চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আফতাব চৌধুরী
॥ শেষ কিস্তি ॥
কোন অপরাধী এখন তার অপরাধ করতে ভয় পায় না, কোনও কর্মচারী কাজে গাফিলতি করতে কুণ্ঠিত হয় না, কোনও নেতা বা আমলা সরকারি তহবিল তছরুপ করতে দ্বিধা করেন না। কারণ, জবাবদিহি হলে টাকা ঢাললেই সাতখুন মাপ।
কাজেই ভয় নেই, এগিয়ে যাও মন্ত্রে সবাই দীক্ষিত, পেছনে ফিরে এখন আর তাকায় না কেউ। আমাদের দেশের ঘুষের রমরমা বাজারে অবাঞ্ছিতদের ভিড়। অবাঞ্ছিত ও অযোগ্য লোকেরা টাকার বিনিময়ে দেশের অধিকাংশ সুযোগা-সুবিধা করায়ত্ত করে নিচ্ছে। বাঞ্ছিত, উপযুক্ত এবং যোগ্য ব্যক্তিরা ক্রমশ দুর্বল ও একঘরে হয়ে পড়েছে। সমাজ এখন দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের ভিড়ে ঠাসা। এদের উৎপাতে সমাজজীবন টলায়মান। কারও বলার কিছু নেই, করার কিছু নেই, প্রতিবাদের পথও প্রায় বন্ধ। কারণ, প্রতিবাদে কোন কার্যকরী প্রতিকার হয় না, যা হয় তা ভ-ামির নামান্তর। বেড়ে যায় ব্যক্তিগত শত্রুতা। আজকাল শত্রুতার পরিণাম জীবন নাশ। এখন আর কেউ কাউকে কিল, ঘুষি, থাপ্পড় মারে না। কারণ, এরূপ করলে প্রতিপক্ষ তাকেও আবার কিল, ঘুষি মারার সুযোগ পায়। সুতরাং প্রতিপক্ষকে একেবারে খালাস করে দিলেই উঠোন পরিষ্কার হয়ে যায় আর থানা, আদালতে কিছু টাকা ঢাললে কাপড় সাফ-সুতরো হয়ে যায়। সমাজে একবার নিজের সম্বন্ধে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারলে পথ পরিষ্কার থাকে। টাকা থাকলে জবাবদিহির সম্ভাবনা থাকে খুব কম। আমরা এখন এমনই এক সমাজে বসবাস করছি। আমাদের সমাজে এখন নিয়মশৃঙ্খলার ধার কেউ ধারে না। যে যার সুবিধা মতো চলছে। ধরা-বাঁধার বালাই নেই। এরপর সমাজ চলছে, জীবনও চলছে, কারণ, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মানুষ প্রকৃতির হাতের ক্রীড়নক। এন্ডি মুগার পোকা যেমন নিজস্ব নিঃসৃত বিষ্ঠায় আবদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়, মানুষও তেমনি তার অপকর্মের ফাঁদে পড়ে হা-হুতাশ করছে। সার কথা, মানুষ নিজের অপকর্মের দ্বারা নিজের বাসস্থানকে কলুষিত করে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যকে বিফল করছে। মানবজীবনে এর চেয়ে বড় কী দুর্ভাগ্য আর হতে পারে।
ঘুষের সংস্কৃতি যেভাবে আমাদের দেশে ঘাঁটি গেড়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এত সহজে সম্ভব না হলেও দেশের মানুষ যদি ঘুষের অপকারিতা প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করে এবং তা থেকে মুক্তি পেতে বদ্ধ পরিকর হয় তবেই ঘুষ বা উৎকোচের অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে। কারণ, জনসাধারণের সদিচ্ছার সামনে কোন কিছুই বাধা হয়ে টিকে থাকতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো, এই সদিচ্ছার উন্মেষ ঘটবে কীভাবে? কোনও এককপথে তা সম্ভব নয়, এটা একটা সামগ্রিক প্রয়াসের ফলশ্রুতিতে অর্জিত হবে। আমাদের স্কুল কলেজের পাঠক্রমে বস্তুবাদী অর্থকরী পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিক চরিত্র গঠনের পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ পাঠদান ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া কোনভাবেই মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নিজেরা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে এবং দেশকে গভীরভাবে ভালবাসতে শিখে সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠক্রম চালু করতে হবে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে জাগ্রত ও উন্নত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রচারমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। প্রচারমাধ্যমগুলো অনৈতিক, মূল্যবোধবর্জিত ও ধ্বংসাত্মক জীবনবোধের চর্চা ও প্রচার বন্ধ করে নৈতিক, মূল্যবোধ সংবলিত ও গঠনমূলক জীবনবোধের চর্চা ও প্রচার শুরু করলে মানুষের মনে সুস্থতা ফিরে আসবে, মানুষ সুস্থ সমাজ গঠনে ব্রতী হবে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের দেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই দেশের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে গেলে গণতান্ত্রিকভাবে জনগণকে এগুতে হবে। দেশের প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা দেশের পটপরিবর্তনের বড় হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ দেশের আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। প্রথমত, দেশের জনগণকে নিজেদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, ধর্ম, ভাষা, জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সবার কাছে পরিচিত সমাজকর্মীদের মধ্য থেকে সৎ, শিক্ষিত, অভিজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মঠ এবং ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের নেতা হিসেবে বেছে নিয়ে নির্বাচিত করতে হবে। তৃতীয়ত, অশিক্ষিত, অসৎ, দুর্নীতিবাজ, ভ-, প্রতারক নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, আগেকার দিনের মতো যেভাবে জনগণের তথা দেশের সেবায় অনেক আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার পর দেশের জনগণ কাউকে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিত, আমাদের আজকের রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে ঠিক সেভাবে গড়ে তুলতে পারলে অনভিজ্ঞ, প্রতারক, দুর্নীতিবাজ, মাফিয়াদের হাত থেকে আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডল মুক্ত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।