সম্পন্ন।” করতে মানুষকে বাধা দেয় এবং তা যে কোনো বস্তুকে অপাত্রে রাখতে বাধ্য করে। এটি বিভিন্ন ক্ষতি টেনে আনে ও কল্যাণ রোধ করে। এটি মূলত দুটি মন্দ স্বভাবের মিলনে জন্মলাভ করে : অতিমাত্রায় অবহেলা আর সময়ের পূর্বে কোন বিষয়ের তাড়া করা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ